সুস্মিতা পাল, লেখিকা ও শিক্ষিকা, কলকাতা:
ওঁ ব্রহ্মা তৃপ্যতাম্ ওঁ বিষ্ণু স্তৃপ্যতাম্ /ওঁ রুদ্র স্তৃপ্যতাম্ ওঁ প্রজাপতি স্তৃপ্যতাম্।
পিতৃপক্ষের সমাপ্তিতে যে লগ্নে মৃত মানুষদের আত্মারা সমবেত হন, সেই ক্ষণটিই মহালয়। সেই তিথি বা মহালয়ায় আজন্ম পরিচিত সুরটি মিশে থাকে - 'বাজলো তোমার আলোর বেণু, মাতলো যে ভুবন /আজ প্রভাতে সে সুর শুনে খুলে দিনু মন। '
বার্ষিক গতির চাকা ঘুরে চলে, আলোর বেণু বেজে ওঠে শারদ আকাশ জুড়ে, সেই সুরে হৃদয়পুরে দোলা লাগে। পৃথিবী আরো একটু প্রবীণ হয়, মহালয়ার প্রভাতী সুর আবালবৃদ্ধবনিতার কানে ধরা দেয় পরিচিত কন্ঠস্বরে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম শ্রবণে গেঁথে যায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কন্ঠে মহিষাসুরমর্দিনীর স্তোত্রপাঠ।
মহালয়া তিথি শুভাশুভ তার্কিক বিচারের বাইরে যে কারণে হিন্দু ধর্মে গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো তর্পণ। গঙ্গায় তর্পণে মগ্ন উত্তরপুরুষদের ছবি পরের দিনের খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠার অবধারিত মুদ্রণ। এই তর্পণ শব্দটির বুৎপত্তিগত পরিচয় হল - তৃপ্ +অনট। 'তৃপ' ধাতুর অর্থ তৃপ্তিসাধন। দেবতা - ঋষি -পিতৃপুরুষের তৃপ্তিসাধন করাই তর্পণের মূল উদ্দেশ্য। আচার্য বোধায়নের মতে নদীতীরে তর্পণ করাই শ্রেয়। নাভিদেশ পর্যন্ত জলে নিমগ্ন থেকে তর্পণ করা উচিত।
সনাতন হিন্দুধর্মের উদারতার পরিচয় পাওয়া যায় দেবীর দ্বাদশ মৃত্তিকা স্নানে বা বেশ্যাদ্বারমৃত্তিকার আবশ্যকতায়।
'মার অভিষেকে এসো এসো ত্বরা
মঙ্গলঘট হয়নি যে ভরা। '
কি জানি আজ এত দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এসেও মঙ্গলঘট পূর্ণ হয়েছে কিনা! পূর্ণঘট দোরে দোরে শোভা পায়, মঙ্গল দূরেই রয়ে যায়।
মানুষে মানুষে বিভেদ মোচনের সুর দেখি তর্পণে। যারা বন্ধু নয় (শত্রু?) বা বন্ধু অথবা যারা অন্য জন্মে বন্ধু ছিল এবং যারা আমাদের কাছে জলের প্রত্যাশা করে তারা (এই জলে) সম্পূর্ণ তৃপ্তিলাভ করুন।
'যেহ বান্ধবাবান্ধবা বা, যেহন্যজন্মনি বান্ধবাঃ। /
তে তৃপ্তিমখিলাং যান্তু, যে চাস্মত্তোয় কাঙ্ক্ষিনঃ। '
তারপর এই মন্ত্র উচ্চারণ করে তর্পণ সেরে হাইরাইজ কমপ্লেক্সে ফিরে ছুটির দুপুরে মিটিং এ যোগ দিই। তিনটে আলাদা সভা বসে - পুজোও
তো তিনটেই হবে - HIG, MIG, LIG. স্থবিরকের রক্তের সঙ্গে শোণপাংশুর রক্ত মিলেমিশে যায়, কিন্তু অচলায়তনের যুদ্ধ শেষ হয় না।
উন্নতির চাকায় চেপে অনেকদিন চলছি, তবু কোথাও কত মন যে আজও ঘর বন্ধ করে অন্ধকারে ভুল ভেবেছে যে চাকা চলছে, চাকা যে এক জায়গায় স্থির থেকে ঘুরেছে, তা নজর এড়িয়ে গেছে। নয়নধোয়া, হৃদয়হরা আলো যেদিন তাদের ঘরে ঢুকবে, সেদিন হয়ত দৃষ্টিতে সত্যের জ্যোতি প্রকাশ পাবে।
এক বৃদ্ধ পিতাকে দেখেছি একমাত্র পুত্রের অমানবিক ব্যবহার ও় অনাদরে, অযত্নে তিলে তিলে মৃত্যুর কোলে শান্তি পেতে। জীবিত পিতাকে একতিল সেবা না করলেও তর্পণে কিন্তু ভুল হয় না ধার্মিক বলে পরিচিত সেই সন্তানের। মহালয়ার ভোরে আবক্ষ গঙ্গাজলে দাঁড়িয়ে শুদ্ধ উচ্চারণে সে বলে -
ওঁ পিতা স্বর্গঃ পিতা ধর্ম্মঃ পিতা হি পরমন্তপঃ। /পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রীয়তে সর্ব্ব দেবতাঃ।
মন্ত্র তো মনকে ত্রাণ করে। জীবনে যাপনে তাকে পালন করলেই তো যথার্থ ধার্মিক হওয়া যায় বলেই বিশ্বাস করে যারা, তেমন আধুনিক আর কবে হবে সমাজ? মহালয়ার পুণ্যপ্রভাতে নীল আকাশের কথা তাই নীরবই রয়ে যাবে। আনন্দময় ভুবন বাইরের আলোয় ভাসবে। আসুন দুয়ার ভেঙ্গে সবাই সেই আলোয় এসে দাঁড়াই, একসঙ্গে মন্ত্রোচ্চারণ করি -
'ওঁ আব্রাহ্মস্তম্বপর্যন্তং জগৎ তৃপ্যতু ' - ব্রহ্মা থেকে তৃণ পর্যন্ত সমস্ত জগৎ তৃপ্ত হোক।
মহালয়ায় সার্থক হোক পৃথিবীর তর্পণ।
'তোমায় হারা জীবন মম
তোমারই আলোয় নিরুপম -
এই আনন্দযজ্ঞে সবার মধুর আমন্ত্রণ।'
Post A Comment:
0 comments so far,add yours