মৌসুমী চৌধুরী, লেখিকা ও শিক্ষিকা, কলকাতা:

"ওভার-রাইটিং করছ, আমি নাম্বার দিমু না, পরিস্কার কথা," নাকের ওপর চশমাটা ভালো করে আঁটতে আঁটতে বলেছিলেন শিলাবাড়ি হাট আর.আর. প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মহেন্দ্র স্যার। আমি কাঁচুমাচু মুখে বলেছিলাম,

"উত্তরটা তো ঠিক আছে, স্যার।" অগ্নিশর্মা হয়ে তিনি বলেছিলেন, " ওভার-রাইটিং এর মতন একখান অতবড় ভুল কাজ কইরা আবার কইতাছো উত্তর ঠিক আছে?।" সেইদিন, সেই বয়েসে শিখেছিলাম ওভার-রাইটিং একটি গর্হিত অপরাধ।

জলদগম্ভীর কন্ঠে তিনি বলেছিলেন, "কানে দুল, গলায় হার, পায়ে নূপুর---এসব কি শুনি? এসব পরলে ছাত্রজীবনের ছাত্রত্ব নষ্ট হয়। এখনকার ড্রেস সবুজ স্কার্ট আর সাদা শার্ট। পায়ে সাদা মোজা আর সাদা কেডস্। তবেই না ছাত্র ছাত্র লাগবে।" "ছাত্রত্ব" শব্দটি বেশ খটোমটো লাগলেও চোখের জল মুছতে মুছতে কানের সোনার দুলটি খুলে তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলাম। পরে মাকে ডেকে সাবধান করে তিনি দুলটি ফেরত দিয়েছিলেন।

প্রসঙ্গত বলি, মাও তাঁর ছাত্রী ছিলেন। আমরা মা ও মেয়ে দু'জনেই তাঁকে যমের মতো ভয় পেতাম। যুগে যুগে তাঁর আবেদন ছিল একই। তিনি আলিপুদুয়ার নিউ টাউন গার্লস হাই স্কুলের শিক্ষিকা ভারতী বোস।

ভারতীয় দর্শন ক্লাসে তাঁর গমগমে গলা আমাকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করত। বৌদ্ধ নৈরাত্ম্যবাদ বোঝাতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, "জড়জগৎ ও মনোজগতে পরিবর্তনের ধারা চলছে, আমরা কেবল সেই পরিবর্তনের ধারাকেই প্রত্যক্ষ করি কিন্তু পরিবর্তনশীল অবস্থাগুলির ধারকরূপে কোন স্থায়ী আত্মার অস্তিত্ব নেই।" একথা শুনে প্রভুত  প্রশ্ন জেগে উঠেছিল আমার  মনে। তিনি সহাস্যে বলেছিলেন, "বিকেলে বাড়িতে এসো। হবে দীর্ঘ আলোচনা। পার্ক রোডে বাড়ি আমার।"

তাঁর জন্যই এক সময় বৌদ্ধদর্শন খুব প্রিয় বিষয় হয়ে উঠেছিল আমার। তিনি আলিপুদুয়ার কলেজের দর্শনের অধ্যাপিকা শ্রীমতী শ্যামলী সান্যাল।

তখন আমাদের উড়নকাল--- বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। তিনি বলেছিলেন, "আগামীকাল ২৫শে বৈশাখ। গুরুদেবের জন্মদিন। সকাল সকাল চলে এস। মেনু ঠিক করবে তোমরাই। তবে পায়েসটা মাস্ট। সাবেকী পায়েসে হবে জন্মদিন পালন।" খুব ভোরে আমি, মিতালী, কাকলী আর তিনি সাইকেল নিয়ে শ্যামবাটি ক্যানেল পেরিয়ে গিয়েছিলাম  প্রান্তিকে। রেললাইনের ধারে উন্মুক্ত প্রকৃতির মাঝে তাঁর ভরাট গলায় শুনেছিলাম, "আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ/চুনী উঠল রাঙা হয়ে/ আমি চোখ মেললুম আকাশে /জ্বলে উঠলো আলো পুবে পশ্চিমে.." শিক্ষকের দূরত্ব ঘুচিয়ে তিনি আমাদের পরম বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। তিনি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন সদনের অধ্যাপক ডঃ সুশান্ত সেন। আমাদের প্রিয় সুশান্তদা।

তাঁহাদের কথা এত স্বল্প পরিসরে শেষ হবার নয়। আরও অনেকেই বাদ রয়ে গেলেন।

আমার সমস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের আজ ভক্তিপূর্ণ প্রণাম জানাই। তাঁহাদের ঋণ এ জীবনে অপরিশোধ্য।





Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours