সুব্রত দাম, ফিচার রাইটার, দুর্গাপুর:

আমাদের ভারতবর্ষে স্বাধীনতা এসেছে আজ থেকে ৭৪ বছর আগে। তবুও আজ একটা প্রশ্ন বার বারই মনের মধ্যে ঘোরাঘুরি করে, সত্যিই কি আমরা স্বাধীন? চলুন, আজ না হয় আমরা এই স্বাধীনতা দিবসে একটু ফ্ল্যাশব্যাকে যাই।দেখে আসি সত্যিই কেমন ছিল সেই স্বাধীনতা...

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪০ সালের মাঝামাঝি ব্রিটেনের তখনকার প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল ভারতবর্ষে একটি প্রতিনিধি দল  পাঠিয়েছিলেন। সেই দলটির নাম ছিল "ক্রিপস মিশন"। কিন্তু তাতে কোন লাভ হয়নি।

যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ক্লিমেন্ট অ্যাটলি যখন লেবার পার্টির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী হন তখন তিনি ১৯৪৬ সালের ১৫ই মার্চ ভারতবর্ষে একটি কেবিনেট মিশন পাঠানোর কথা ঘোষণা করেন। যে কেবিনেট মিশনটি তিনজন মন্ত্রী দিয়ে গঠিত হবে। যারা ভারতবর্ষে এসে বিভিন্ন দলের সঙ্গে পরামর্শ করে ভারতবর্ষকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব  স্বাধীনতা দেয়া যায় সেই চেষ্টাই করবেন।

কিন্তু তখনকার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টলির কথায় মুসলমানদের পাকিস্তান দাবির কথা কোথাও নাকি উল্লিখিত ছিল না । বরং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দাবিকে তিনি সে সময় কটাক্ষ করেছিলেন।

মিস্টার অ্যান্টলির এই বক্তব্যে কংগ্রেস কিছুটা হলেও সন্তোষ প্রকাশ করলেও মহম্মদ আলি জিন্না সেই বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেন।

২৩শে মার্চ ওই কেবিনেট দলটি ভারতবর্ষে এসে পৌঁছানোর পর যে বিবৃতি গুলো সবার সামনে তুলে ধরেছিলেন, তাতে মুসলমানরা খুব বিচলিত হয়ে উঠেছিল। 

তখন শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালিন অবিভক্ত বাংলার যুব নেতা। তিনি এবং কিছু  মুসলিম লীগের তরুণ রাজনৈতিক নেতারা দলবলে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কাছে যেতেন। এই সোহরাওয়ার্দী ছিলেন তখন পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ও মুসলিম লীগের সিনিয়র নেতা।

শেখ মুজিবুর রহমান সহ বাকি যুব নেতারা সোহরাওয়ার্দীর কাছে জানতে চান যে বিবৃতির ব্যাপারটা নিয়ে কি হবে? সে সময় সোহরাওয়ার্দী  তাদের শান্ত ভাবে উত্তরে বলেছিলেন "ভয়ের কোন কারণ নেই, পাকিস্তানের দাবী ওদের মানতেই হবে"।

এরপর ১৯৪৬ সালের ৭, ৮, ও ৯ই এপ্রিল মুসলিম লীগের নেতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ দিল্লিতে  সমগ্র ভারতবর্ষের মুসলিম লীগপন্থী কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যের নিয়ে একটি কনভেনশন ডাকেন।

তখন সমগ্র ভারতবর্ষে মোট ১১টি প্রদেশ ছিল। যার মধ্যে চারটি ছিল মুসলমান সংখ্যা গরিষ্ঠ প্রদেশ। এই চারটি প্রদেশের মধ্যে কেবলমাত্র বাংলাতে এককভাবে মুসলিম লীগ সরকার গঠন করতে পেরেছিল।

এরপর মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর আহ্বানে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী দিল্লি যাওয়ার জন্য  একটি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করতে বলেছিলেন। যে ট্রেনটির নাম রাখা হয়েছিল 'পূর্ব পাকিস্তান স্পেশাল' যেটি কলকাতার হাওড়া থেকে ছেড়ে দিল্লিতে পৌঁছেছিল।

শেখ মুজিবুর রহমান ও তার দশ-পনেরো জন ছাত্র নেতা বাংলা থেকে সেই কনভেনশনে যোগ দেবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। পুরো ট্রেনটিকে ফুল আর মুসলিম লীগের পতাকা দিয়ে মুড়ে ফেলা হয়েছিল। কনভেনশনের খবর ছড়িয়ে পরতেই ভারতবর্ষের মুসলমানদের মধ্যে বাংলায় মুসলিম লীগের জয়ের খবর একটা বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।

'মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ জিন্দাবাদ ', 'মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ", 'পাকিস্তান জিন্দাবাদ', 'শহীদ সোহরাওয়ার্দী জিন্দাবাদ' ধ্বনির মধ্যদিয়েই ট্রেন ছেড়ে দিল হাওড়া থেকে দিল্লির উদ্দেশ্যে।

কলকাতা থেকে শুরু করে দিল্লি পর্যন্ত বিভিন্ন স্টেশনে কাতারে কাতারে মানুষ জড়ো হয়েছিল তাদের প্রিয় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে একবার চোখের দেখা দেখার জন্য। প্রতিটি স্টেশনেই অগনতি মুসলমান 'শহীদ সোহরাওয়ার্দী জিন্দাবাদ' এবং 'পাকিস্তান জিন্দাবাদ' বলে শ্লোগান দিতে থাকে।প্রতিটি স্টেশনে ট্রেনটি থামার কারণে দিল্লি পর্যন্ত পৌঁছাতে প্রায় আট ঘন্টা দেরি হল।

এরপর নানা ধরনের ঘটনার মধ্য দিয়েই দিন অতিক্রান্ত হতে লেগেছিল।

১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্ট মুসলিম লীগের নেতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ হঠাৎ ঘোষণা করেন   'ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে', বা 'প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস' হিসেবে একটি দিন শান্তিপূর্ণভাবে পালন করা হবে। এই দিনটি পালনের আসল উদ্দেশ্য ছিল তিনি ব্রিটিশ সরকার ও কেবিনেট মিশনকে দেখাতে চেয়েছিলেন  যে গোটা ভারতবর্ষের দশ কোটি মুসলমান ওই পাকিস্তানের দাবিতে তারা বদ্ধপরিকর। 

ঠিক হয় ১৬ই অগাস্ট কলকাতার গড়ের মাঠে ওই সভাটি অনুষ্ঠিত হবে। সে জন্য ওই দিনটিকে সরকারি ছুটি হিসেবেও ঘোষণা করা হয়েছিল। ঠিক হয়েছিল কলকাতার মুসলমান ছাত্ররা সকাল দশটার সময় ইসলামিয়া কলেজে জড়ো হবে এবং সকাল সাতটায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলিম লীগের পতাকা উত্তোলন করা হবে। সেই কথা মতো শেখ মুজিবুর রহমান ও নূরউদ্দিন সাইকেলে করে গিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পতাকা উত্তোলন করে এলেন। এরপর তারা ইসলামিয়া কলেজে ফিরে এসে দেখেন কিছু ছাত্র রক্তাক্ত অবস্থায় সেখানে পৌঁছায়। 

এই খবর ছড়িয়ে পরতেই বিভিন্ন জায়গায় মুসলমানদের উপর হিন্দুদের আক্রমণ শুরু হয়ে যায়। মুসলমানরা এই দাঙ্গার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না । সেদিনের মতো ব্যপারটা মিটে যাওয়ার ঠিক দুদিন পর মুসলমানরাও হিন্দুদের উপর আক্রমণ করে। ওয়েলিংটন থেকে শুরু করে ধর্মতলা পর্যন্ত দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়।এদিকে কলকাতার দাঙ্গা শেষ না হতেই আবার দাঙ্গা শুরু হয়ে যায় নোয়াখালীতে। সেখানে মুসলমানরাও হিন্দুদের ঘরবাড়ি লুট করে তাতে আগুন ধরিয়ে দিতে লাগল। এই দাঙ্গা চলাকালীন বিহারেও শুরু হয় মুসলমানদের উপর আক্রমণ। এভাবেই চলতে থাকে হিন্দু আর মুসলিমের দাঙ্গা। মুসলমানদের একটাই দাবি পাকিস্তান তাদের দিতে  হবে। তবে এই দাবিটা ছিল ব্রিটিশ সরকারের কাছে।

নানা অস্থিরতা, চড়াই উতরাই এবং আলোচনার মধ্য দিয়ে শেষমেশ ১৯৪৭ সালের জুন মাসে ভারতবর্ষকে ভাগ করার ঘোষণা এল। যেহেতু কংগ্রেস এই ভারতবর্ষকে ভাগ করতে রাজি হয়ে গিয়েছিল তাই পরবর্তীতে বাংলা ও পাঞ্জাবও ভাগ হয়ে ছিল। আসামের সিলেট জেলা ছাড়া আর কিছুই পাকিস্তানের ভাগে আসে নি। তখন  কলকাতা ও তার পাশর্বর্তী জেলা গুলি ভারতেই অন্তর্ভুক্ত ছিল। এতে মাওলানা আকরাম খাঁ এবং ওই অঞ্চলের অন্যান্য মুসলিম লীগের নেতারা তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। ভারতবর্ষ ভাগের এই ফর্মুলা কোন মুসলিমই মন থেকে মেনে নিতে পারে নি।কারণ তাদের ধারণা ছিল সমগ্র বাংলা ও আসাম পাকিস্তানের মধ্যে আসবে।

কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান জানতে পারলেন যে আসামের সিলেট জেলাটি পাকিস্তানের আওতায় তখনই আসবে যখন তারা সেটা গণভোটের মাধ্যমে জিততে পারবে।

এদিকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী পক্ষ থেকে বাংলা সরকারের অর্থমন্ত্রী জনাব মোহাম্মদ আলী ঘোষণা করেন যে কলকাতা তাদের রাজধানী হবে।

এ সময়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল  হাশিম মুসলিম লীগের তরফ থেকে এবং শরৎ বসু ও কিরণ শংকর রায় কংগ্রেসের তরফ থেকে এক আলচনা সভায় সিদ্ধান্ত নেন যে বাংলাদেশ ভাগ না করে অন্য কোন পন্থা অবলম্বন করা যায় কি-না? এর জন্য বাংলাদেশের কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতারা একটা সমঝোতা সূত্র ঠিক করেন।

কি সেই সমঝোতা সুত্র ?

এই সুত্রটি হল বাংলাদেশ হবে একটা স্বাধীন স্বার্বভৌম রাষ্ট্র। জনগনের ভোটের মাধ্যমে তৈরি হবে একটা গণপরিষদ। ঐ গণপরিষদই ঠিক করবে বাংলাদেশ হিন্দুস্তান না পাকিস্তানে যোগদান করবে। নাকি সেটা স্বাধীন থাকবে। গণপরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যেদের ভোটের মাধ্যমে সেটি নির্ধারিত হবার বিষয়টি ওই সুত্রতে উল্লিখিত ছিল ।

এই সুত্র নিয়ে শরৎ বসু গান্ধীর সাথে আর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে দেখা করতে যান। এই ফর্মুলাতে জিন্নাহ সাহেবের অবশ্য কোন আপত্তি ছিল না।

অন্যদিকে ব্রিটিশ সরকার বলে দিয়েছিল যে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ একমত না হলে তারা নতুন কোন ফর্মুলা মানতে পারবে না।

কলকাতা পূর্ব পাকিস্তানের অংশ না হওয়ায় শেখ মুজিবুর রহমানের মনে গভীর হতাশা তৈরি হয়েছিলো। এজন্য তিনি অবশ্য মুসলিম লীগ নেতৃত্বের একটি অংশকেই দায়ী করেন। তিনি মনে করতেন যে পাকিস্তান সৃষ্টির সাথেই ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়ে গিয়েছিল।কারণ সে সময় শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে সরিয়ে খাজা নাজিমুদ্দিন ক্ষমতায় বসার ষড়যন্ত্র শুরু করেছিলেন।

কিন্তু কেন করা হয়েছিল সেই ষড়যন্ত্র?

কারণ শেখ মুজিবুরের মনে করতেন বাংলাদেশ ভাগ হলে তারা যতটুকু পাবে তাতেই সিন্ধু, পাঞ্জাব, সীমান্ত প্রদেশ ও বালুচিস্তানের মিলিত লোক সংখ্যার চেয়ে পূর্ব পাকিস্তানের লোকসংখ্যা হবে অনেক বেশী। তিনি এও মনে করেন যে সোহরাওয়ার্দীর যা ব্যক্তিত্ব, যা রাজনৈতিক জ্ঞান, যা বিচক্ষণতা,যা কর্মক্ষমতা তাতে তিনিই ভবিষ্যতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চাইবেন । যাকে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা কারো থাকবে না।

এক পর্যায়ে খাজা নাজিমুদ্দিন নেতা হিসেবে নির্বাচিত হন। নেতা হয়েই তিনি ঢাকাকে রাজধানী ঘোষণা করেন এবং তিনি তার দলবল নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। নাজিমুদ্দিন ঢাকায় আসার সাথে সাথেই কলকাতার উপর থেকে পাকিস্তানের আর দাবি উঠে গেল।

ইংরেজরা তখনও ঠিক করে নি যে কলকাতা আদৌ পাকিস্তানে আসবে নাকি তা হিন্দুস্তানে থাকবে। আসলে কলকাতা দখলের জন্য হিন্দু ও মুসলমানরা লড়ার জন্য প্রস্তুত। এর জন্য যে কোন সময়ে দাঙ্গা বেদে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে গেছিল। কলকাতা হিন্দুস্তানে পড়লেও শিয়ালদহ স্টেশন পর্যন্ত পাকিস্তানে আসার সম্ভাবনা ছিল।

লর্ড মাউন্টব্যাটেন সুযোগ বুঝে যশোর জেলায় সংখ্যাগুরু মুসলমান অধ্যুষিত বনগাঁ জংশন অঞ্চল কেটে দিলেন। নদীয়ায় মুসলমানের সংখ্যা বেশি ছিল তবুও কৃষ্ণনগর ও রানাঘাট জংশনকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করে দেয়া হয়।

শুধু তাই নয় মুর্শিদাবাদ, মালদহ, দিনাজপুর, বালুরঘাট, দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলা গুলি কেও ভারতে অন্তর্ভুক্ত করে দেয়া হয়।

এভাবে বাংলাদেশকে ভেঙে দেওয়াটা শেখ মুজিবুর রহমান মন থেকে মেনে নিতে পারেন নি। তিনি এটাও ঠিক মেনে নিতে পারেন নি যে, যে কলকাতা পূর্ব বাংলার ঢাকায় গড়ে উঠেছিল সেই কলকাতাকেই তাদের স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিতে হয়েছিল। কারণ তিনি মনে করেন কেন্দ্রীয় লীগের কিছু কিছু লোক এই কলকাতা যে ভারতে চলে যায় সেটা তারাও মন থেকে চেয়েছিল।

শেখ মুজিবুর রহমান মনে করতেন যে সোহরাওয়ার্দী নেতা হলে মুসলিম লীগেরই অসুবিধা হত, তাই তারা পিছনের দরজা দিয়ে কাজ হাসিল করতে চেয়েছিল। কারণ কলকাতা পাকিস্তানে থাকলে পাকিস্তানের রাজধানী কলকাতাতে করতে বাধ্য হত। কারণ তদানীন্তন ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ শহর ছিল এই কলকাতা।

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট। অর্থাৎ আজকের দিনেই শেখ মুজিবুর রহমানকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল।

তার লেখা "অসমাপ্ত আত্মজীবনী"তেও তিনি কলকাতা "হাতছাড়া" হওয়ার কথা লিখে গিয়েছিন। সেখানে তিনি একটা লাইনে লিখেছেন "নেতারা যদি নেতৃত্ব দিতে ভুল করে, জনগণকে তার খেসারত দিতে হয়।"

(তথ্যসূত্র: বিবিসি) 


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours