ইরানী বিশ্বাস, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, নাট্যকার ও পরিচালক, বাংলাদেশ:

ক্রাইম অর্থাৎ অপরাধ। আজকাল কানপাতলে অপরাধের খবর হরহামেশা শোনা যায়। আগের তুলনায় যত দিন যাচ্ছে তত বেশি অপরাধ এবং অপরাধীর সংখ্যা বাড়ছে। নিত্য নতুন কৌশল অবলম্বন করে অপরাধী তার অপরাধ ঘটাতে সক্ষম হচ্ছে। এই অপরাধ প্রকাশ হলে আমরা অপরাধীকে ধিক্কার দিই। অপরাধীর অবাক করা অপরাধের ঘটনা যখন সামনে আসে, আমরা সভ্য তকমা দেওয়া মানুষগুলি আঁৎকে উঠি। যতক্ষন না কোন মানুষ অপরাধ করে ধরা পড়ছে ততক্ষন সে ধোয়া তুলসিপাতা। অনেক সময় দেখা যায়, একজন অপরাধী আজ ধরা পড়লো। সে বিষয়ে অন্য কেউ নানা রকম জ্ঞানের বুলি আউড়ে চলল। হয়তো কিছুদিন পর সেই মহাজ্ঞানীও অপরাধী হয়ে মানুষের সামনে চলে এলো। এ ঘটনা আমাদেরই চারপাশে অহরহ ঘটতে দেখি। কখনও কি মনে প্রশ্ন জেগেছে, দিন দিন কেন মানুষ এত অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠেছে?

