পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

রেলের বেসরকারিকরণ এবং অন্যান্য অহিতকারী পদক্ষেপ নিয়ে আগের সংখ্যাতেই কিছু আলোচনা করেছি। এবার রেলের আরও কিছু দুষ্টুমির কথা বলি। ট্রেনের (লোকাল বা এক্সপ্রেস) ভাড়া সরাসরি বাড়ালে জনগণের প্রত্যক্ষ নজর পড়তে পারে। তাই ভোট ভিক্ষুক সরকার এখন আর সরাসরি ভাড়া বাড়াতে চায় না। কিন্তু সরকারের মূল লক্ষ্যই যেখানে জনগণের কাছ থেকে যে কোনও উপায়ে বেশি টাকা লুটে নেওয়া সেখানে তারা ভাড়া না বাড়িয়ে দান খয়রাতি চালিয়ে যাবে এটা ভাবাও বাতুলতা। 

বেশ কিছুদিন আগেই চালু হয়েছিল সুপার ফাস্ট কথাটি। রেলের দাবী ছিল ট্রেনগুলিকে সুপার ফাস্ট করে তার যাত্রাসময় কমানো হচ্ছে। এই অজুহাতে প্রায় সবকটি এক্সপ্রেস ট্রেনকেই এক্সপ্রেস থেকে সুপারফাস্টের তকমা দেওয়া হল। তাতে ট্রেনগুলিতে রিজার্ভেশন চার্জের সমান সুপারফাস্ট চার্জও লাগু হল। প্রতিটি ট্রেনেই এই করে ১৫ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত যাত্রী পিছু বাড়তি ভাড়া চাপিয়ে দেওয়া হল। শুধু দূরপাল্লার এক্সপ্রেসগুলিই নয় কাছে পিঠে ১৫০-৩০০ কিলোমিটার যায় যে সব ট্রেনগুলি সেগুলিকেও এই আওতায় এনে ফেলা হল। খাতায় কলমে দেখানো হল ট্রেনগুলিতে কারও ৯ মিনিট কারও ১২ মিনিট কিম্বা কারও ১৫ মিনিট যাত্রাসময় কমানো হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল ট্রেনগুলিতে যা পরিষেবা ছিল যাত্রা সময় থেকে শুরু করে তার স্টপেজসংখ্যা কোনও কিছুতেই তেমন কোনও পরিবর্তন হয়নি। হাওড়া - বোলপুর শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস, হাওড়া - আসানসোল অগ্নিবিনা বা শিয়ালদহ আসানসোল ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস, এই ট্রেনগুলিতে যারা যাতায়াত করেন নিয়মিত তারা জানেন সুপারফাস্ট তকমা লেগে শুধু ভাড়া বেড়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনও পার্থক্য আসেনি। 

ভারতীয় রেলে গরীব মানুষদের জন্য প্যাসেঞ্জার ট্রেন একটা বড় সহায় ছিল। খুব কম ভাড়ায় প্রায় এক্সপ্রেসের মতই বেশ ভাল চলত ট্রেনগুলি। গরিব মানুষ কেন, প্যাসেঞ্জার ট্রেনে যাতায়াত করতেন উচ্চবিত্তরাও। বিভিন্ন রুটে বেশ জনপ্রিয় এই ট্রেনগুলি। এবার সেগুলিও তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেল। ১৭ জুন রেল বিভিন্ন জোনকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে তাদের এলাকায় কোন কোন প্যাসেঞ্জার ট্রেনকে এক্সপ্রেসে উন্নিত করা যাবে তা জানাতে।  দেশজুড়ে চলা প্রায় ৬৫০ টি ট্রেনকে এইভাবেই প্যাসেঞ্জার থেকে এক্সপ্রেসে রূপান্তরিত করে কম ভাড়া থেকে বেশি ভাড়ায় উন্নিত করার চক্রান্ত করা হচ্ছে। এই প্রথাটা অবশ্য বেশ কয়েক বছর ধরেই চলছে। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে। শিয়ালদহ মুজফফরপুর প্যাসেঞ্জার বহুদিনের পুরনো একটি ট্রেন। আমি ছোটবেলাতে ওই ট্রেনে চড়েছি। পরে বছর কুড়ি আগে দুর্গাপুর আসানসোলে থাকার সময়ও ওই ট্রেনে সকালে যেতাম কলকাতা থেকে। স্টপেজ এদিকে একটু বেশি হলেও ব্যান্ডেলের পরে কম তাই ট্রেনটিতে বেশ ভিড় হত। বছর খানেক আগে সেই ট্রেনটি হঠাৎ এক্সপ্রেস করে দেয় রেল। কিন্তু তার পরেও দেখলাম স্টপেজ কিন্তু যা ছিল তাই আছে। সময়ও সামান্য কমেনি, কিন্তু দুর্গাপুরে যেতে ৩০ টাকা ভাড়া ছিল, সেটাই এক্সপ্রেস হওয়ার পরে ৮০ টাকা হয়ে গেল। বুঝতেই পারছেন ৬৫০ টি ট্রেনের ভাড়া এইভাবে বাড়িয়ে দিতে পারলে রেলের কত লাভ? 

লকডাউনের ফলে চলছে না ট্রেন। তাই বলে বসে নেই রেল কর্তা বা আমাদের জনদরদী সরকার। তারা এর মাঝেই একের পর এক জনবিরোধী সিদ্ধান্ত নিয়েই চলেছেন। তা সে রেলের বেসরকারিকরণই হোক বা আমাদের কাছ থেকে যেনতেন প্রকারে বেশি টাকা নেওয়ার বিভিন্ন ফন্দিফিকির বার করা। আজ যারা এর বিরোধিতা করছে কাল তারাই আবার ক্ষমতায় এসে এর চেয়েও বেশি ভাড়া বাড়াবে। আর অসহায় জনতা সহ্য শক্তির মান ও মাপ বাড়াবে। (সমাপ্ত) 



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours