রমা চক্রবর্তী, শিক্ষিকা, আবৃত্তিকার ও ফিচার রাইটার, দুর্গাপুর:

আমার দাদামশাইয়ের কথা এর আগে একটি প্রতিবেদনে লিখেছিলাম "তিন টুকরো স্বাধীনতা নয়, নেতাজীর অখন্ড ভারত চেয়েছিলাম" এই শীর্ষকে|

স্বাধীনতার পরবর্তীকালে স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসাবে তিনি কোনো সরকারী সুযোগ-সুবিধা, টেলিফোন, পেনশন এই সব কিছুই গ্রহণ করেননি| কারণ তাঁর অন্ন-বস্ত্রের কোনো অভাব ছিল না, আর তাই তিনি এই সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন| আসলে তিনি মনে-প্রাণে নেতাজী অনুগামী ছিলেন বলেই হয়তো কোনো সরকারী সাহায্য নিতে মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন না|

আবার ঠিক তার উল্টো দৃশ্যও আমি দেখেছি যেখানে এই সরকারী সাহায্যটুকু পেলে হয়তো মানুষটা দু-বেলা দু-মুঠো ভাত পেত|

তখন ১৯৯৯-২০০০ সাল। আমি বর্ধমান পরবর্তী স্টেশন শক্তিগড়ের বড়শুলে Teachers Training এ ছিলাম| তখন ওখানে যে আদিবাসী পাড়া ছিল সেখানে গিয়েছিলাম| সেখানে একজনের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। তাঁর নাম এখন আর আমার স্মৃতিতে নেই তবে তার বয়স সেই সময় ৯৫ বছর পেরিয়ে গেছে। এতগুলো বছর পরে বর্তমানে তিনি আর জীবিত আছেন কিনা আমার অজানা|

তাঁর স্মৃতিচারণায় যেটুকু জেনেছিলাম তাঁর পিতা হুল বিদ্রোহের সৈনিক ছিলেন| তিনি তাঁর পরিবার নিয়ে ঝাড়খন্ড থেকে পুরুলিয়া চলে আসেন। এরপর স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তাপ তাঁকেও উদ্বুদ্ধ করে| তিনি অন্যের জমিতে জনমজুরি করতেন এবং মনে প্রাণে স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন| ব্রিটিশ সরকার সেই সংবাদ পাওয়া মাত্রই তাদের আদিবাসী পরিবারের কতগুলি বাড়ীতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল| স্বাধীনতা পরবর্তীকালে তিনি পরিবার নিয়ে শক্তিগড়ের বড়শুলে এসে বসবাস করতে শুরু করেন|

এতদিন পরে আজ এই প্রতিবেদনটি লিখতে বসে একটা কথাই মনে হচ্ছে আমাদের সরকার কী পারেন না এই মানুষগুলোকে খুঁজে বার করে তাদের দু-বেলা দু-মুঠো অন্নের ব্যবস্থা করে দিতে? তা সে যে সরকার- ই হোক লাল-সবুজ-গেরুয়া যে কেউ|

সরকার বলতে তো মুখ্যমন্ত্রী অথবা প্রধানমন্ত্রী এই কাজগুলো করবেন না| তার জন্য নিযুক্ত আছেন তাদের দলের মানুষ অর্থাৎ জন-প্রতিনিধি যারা ভোটে জেতেন পুরপিতা-পুরমাতা, পঞ্চায়েত সদস্য-সদস্যা,পঞ্চায়েত প্রধান প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ|

তারা যদি সঠিকভাবে মানুষের কাছে যেতেন, খোঁজ নিতেন তাহলে এইসব মূল্যবান (স্বাধীনতা সংগ্রামের সদস্য) মানষগুলোকে খুঁজে বার করা খুব একটা কঠিন কাজ নয়|

একটা সামান্য উদাহরণ দিই গত ৫ ই সেপ্টেম্বর "শিক্ষক দিবস" উপলক্ষ্যে কোনও এক মিউনিসপ্যালিটি এলাকায় প্রত্যেক ওয়ার্ডের পুরপিতা- পুরমাতা উদ্যোগে কিছু না কিছু অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে| সেখানে বাছাই করা কয়েকজন শিক্ষককে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। অর্থাৎ তেলা মাথায় তেল দেওয়া যাকে বলে| যদি প্রকৃতই শিক্ষকদেরকে সম্মান করার কথা ওনারা ভাবতেন তাহলে নিজ নিজ এলাকার সকল শিক্ষকদেরকেই সম্বর্ধনা দিতেন| কিন্তু তা নয়, এটা শুধুমাত্র একটা প্রচারমুখী অনুষ্ঠান|

তাই সে যে আন্দোলনই হোক না কেন --হুল বিদ্রোহ, বঙ্গ-ভঙ্গ আন্দোলন, বা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলন, সেই মানুষগুলো যারা আন্দোলনের সৈনিক ছিলেন, যদি আজও তাঁরা বেঁচে থাকতেন তাহলে ভাবতেন যে, তাঁরা এ কোথায় বাস করছেন? এবং তাঁরা যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা সে কোন দেশের জন্য?--এই কি সেই ভারতবর্ষ? এই কি সেই সোনার বাংলা বা রূপসী বঙ্গমাতা?


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours