সজল বোস, সমাজকর্মী, দুর্গাপুর:
যখন ওরা তোমার চামড়ায় জ্বালা ধরানো
সপাং সপাং চাবুক মারে আর
হো হো ক’রে হেসে ওঠে,
তখন কালসিটে পড়ে, সভ্যতার পিঠে।
যখন ওরা বুটজুতো মোড়া পায়ে লাথি মারে তোমাকে,
তখন ধুলায় মুখ থুবড়ে পড়ে মানবতা।
কবির কণ্ঠে ধ্বনিত বাণীর পরে যদি লজ্জিত হয় সমাজ, না নুতুন রূপে সেই পুরাতন ভাবনা আজও আর্তনাদ করে বলছে দৃপ্ত কণ্ঠে আমি কালো।
আজ এমনই এক কৃষ্ণাঙ্গ তরুণের কাহিনী তুলে ধরবো।
বৈষম্য ও বঞ্চনার যে বীজ সপ্তদশ শতকে উপ্ত হয়েছিল এই কয়েকশো বছরে তা সর্বব্যাপী বিষবৃক্ষের রূপ ধারণ করে। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক— সমস্ত ক্ষেত্রেই কালো মানুষদের বঞ্চিত হতে হয়, সচেতনভাবে তাঁদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত করা হয়, অমানুষিক লাঞ্ছনার শিকার হতে হয় তাঁদের। কালো মানুষরা অবমানব, পশুবিশেষ, এমনই নানা ধারণা শ্বেতাঙ্গ সমাজে ছড়িয়ে পড়ে, পরিপুষ্ট হয় এবং নানাভাবে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি আচরণে প্রতিফলিত হতে থাকে। এমনকি মালিকের গৃহপালিত পশুদের স্থানও ছিল একজন ক্রীতদাসের চেয়ে বেশি সম্মানের।
১৯০৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ব্রংস নামক একটি চিড়িয়াখানায় নিয়ে আসা হয় ওটা বেঙ্গা নামে এক কৃষ্ণাঙ্গ তরুণকে। শুধুমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ার অপরাধে তাকে স্থান দেয়া হয় বানরের খাঁচায়।
চার ফুট এগারো ইঞ্চি উচ্চতার, ছোট-খাটো গড়নের, তীক্ষ্ণ-ধারালো দাঁতের এ মানুষটি সম্পর্কে যতটুকু জানা যায়, তাতে বর্তমানে গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের অধিবাসী ছিলেন তিনি। নিশানা লক্ষ্য ভেদ ধনুক দিয়ে তীর ছুঁড়ে মারার ব্যাপারে অত্যন্ত দক্ষ বেঙ্গাকে ১৯০৪ সালে অপহরণ করা হয়।
খাঁচাবন্দি বেঙ্গাকে দেখে অনেকে বুঝতে পারতেন না সে মানুষ নাকি পশু। তার খাঁচার বাইরে একটি নোটিসে ‘সেপ্টেম্বর মাসের প্রত্যেকদিন দুপুরে তাকে প্রদর্শনের জন্য উন্মূক্ত রাখা হবে’ বলেও লেখা ছিল।
দর্শকদের আনন্দ দান করার জন্য জামা-কাপড় পরিয়ে রাখা হলেও খালি পায়ে থাকতেন বেঙ্গা।
দর্শনার্থীদের জন্য অত্যন্ত আকর্ষনের কেন্দ্রে ছিলেন তিনি। বিশেষ করে শিশুরা তাকে দেখে খুব মজা পেতো, হাসাহাসি করতো এবং জোরে চিৎকার করে উঠতো। কোনো কোনোদিন খাঁচার একসাথে পাঁচশো লোকও জড়ো হতো বেঙ্গাকে দেখতে।
বেঙ্গার এই কথা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তেই যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে ও বাইরে ব্রংস চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের এই উদ্যোগের তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। কিন্তু চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ তাকে বন্দি করে রাখার পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলা হয় তাকে প্রদর্শনের জন্য সেখানে আটকে রাখা হয়নি, রাখা হয়েছে তার নিরাপত্তার স্বার্থে, যাতে করে সে এখান থেকে পালিয়ে যেতে না পারে। ওটা বেঙ্গাকে বন্দি করে রাখার এই ইতিহাস ধামাচাপা দিতে কর্তৃপক্ষের তরফে কয়েক দশক ধরে নানা ধরনের চেষ্টা চালানো হয়।
আবার কখনও বেঙ্গাকে চিড়িয়াখানার কর্মী বলেও দাবি করতে থাকে কর্তৃপক্ষ।
জানা যায়, তীব্র সমালোচনা ও ক্ষোভের মুখে তার বন্দিত্বের অবসান ঘটে। পরে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় নিউইয়র্কে কৃষ্ণাঙ্গ এতিমদের একটি আশ্রয় কেন্দ্রে যার নাম ছিল হাওয়ার্ড কালার্ড অরফান অ্যাসাইলাম। ১৯১০ সালের জানুয়ারিতে তিনি চলে যান ভার্জিনিয়ায়।
সেখানে তিনি কৃষ্ণাঙ্গ শিক্ষার্থীদের জন্য নির্মিত লিঞ্চবার্গ থিওলজিক্যাল সেমিনারি এন্ড কলেজে বসবাস করতেন। সেখানে তিনি স্থানীয় ছেলেদের মাছ ধরা ও তীর ধনুক দিয়ে শিকার করা শেখাতেন।
এছাড়াও তাদেরকে তিনি তার নিজের দেশের অ্যাডভেঞ্চারমূলক গল্প শোনাতেন। সেখানকার লোকজন বলেছেন যে ওটা বেঙ্গা রাতের আকাশের নিচে আগুন জ্বালিয়ে তার চারপাশে বৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে নাচতেন ও গান গাইতেন। পরে তিনি দেশে ফেরার জন্য আকুল হয়ে পড়েন। কিন্তু প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের কারণে জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে তিনি আর আফ্রিকায় ফিরতে পারেননি। তখন তাকে গ্রাস করে বিষণ্ণতায়। বেশিরভাগ সময় তিনি গাছের নিচে চুপ করে বসে থাকতেন। এরপর ১৯১৬ সালের মার্চ মাসে তার নিজের কাছে লুকিয়ে রাখা একটি বন্দুক দিয়ে বুকের মধ্যে গুলি করে তিনি আত্মহত্যা করেন। শেষ হলো এক জীবনের ইতিবৃত্ত। যেখানে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেননি।
এই নারকীয় ঘটনার ১১৪ বছর পর তাকে খাঁচায় ভরে প্রদর্শনের জন্য ক্ষমা চেয়েছে নিউইয়র্কের ওই চিড়িয়াখানাটি পরিচালনাকারী সংস্থা ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটি। যদিও এ ঘটনার জন্য ক্ষমা চাইতে লেগে যায় চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের এক শতাব্দীরও বেশি সময়।
সংস্থাটি ইতিহাসের এই অসম্মানজনক অধ্যায়ের নিন্দা জানিয়ে বলেন, এই ঘটনার কারণে এবং নিন্দা না জানানোর কারণে এতোদিন যে অনেক মানুষ আহতবোধ করেছেন তাতে আমরা অনুতপ্ত।
কিন্তু আজও সেই বর্ণ বিদ্বেষী মানষিকতা কি থেমেছে, সম্প্রতি গত ২৫ মে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক জর্জ ফ্লয়েডকে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ প্রকাশ্যে মেরে ফেলার পর পুলিৎজারজয়ী কবি জেরিকো ব্রাউনের ‘বুলেট পয়েন্টস’। এই কবিতায় আফ্রিকান-আমেরিকান নাগরিকদের ওপর পুলিশের নির্যাতনের বিষয় উঠে এসেছে।
জেরিকো ব্রাউনের কবিতা
*বুলেটের মুখে*
নিজের মাথা তাক করে আমি চালাব না গুলি
নিজেরই পৃষ্ঠদেশে আঁকব না বুলেটের চুম্বন
ময়লার ব্যাগের সাথে ফাঁস লটকে মরব না কোনো দিন
কিরে কেটে বলছি, এসব করব না আমি।
যদি বা করেই বসি
অন্তত পুলিশের ভ্যানে হ্যান্ডকাফ পরা অবস্থায় নয়
অথবা এমন কোনো শহরের জেল–সেলে বসে নয়
বাড়ি ফেরার সময় যে শহর ডিঙাতেই হয় বলে নামটাই শুধু তার জানি।
হ্যাঁ, জানি হয়তো ঝুঁকিতে আছি খুব
তবু হলফ করেই বলি শোনো—
আমার ঘরের মেঝের নিচে যে শবখেকো কীটের আবাস,
গলা লাশ খুবলে খাওয়া যার নিয়তস্বভাব, তাকেও ঢের বেশি
বিশ্বাস করি আইনের মারপ্যাঁচজীবী সেই অফিসারের চেয়ে—
পুরোহিতের মতো আমার চোখ চিরতরে মুদিয়ে দেওয়া
কিংবা আমাকে যে ধবধবে কাপড় পরিয়ে দেন মা
সে রকম চকচকে কাফনে আমার নিঃসাড় দেহ মোড়ানোই যার কাজ।
বরং আত্মঘাতী হতে হলে সেই পথই বেছে নেব
যেই পথে অধিকাংশ আমেরিকান মরে যায়।
কথা দিচ্ছি সেই পথ বেছে নেব:
মরে যাব সিগারেটে, ধোঁয়ায় ধোঁয়ায়
নয়তো মাংসের টুকরো গলায় আটকে মরে যাব।
অথবা নিকৃষ্টতর শীতের কাঁপানো ঠান্ডায়
জমে মরে যাব।
হলফ করেই বলি শোনো—
যদি শোনো কোনো দিন কোনো পুলিশের আশপাশে মৃত্যু হয় আমার
নিশ্চিত জেনো, আমার ঘাতক ছিল সে-ই।
বুঝে নিয়ো আমাদের মাঝ থেকে সে আমাকে তুলে নিয়ে শবদেহ ফেলে রেখে গেছে।
যতই শেখানো বুলি আওড়ানো হোক
জেনে রেখ ছেলেহারা মায়ের অশ্রুরোধে
এ শহর যে ক্ষতিপূরণ দেবে তার চেয়ে প্রাণহীন সে দেহের দাম অনেক অধিক।
যতই শেখানো বুলি আওড়ানো হোক
জেনে রেখ—
পরত পরত মগজের গহিন থেকে বড়শির আংটায় তুলে আনা
চকচকে বুলেটের জেল্লার চেয়ে পড়ে থাকা সেই দেহ ঢের বেশি সুন্দর।
অমানবিক এই নাগপাশে যেন কোথাও মন থেকে ভালো থাকতে পারছি না, কেউ বুকে হাত রেখে বলতে পারেন আমরা কি সভ্য? গায়ের রঙ আর শরীরের গড়ন আজও সভ্য সমাজের কাছে মনুষত্ব বিচার করে।
পৃথিবী তুমি মুক্ত করো এই অভিশাপ।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours