দেবর্ষি মজুমদার, লেখক, বীরভূম:

পুলিন দাস। মাথায় চুড়ো বেঁধে তীক্ষ্ম নাকে রসকলি কেটে খেলার সাথীকে বলে উঠলো, কিহে মঞ্জরী কি করো?

 আর মঞ্জরী বলে ওঠে, -- তোমায় আঁকছি যতনে অঙ্গে, যতন করে। বৈরাগী বোষ্টম বোষ্টুমীরা যাকে বলে রসকলি। আর অন্যরা বলে তিলক কাটা। সোমবার লাভপুরে প্রকৃতির অঙ্গনে মঞ্চস্থ হলো " রসকলি"।

কোন বাড়ি সুদর্শন পুলিন দাসের বাড়ি, আবার কোনটা  তার খেলার সাথী মঞ্জরীর বাড়ি। মূলতঃ বৈষ্ণব বাড়ির ছবি ফুটে ওঠে ধাত্রী দেবতার অঙ্গনে।  যেখানে গ্রাম্য গেরস্থালি একটি মঞ্চ, সেখানে তৈরি করা মঞ্চ না থাকায় স্বাভাবিক! তবে, ছিল আলো, আবহ সঙ্গীত। সৌমেন মজুমদার, মৌমিতা মুখোপাধ্যায় ও কাজল মুখোপাধ্যায় লাইভে মনমুগ্ধকর বৈষ্ণব পদাবলীতে  মাতিয়ে তোলেন ধাত্রী দেবতাকে।

তবে এই নাটকের উপলক্ষ একটা ছিল। 

 সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনন্য সৃষ্টি ধাত্রী দেবতা! সেই প্রিয় নামেই  নবকলেবরে আত্মপ্রকাশ ধাত্রী দেবতা ভবন।   প্রায় সাড়ে তিরিশ লক্ষ টাকা ব্যয়ে তৈরি করা হয় সাধের মাটির ভবন। হেরিটেজ কমিশনের বরাদ্দকৃত অর্থে বীরভূম জেলা পরিষদ এই ভবনের আমুল সংস্কার করেছে। করোনা আবহ শেষ হলে, এই ধাত্রীদেবতা ভিটে ঘিরে প্রভূত পর্যটন কেন্দ্র গড়ে ওঠার সম্ভাবনার কথা বলছে জেলা পরিষদ। 

বীরভূমের লাভপুরে জন্ম গ্রহণ করেন তারা শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর হাঁসুলি বাঁকের  উপকথা আজও লোকায়ত অন্ত্যজ সমাজকে বাঁচিয়ে রেখেছে। যা আজও অন্ত্যজ মহিলাদের কোমরের হাঁসুলির মত নদীর বাঁকে বাঁকে জীবন্ত হয়ে ওঠে। ‌জানা গেছে, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবার ১৯৯৬ সালে দান করেন লাভপুর পঞ্চায়েত সমিতিকে। ২০১৪ সাল পর্যন্ত ধাত্রী দেবতা ভবন তালাবন্দী ছিল। ঘরের অবস্থা প্রায় ভগ্ন প্রায় হয়ে যায়। ২০১৫ সালে বীরভূম সংস্কৃতি বাহিনী তার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পঞ্চায়েত সমিতির কাছে আবেদন জানায়। দায়িত্ব পাওয়ার পর ২০১৬ সালে একটি সংগ্রহশালার কাজ শুরু হয়। বীরভূম সংস্কৃতি বাহিনীর কর্ণধার উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায় জানান, তার প্রেক্ষিতে বীরভূম জেলা পরিষদ, পঞ্চায়েত সমিতি, তথ্য সংস্কৃতি দপ্তর বা জেলা প্রশাসন তৎপরতা দেখায়। পশ্চিম বঙ্গ সরকারের তরফে ইন্দ্রনীল সেন ও আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের আহ্বানে আসেন এবং একটি অনুদান অর্থ মঞ্জুর করেন। সোমবার সেই ধাত্রী দেবতা ভবনের দ্বারোদঘাটন করেন জেলা পরিষদের মেন্টর অভিজিৎ সিনহা। 

জানা গেছে, ১৯৬৫ সালে পারিবারিক বাটোয়ারা সূত্রে কাছারি বাড়ি পান তিনি। আর সেখানেই তাঁর সারস্বত সাধনা হয়। সাহিত্যিক নিজেই ভবনের নামকরণ ধাত্রী দেবতা। যা তাঁর একটি উপন্যাসের নাম। ২৪০০ বর্গফুটের এই স্মৃতি বিজড়িত ভবনটির অবস্থা শোচনীয় হয়ে ওঠে।  ২০১৮ সালে হেরিটেজ কমিশন ৩০ লক্ষ ৫৮ হাজার ৯৫৮ টাকা বরাদ্দ করে। পুরাতন মাটির বাড়ির আদলকে অটুট রেখে তৈরি হয় কঙ্ক্রিটের ভবন। ধাত্রী দেবতা ভবনের পাশাপাশি, ৫১ সতীপীঠের এক পীঠ ফুল্লরাতলা ও হাঁসুলি বাঁকের উন্নয়ন করা হবে।  এদিন সন্ধ্যায় আনলক ৪ নিয়ম বিধি মেনে খোলা আকাশের নিচে অনুষ্ঠিত হয় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের রসকলি। নাট্যব্যক্তিত্ব উজ্জ্বল বাবু বলেন, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িকেই মূলতঃ গল্পের বিভিন্ন চরিত্রের অনুষঙ্গে সাজিয়ে নেওয়া হয়।  আর বীরভূম সংস্কৃতি বাহিনীর কলাকুশলীরা ফুটিয়ে তোলেন সেই আর্থ-সামাজিক চালচিত্রে অভাব, প্রেম দ্বন্দ্ব সব কিছু। 

নাটকে ফুটে ওঠে, খাড়ো বাধা দেওয়ার প্রসঙ্গ আবার রসিকতাও! মঞ্জরির কণ্ঠে সে অপরুপ হয়ে ওঠে রসিকতার মাধুরীতে-- খাড়ো আমি বাধা দেব কেন গো, ট্যাকা এনে দেবে আমার রসকলি!  মঞ্জরি পুলিনের গোপিনীকে রসকলি পাতিয়ে, তার রসকলিকে পুলিনের হাতে তুলে দিয়ে, তীর্থের পথে পা রাখলো। রসোচ্ছলা মঞ্জরী কোন বাধা মানলো না-- শুধু গানেই সব বলে দিলো- লোকে কয় আমি কৃষ্ণ কলঙ্কিনী, সেই গরবে আমি গরবিনী! পথের ভয় তার নেই, নাকে হাত দিয়ে সে বলে-- সাথে আছে রসকলি!!


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours