ইরানী বিশ্বাস, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, নাট্যকার ও পরিচালক, বাংলাদেশ:
যখন বিখ্যাত মানুষদের নাম শুনি, মনের মধ্যে শ্রদ্ধা আর ভালবাসা জেগে ওঠে। বিখ্যাত মানুষ ক্ষণজন্মা। সব সময় তাঁরা জন্মায় না। তাইতো তাদের কথা ইতিহাসের পাতা জুড়ে রচিত হয়। অতীত ইতিহাসে পড়েছি, বিখ্যাত মানুষ নিজেকে কখনোই মনুষ্য সমাজে প্রচার করতে পছন্দ করতেন না। তাঁরা থাকতেন প্রচার বিমুখ। হয়তো প্রশ্ন আসতেই পারে, তাহলে কি করে তাদের কথা মানুষের কাছে পৌছে গেল? মেধা বা প্রতিভা হলো ফুলের মৌ-এর মতো। এর গন্ধ দূর থেকেই টের পাওয়া যায়। প্রাকৃতিক ভাবে তৈরি এই মৌয়ের লোভে পশু-পাখি, পিঁপড়ে এমনকি মানুষও ছুটে আসে। তাদের কাউকে সংবাদ দিয়ে আনতে হয় না। মৌয়ের লোভে নিজ দায়িত্বে চলে আসে। ঠিক তেমনি মেধাবী মানুষের মেধার খবর এমনিই চারিদিকে প্রচারিত হয়।
আজকাল মানুষের মধ্যে একটা নেশা হয়েছে। নিজেকে বিখ্যাত হিসাবে প্রচার করতে মানুষ এখন অনেক পন্থা অবলম্বন করে। কারো যদি টাকা পয়সা হয়, তখন সে চায় বিখ্যাত হতে। এ কারনে টাকার বিনিময়ে লোক ভাড়া করে নিয়ে যায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। কখনো বা নিজের নামে স্যোসাল মিডিয়াতে পেজ খুলে রাখে। তারপর টাকার বিনিময়ে নিজের সুখ্যাতি প্রচারের কাজ করে। অনেক সভা সমিতিতেও দেখা যায় নব্য রাজনীতিবিদ টাকার বিনিময়ে লোক নিয়ে যায়। তাদের আগে থেকে শিখিয়ে নিয়ে যায়, সেখানে গিয়ে তার নামে কি কি শ্লোগান দিতে হবে। কখনো কখনো কিছু পত্রিকার একাংশ সাংবাদিকদের টাকার বিনিময়ে নিউজ করায়।এভাবে বিখ্যাত হওয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। এ কথা ভাবতে ভাবতে আমার একটি গল্প মনে পড়ে গেল।
একজন ব্যক্তির শখ হয়েছে তিনি বিখ্যাত হবেন। গরীব মানুষ। না আছে মেধা, না আছে টাকা। কিভাবে সহজ উপায়ে বিখ্যাত হওয়া যায়, তা নিয়ে বেশ চিন্তিত। কোন ভাবেই এর সহজ সমাধান আসছে না মাথায়। তিনি মনে করলেন মাথায় অনেক চুল, যাই চুল কাটিয়ে আসি। তাতে যদি মাথার মগজ খোলে। গ্রামের হাটে নাপিতের কাছে তিনি গেছেন চুল কাটাতে। কথায় বলে নাপিতের ষোল চুঙ্গা বুদ্ধি। দেখা মাত্রই নাপিত বুঝতে পারলেন লোকটি কোন বিষয়ে চিন্তিত। তাই লোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন,
- কি বিষয়ে এত চিন্তা করছেন?
- আচ্ছা, সহজ উপায়ে কি করে বিখ্যাত হওয়া যায়?
- এই কথা! এতো খুবই সহজ।
- কিভাবে?
- এক কাজ করো, তোমার শাশুড়িকে পটিয়ে পাটিয়ে বিয়ে কর।
- ধুর এটা কখনো হয় নাকি?
- যা হয় না, তা করলেই তো মানুষ বিখ্যাত হয়।
- সে তো, ভাল কাজ করে সবাই বিখ্যাত হয়েছেন। ইতিহাসে পড়ছি।
- ইতিহাসের যুগের কথা এখন বললে হবে? এটা হলো ডিজিটাল যুগ। এখনকার যুগে, খারাপ কাজ করলেই বিখ্যাত হওয়া যায় সহজে।
কথাটা লোকটার মনে ধরেছে। তাই সময় নষ্ট না করে সোজা চলে গেলো শ্বশুর বাড়ি। শাশুড়িকে পটিয়ে-পাটিয়ে চম্পট দিয়েছে জামাই। নাপিত তো আগে থেকেই জানতো বিষয়টা। তাই দেরি না করে হাটের মধ্যে প্রচার করতে থাকলো, জামাই তার শাশুড়িকে বিয়ে করে পালিয়েছে। মাত্র এক দিনের মধ্যে সারা গ্রাম রটে গেল। তারপর ফেসবুক, অনলাইন পত্রিকা, জাতীয় দৈনিক, টেলিভিশন এমনকি বি^বিসি’র শিরোনাম হলো বিষয়টি।
বর্তমান এমন চিন্তাভাবনা আর মানসিকতার মানুষদের সাথেই আমরা বসবাস করছি। কি করছি, কি ভাবছি সেটা বড় বিষয় নয়। বিখ্যাত হওয়ার নেশায় যেন বুদ হয়ে আছে পুরো জাতি। কয়েকদিন আগে বাংলাদেশের এক জাতীয় দৈনিকে ফটো নিউজ হয়েছে। বোরখা পরা একটি মহিলা, মাদ্রাসায় পড়ুয়া ছেলেকে নিয়ে ক্রিকেট প্রাকটিসে গিয়ে নিজেই ব্যাট হাতে নিয়েছেন। কিছুক্ষণ ব্যাট হাতে ছেলের সাথে জুটি হয়ে ক্রিকেট খেলেছেন। রাতারাতি তিনি স্টার হয়ে গেলেন।
আমার বোরখা নিয়ে কোন আপত্তি নেই। বোরখা ধর্মীয় পবিত্র একটি পোশাক। এই পোশাকের সাথে কেন অমার্যাদা হচ্ছে? বোরখা পরে মানুষ চুরি করে, বোরখা পরে রাতের আধারে সেক্স-ওয়ার্কারা নিজের মুখ লুকায়। বোরখা পরে স্মাগলিং করে। এমন কোন খারাপ কাজ নাই যার সাথে বোরখা ব্যবহার করা হয় না। এখন আবার ক্রিকেট খেলতে নেমেছেন। অথচ একবারও কেউ ভাবলেন না, বোরখা আর ক্রিকেট দুটি দুই মেরুর। এ বিষয়ে অনেকে উৎসাহ দিয়েছেন। একজন জাতীয় দলের ক্রিকেটার সমর্থন করেছেন। কয়েকটি অনলাইন পত্রিকায়, রেডিওতে দেখলাম ইন্টারভিউ দিয়েছেন মহিলা। আগামীতে হয়তো দেখবো বোরখা পরে কেউ হিমালয়ে ওঠার চেষ্টা করবেন। তাঁকে উৎসাহ দিতে হয়তো কোন বিখ্যাত হিমালয় জয়ী এগিয়ে আসবেন। আবার হয়তো কেউ বোরখা পরে সাঁতার কাটবেন। বা কেউ অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার স্বপ্নও দেখবেন। ধর্মীয় পবিত্র পোষাকের যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে নিজেকে বিখ্যাত হওয়ার জন্য হয়তো কেউ বিকিনি পরে মন্দিরেও প্রার্থনা করতে যাবেন। বিখ্যাত হওয়ার লোভ সামলানো এত সহজ নয় কি না!
এখানেই থেমে নেই মানুষ। বাংলাদেশে অশালীন শিরোনামের এক গান দিয়ে মাত্র এক সপ্তাহে রেকর্ড পরিমান ভিউ হয়েছে। সেটা নিয়ে খুব চর্চা হচ্ছে।আজকাল অশালীণ শিরোনামের গান, নাটক, সিরিজ ইউটিউবে বিলিয়ন, মিলিয়ন ভিউ হয়। এই ভিউ হিসাব করেই নিজেরা নিজেদের সার্টিফিকেট দিচ্ছেন অশালীণ কর্মকান্ডের সাথে জড়িত মানুষজন। তারপর নিজেরাই প্রচার করছেন তারা বিখ্যাত। নিজের নামের আগে কারো অনুমতি ছাড়াই নিজেরা বিখ্যাত তকমাটা লাগিয়ে নির্লজ্জের মতো ঘুরে বেড়ায়।
পৃথিবীতে আলোচিত মানুষ দুই প্রকার। এক হচ্ছে সুনামে বিখ্যাত। আর এক দুর্নামে বিখ্যাত। আমরা সুনাম আর দুর্নামের তফাতটা ভুলতে বসেছি। শুধু বিখ্যাত শব্দটাই মনে রেখেছি। তাইতো ইউটিউবে ভিউকে মেধার মাপকাঠি হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ভিউ দিয়ে যদি সফলতা নির্বাচন করা হতো, তাহলে পর্ন স্টাররা সবচেয়ে বেশি সফল বা বিখ্যাত তকমাটা গায়ে লাগাতে পারতো। কারণ ইউটিউবে সবচেয়ে বেশি এবং রেকর্ডকৃত ভিউ হয় পর্ণ ভিডিও।
যুগ সত্যি বদলে গেছে। আগে পর্ণ স্টাররা সমাজের অন্ধকারে লুকিয়ে থাকতো। আর এখন সমাজ প্রমোট করে পর্নস্টাররা। হয়তো এ কারণে বর্তামান সময়ে একজন মিয়া খলিফা, একজন সানি লিওন সবচেয়ে জনপ্রিয় মডেল। তাদেরকে এ সময়ের সবচেয়ে মানবিক মানুষ হিসাবে ধরে নেওয়া হয়! পর্ন মুভির টাকায় সমাজ সেবা করছেন কি না? হয়তো তাদের দেখে উৎসাহিত হয়ে সকলেই প্রথমে পর্ন স্টার হবেন, তারপর কিছু ভাল কাজ করে সুপারস্টার হয়ে যাবেন। দেশের আইন-আদালতে কি বলে আমি ঠিক জানি না। তাদের দেখানো পথ অনুসরণ করতে গিয়ে যদি কেউ মানুষ খুন করে। আর তারপর সমাজের কিছু অবহেলিত শিশুদের জন্য অনাথ আশ্রম খুলে দেন। আর অনাহারী মানুষদের অর্থ-খাদ্য দান করেন, তাহলে তো তার অপরাধ মাফ করার কথা। এ জন্য হয়তো আইনের পরিমার্জন হবে। হয়তো একদিন পৃথিবী থেকে আদালতই উঠে যাবে।
জানি না যুগটা এখন কিসের উপর ভর করে চলছে। চারিদিকের এসব অসহ্য অদ্ভুত ঘটনা দেখে মাঝে মাঝে মনে হয়, সময়টা কি এখন নাপিতের বুদ্ধি আর প্রচারের উপর ভর করেই চলছে?
Post A Comment:
0 comments so far,add yours