জন্মগত ভাবে কোন শিশুই অপরাধী হয়ে জন্মগ্রহণ করে না। একটি শিশুর বেড়ে ওঠার পরিবেশ তাকে অপরাধী করে তোলে। যে কোন বয়সে যে কেউ অপরাধ করতে পারে। কয়েকটি কারনে শিশু অপরাধী হতে পারে। নির্যাতন, ঘৃনা, তাচ্ছিল্য, ভালবাসাহীন, অযত্ন অবহেলায় বেড়ে ওঠা শিশুরা অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে।  অবাধ স্বাধীনতা পেলেও মানুষের মধ্যে অপরাধের জন্ম হয়। 
অনেক সময় ব্যস্ত পরিবারের শিশু, অর্থাৎ মা-বাবা দুজনেই হয়তো কর্মজীবী। এমন পরিবারের শিশুরা সাধারণত মা-বাবাকে খুব বেশি কাছে পায় না। আবার অনেক মা-বাবা মনেই করে না সন্তান বড় করতে তাদের মায়া-মমতা যত্ন দরকার। কাজের মানুষ বা পরিবারের অন্য যে কেউ দেখা শোনা করতে পারে। তারপরও মা-বাবার উচিত সন্তানকে একান্ত সময় দেওয়া। সে যত ব্যস্তই হোক না কেন। এ ক্ষেত্রে দেখা যায় মা-বাবার দৃষ্টি আকর্ষন করতে সন্তান অনেক সময় ছোট, ছোট অপরাধ করে। হতে পারে ঘরের দামি শোপিস ভেঙ্গে ফেলল, মা-বাবার দামী ঘড়ি, চশমা ভেঙ্গে ফেলল, অফিসের দরকারী কাগজ নষ্ট করে ফেলল। এ রকম যদি কখনো লক্ষ্য করে থাকেন, তাহলে তাকে শাসন করার আগে একবার নিজেকে প্রশ্ন করেন, সন্তানকে কি আপনি পর্যাপ্ত সময় দেন? যদি আপনি সন্তানের এই খারাপ কাজের অর্থ না বুঝে যদি তাদের সঙ্গে আরো নির্মম ব্যবহার করেন, তাহলে পরবর্তীতে সে আরো বড় কোন অপরাধ করতে পারে। তবে এই ঘটনা যদি স্বাভাবিক পরিবারের শিশুদের ক্ষেত্রে ঘটে থাকে, তবে অতি সত্ত্বর সংশোধন করবেন। তা না হলে পরবর্তীতে সে ধারাবাহিকতা বজায় রেখে অপরাধ করতেই থাকবে। 
শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। তাদের সামনে যা করবেন, সে সেভাবেই বেড়ে উঠবে। অনেক পরিবারের শিশুরা তাদের ঘনিষ্ঠজনদের অপরাধ করতে দেখে। ছোটবেলা থেকে এই অপরাধ দেখে বড় হওয়া শিশুরা অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য এগুলো হলো ষড়রিপু। অর্থাৎ এই ৬টি দোষ আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই থাকে। এদের দমন করতে প্রয়োজন আত্মসংযম বা সেল্ফ কন্ট্রোল। মানুষ নিজের মধ্যে থাকা এই দোষগুলিকে কন্ট্রোল করতে ব্যর্থ হলে এক একটি অপরাধের জন্ম হয়। অনেক সময় দেখা যায় ছোটবেলার সুন্দর ভদ্র শিশুটি বড় হয়ে অপরাধী হয়ে গেল। এর কারন অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, হয়তো মানুষটি খুব কাছের কাউকে অপরাধ করতে দেখেছে। এবং সে অপরাধ করে সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে। তখন সেই মানুষটির মধ্যে লোভ কাজ করে। এবং নিজে একই প্রক্রিয়ায় অপরাধ করে সুবিধা নিতে উৎসাহিত হয়। আবার অনেক সময় দেখা যায়, কোন অপরাধী দিনের পর দিন অপরাধ করেও ধরা পড়ছে না। এ বিষয়টাও মানুষকে অপরাধে উৎসাহীত করে। 
উনবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত ফরাসি ঔপন্যাসিক এবং নাট্যকার মনরে দ্যা বালজাক বলেছেন, প্রত্যেকটা ঐশ্বর্য্যের পেছনে রয়েছে এক একটি অপরাধ। বর্তমান সময়ে ঐশ্বর্য্য বা ক্ষমতার লোভ মানুষকে অপরাধী করে তুলতে উৎসাহিত করেছে। যার যত সম্পদ তার তত ক্ষমতা। এটা যেন প্রবাদ বাক্যে পরিণত হয়েছে। অর্থ দিয়ে বর্তমান সময়ে সব করা সম্ভব, এমন এক অযৌক্তিক ধারনা থেকেই ক্রমাগত অপরাধের জন্ম হচ্ছে। একটু পেছনে তাকালে দেখতে পাই, প্রতিভাবান মানুষগুলি ছিলেন নির্মোহ, নির্লোভ। কাজী নজরুল গরীব ঘরে জন্ম নিয়েও অর্থের পেছনে ছুটতেন না। অন্যদিকে জমিদার পুত্র মাইকেল মধুসুধন দত্ত বিত্ত ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। বর্তমান সময়ে প্রেক্ষাপট বদলে গেছে। এখন মানুষ মনে করে একমাত্র বিত্তবানেরই অধিকার রয়েছে সব ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার। অর্থের বিনিময়ে পরীক্ষার প্রশ্ন পাওয়া, পছন্দের বিষয়ে ভর্তি হওয়া, সরকারী চাকরি পাওয়া, অবৈধ প্রপোজাল পাশ করানো, সমাজের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ন পদ বা পদবীর অধিকারি হওয়া, এমনকি গুরুত্বপূর্ন জাতীয় পুরস্কার লাভ করা সম্ভব। আবার অর্থের বিনিময়ে অন্যের লেখা ছড়া, গল্প, উপন্যাস, নাটক নিজের নামে প্রচার করা। এমনকি অন্যের নির্মিত নাটক নিজের নামে প্রচারিত করা সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রায়ই দেখা যায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোষ্ট করা অন্যের লেখা হুবহু তুলে নিজের নামে পোষ্ট করছে অনেকে।  দিনের পর দিন কোন বাঁধা বিঘ্ন বা প্রতিবাদ ছাড়া এই অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত অপরাধীদের দেখে অনেকেই উৎসাহিত হচ্ছেন। আবার অপরাধী ধরা পড়লে প্রিন্ট বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতে ফলাও করে অপরাধীর অপকর্মের কৌশল প্রচারিত হয়। কিন্তু কোন অপরাধীর রিমান্ডের চিত্র বা শাস্তির যথাযথ নিউজ কোথাও প্রচারিত হয় না। যার কারণে অপরাধীরা অপরাধ করার কৌশল শিখে তা প্রয়োগ করতে উৎসাহিত হয়। কিভাবে অপরাধ করেছে তা প্রচার না করে যদি সরাসরি রিমান্ডের দৃশ্য বা শাস্তি বিষয় নিয়ে আলোচনা বেশি হতো। সংবাদের টকশো হিসাবে  বেশি বেশি আলোচনা হতো। তাহলে অপরাধ করার আগে মানুষ একবার হলেও চিন্তা করতো। বর্তমান মিডিয়া নিউজের নামে অপরাধের কৌশল প্রচার করতে ব্যস্ত। এসবই সমাজে অপরাধপ্রবনতা বেড়ে যাওয়ার পেছনে যথেষ্ট কারণ নয় কি!

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours