পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

পেট্রোলের দর প্রতি লিটারে ২৫.২১ টাকা ( পচিশ টাকা একুশ পয়সা) এবং ডিজেলের দর প্রতি লিটারে ২৮.৩৫ টাকা ( আটাশ টাকা পয়ত্রিশ পয়সা)। ভুল পড়েননি, আমাদের দেশে, হ্যা ভারতবর্ষে এটাই এখন পেট্রোল ডিজেলের দর। এই দরেই পরিশোধিত তেল পাম্পে পাঠায় রাষ্ট্রায়ত্ব তেল সংস্থাগুলি। এটা ১ আগস্ট ২০২০-র দর। এবারে আসি ফোঁড়েদের কথায়, আপনারা এতদিনে সকলেই জেনে গিয়েছেন যে বাজারে প্রায় প্রতিটি জিনিসই ফোঁড়েদের হাত হয়ে আসে। যাদের আমরা ভালবেসে মধ্যসত্বভোগী বলে উপাধী দিয়েছি। এক্ষেত্রে অবশ্য ফোঁড়ে বাইরের কেউ নয় আমাদের অতি দরদী, বিবেচক, জনগণপ্রাণা সরকার। না শুধু একটা সরকার নয়, এখানে দুটি সরকার সমান ভাবে জনগনকে তেল দিয়ে রক্ত শোষে।

কেন্দ্র প্রতি লিটারে এক্সাইজ ডিউটি, রোড ট্যাক্স সহ নানা ট্যাক্স বসিয়ে পেট্রোলে নেয় প্রায় ৩৩ টাকা এবং ডিজেলে নেয় প্রায় ৩২ টাকা। এবার এর উপরে ৩০% ভ্যাট চাপিয়ে দেয় রাজ্য সরকার। সেখান থেকে তাদের প্রাপ্তি এখন যা দর তাতে প্রায় ১৯ টাকা প্রতি লিটারে। এখানেই শেষ নয়, এরপর থাকে পাম্প মালিকদের কমিশন যা প্রতি লিটার পেট্রোলে  ৩.৬০ টাকা( তিন টাকা ষাট পয়সা) ডিজেলে ২.৫৩ টাকা (দুই টাকা তিপ্পান্ন পয়সা)। এবারে সব যোগ করে দিন, সংখ্যাটা আশির উপরে নিচে ঘোরাফেরা করবে। অর্থাৎ মাঝে সরকার নামের ফোঁড়ে না থাকলে ওই তেল আমরা মোটামুটি তিরিশ টাকার মধ্যেই পেয়ে যেতাম। উপরের নানা অংক থেকে বুঝতেই পারছেন সরকার আমাদের কথা কত দরদ দিয়ে গভীরে গিয়ে ভাবে।   

এটা ১ আগস্টের দর, এখন তো আরও বেড়েছে এই দরের পরিমান কারন দুই সরকারই আরও কর বসিয়েছে। তথ্য বলছে জ্বালানি তেল বিক্রিতে বিশ্বের সব চেয়ে বেশি শুল্ক নেয় ভারত, ৬৯%। অন্যান্য প্রায় সব সভ্য এবং উন্নত দেশই এই শুল্ক তাদের জনগণের কাছ থেকে নেয় না। লকডাউনের কারনে যখন অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেল প্রতি শুন্য টাকারও নিচে চলে এসেছিল তখনও আমাদের সরকার নীরব ছিল। ভুল বললাম নীরব  ছিল না, চুপি চুপি পেট্রলে ১৩ টাকা এবং ডিজেলে ১৬ টাকা মত উৎপাদন শুল্ক বাড়িয়ে দিয়েছিল। এতে আমাদের তেলের দাম অপরিবর্তিতই থেকেছে। অর্থাৎ বাইরে থেকে প্রায় বিনা পয়সায় তেল আনলেও আমরা তার কোনও সুফল দেখতেই পাইনি।

কোনও দল বা সরকার এক্ষেত্রে কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। বিরোধীরা সামান্য কুম্ভীরাশ্রু নিক্ষেপ করবার মত লোক দেখানো প্রতিবাদ করেছে বটে, কিন্তু তার কোনওটাই সত্যি নয় সেটা আজ প্রমাণিত। কারন তেল থেকে রাজস্ব আদায়ের এই সহজ পথ কেউই ছেড়ে দিতে চাইছে না। আমাদের অতি জনদরদি প্রধান মন্ত্রী বা পরম প্রিয় মুখ্যমন্ত্রী, সকলেই চুপ। ছন্নছাড়া বিরোধীরা নাটক করে চলেছে। তেলকে জিএসটির আওতায় আনার ব্যাপারে কি রাজ্য, কি কেন্দ্র সকলেই স্পিকটি নট। যে মমতা জনগনের ভাল ছাড়া ভাবতেই পারেন না, তিনিও এ নিয়ে টুশব্দটি কাড়েননি। কারন জিএসটির আওতায় চলে এলেই যে তেলের দাম এখনকার প্রায় অর্ধেক হয়ে যাবে!

একটা বড় অংশের সাধারণ মানুষের ধারণা যে তেলের দাম বাড়লে বড়লোকদের সমস্যা, যাদের গাড়ি আছে তাদের সমস্যা। কিন্তু কথাটি একেবারেই সঠিক নয়।  বড়লোকদের, যাদের গাড়ি আছে তাদের বাড়তি কিছু টাকা দিয়ে তেল কেনার সামর্থও হয় তো আছে। কিন্তু তেলের দাম বাড়লে গরীব বা মধ্যবিত্তদের গায়ে ছ্যাঁকা লাগে সব চেয়ে বেশি।  তেলের দাম বৃদ্ধি মানেই বাজারে প্রায় সব জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়া। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে বাসের ভাড়া সহ প্রায় সব পরিষেবার খরচ। অর্থাৎ গরীব মানুষ পড়েন সবচেয়ে বিপদে। এখন তেলের দাম আকাশ ছোঁয়া। বাজারে গেলেই তার আঁচ পাবেন। আমপানের জন্য সবজির দাম কিছুটা বেড়েছিল, প্রায় দেড় মাস পেট্রোল ডিজেলের দাম বাড়ায় প্রায় কোনও সবজিই এখন পঞ্চাশ টাকার নিচে নয়।

করোনা, চিন, সুশান্ত সিং রাজপুত, আমপানের ত্রাণে বিক্ষোভ নিয়েই আমরা বেজায় ব্যস্ত। কিন্তু তার মাঝে একটু একটু করে বাড়তে বাড়তে তেলের দাম আশি পেরিয়েছে তা আমাদের নজরে আসেনি। খবরের কাগজের ভিতরের পাতায় ছোট্ট করে প্রকাশিত হয়, ভাল ভাবে চোখেই পড়েনি। কিন্তু গত বছরে যে ঝিঙে এই সময় কুড়ি টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছিল, সেই ঝিঙে এ বছরে এখন ষাট টাকা কেজি বিক্রি হলে নজরে আসে বৈকি।

কে কি ভাবে প্রতিবাদ করবেন জানি না।  কিন্তু এর একটা বিহিত হওয়া জরুরী। আমি এই লেখা লিখেছি, আমার প্রতিবাদ হিসেবে। বিরোধীদলের কাছ থেকে কিছু আশা করবেন না, আজ যারা বিরোধী আগামীতে তারাই হয় তো সরকার, তাই তাদের প্রতিবাদ নাটক মাত্র। তেলের দাম বাড়লে ইউপিএ আমলে বিজেপি এমন নাটক বহু করেছে, আজ যেমন কংগ্রেস করছে। ফলাফল শূন্যই। প্রতিটি সরকার মনে করে মানুষের কোনও বক্তব্য নেই, মানুষ পিপড়ের মত কীট মাত্র। তাদের ডলে পিষে দিলেও কিছু বলবে না, একটু ছত্রভঙ্গ হবে মাত্র। একটু পরে ফের সারিবদ্ধ হয়ে রাষ্ট্রের নির্দেশ মতই চলবে।  তাই তো ২৪ টাকার তেল আমাদের কিনতে হয় ৮২ টাকা দিয়ে, রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনায়।  কিছু বলার আগেই রাষ্ট্র আমাদের ভুলিয়ে দেয়, ওই দেখ পাকিস্তান, চিন আসছে সব কেড়ে নেবে কিন্তু, আমরাও সব ভুলে হ্যাট হ্যাট করে চিনের দিকে ধেয়ে যাই। মাঝ খান থেকে নেপোয় মারে দই।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours