সুব্রত দাম, ফিচার রাইটার, দুর্গাপুর:

"খোঁপার ওই গোলাপ দিয়ে-

মনটা কেন এত কাছে আনলে?

পারবে কি বাসতে ভালো আমাকে জানলে?

আমাকে তেমন করে জানলে?"

১৯৮৫ সালে তরুণ মজুমদারের পরিচালনায় ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরারোপিত বিখ্যাত ছবি ভালোবাসা ভালোবাসা বইটির এই গানটা একবার শুনলে গুনগুনিয়ে নেয় না বা নেন নি এমন মানুষ মেলা ভার। আপনারা যারা পাঠক তারাও আজ একবার এই গানটাকে মনে মনে ঝালিয়ে নেবেন এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

"প্রেম বড় মধুর কভু কাছে কভু সুদূর" প্রেমহীন মানুষ এ পৃথিবীতে কজন আছেন যাদের জীবনে একবারও প্রেম আসে নি, সে সোজা পথেই হোক বা বাঁকা পথে। আসলে কি বলুন তো প্রেমের কোন বয়স হয় না, হয় না কোন জাত। তাই প্রেম নীরবে কখন কি ভাবে আসে তা বোঝা বড়ই দায়। আট থেকে আশি প্রত্যেকেই প্রেমে পরতে পারেন। যদিও আজকাল একটা গান খুব কানে ভাসে "প্রেমে পরা বারণ কারণে অকারণ আঙুলে আঙুল লাগলেও হাত ধরা বারণ"। আচ্ছা বলুন তো প্রেম করবে আর কাছের মানুষটির কাছে যাবে না এমনটি কখনো হয়? আজকের জেনারেশন অন্তত এটা মানে বলে আমার মনে হয় না। এখন তো দেখি তাদের প্রেমের রাখঢাকটা খুবই কম। তারা সবার সামনে নির্ধিধায় বলতে পারে "বেশ করেছি প্রেম করেছি করবোই তো"।

প্রেমের কথা বা প্রেমের গান শুনলে প্রথমেই যে ফুলটির কথা আমাদের সবারই মনে পড়ে তা হলো গোলাপ। আর গোলাপের চাহিদা যে কতটা হতে পারে তা তো আমরা ফেব্রুয়ারি মাস এলেই বুঝতে পারি। তখন এক প্রেমিক তার কাছের মানুষকে একটি গোলাপ কিনে দিতে একবারও পকেটের দিকে ফিরেও তাকায় না। তখন নানা রঙের দেশি বিদেশি বাহারি গোলাপ কিনতে সকলেই ব্যস্ত। 

আজ আলোচনায় যখন গোলাপের প্রসঙ্গ উঠলই, তখন চলুন, আজ আমরা এই গোলাপ সম্পর্কে কিছু অজানা তথ্য বরং জানি।

ফরাসী শব্দ "গোলাপ "( Rose) যার উৎপত্তি ল্যাটিন শব্দ "রোজা"(Rosa) থেকে। ল্যাটিন ভাষায় কাউকে আদর করে ডাকা হত 'রোজা' বলে। যার অর্থ ভালোবাসা। তাই গোলাপ নামটির মধ্যেই একটা রোমান্টিক ব্যাপার স্যাপার ঢুকে আছে। তাই গোলাপ আধুনিক মানুষের কাছে সৌন্দর্য ও ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে সমাদৃত। গোলাপ হল ফুলের রানী। পৃথিবীতে প্রায় ১০০ প্রজাতির বিভিন্ন বর্ণের গোলাপ ফুল রয়েছে। যেমন কাঠগোলাপ, লাল গোলাপ, সাদা গোলাপ, কালো গোলাপ।

গ্রীক উপকথায় আছে প্রেমের দেবী 'ভেনাস' এর পায়ের রক্ত থেকে নাকি গোলাপের জন্ম। আবার হিন্দু পৌরাণিক কাহিনীতে আছে বিষ্ণু ব্রহ্মাকে পদ্ম-ই শ্রেষ্ঠ ফুল বললে ব্রহ্মা বিষ্ণুকে স্বর্গে নিয়ে সেখানে হালকা রঙের একটি সুগন্ধি গোলাপ দেখান। গোলাপ সম্বন্ধে এইরকম নানান গল্প আছে।

গোলাপের রঙ ও গন্ধের জন্য তার চাহিদা বরাবরই। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে মোঘলদের হাত ধরে আসা বড় আকারের লাল, সাদা, গোলাপি রঙের গোলাপই আমাদের প্রথম  চোখে পড়েছে। আমরা তো বিভিন্ন রঙের গোলাপ সচরাচর সবাই দেখে থাকি, কিন্তু আমরা কি কখনো কালো গোলাপ চোখে দেখেছি? আমার মনে হয় না আমি কখনো বাস্তবে তা দেখেছি। তবে এই নেট দুনিয়ার সুবাদে কালো গোলাপ দেখেছি বহুবার।

আশাকরি এই কালো গোলাপের প্রতি আমাদের প্রত্যেকেরই একটা আলাদা আকর্ষণ আছে। "কালো গোলাপ" এই নামটা শুনলেই আমরা কেমন যেন আকৃষ্ট হয়ে পরি। তখন বাস্তবে দেখতে ইচ্ছে করে। বাজারে বাহারি রঙের গোলাপ দেখেও যেন তখন মন ভরে না। আমরা তখন ঐ কালো গোলাপকেই খুঁজি।

দীর্ঘদিন ধরে কালো গোলাপের অস্তিত্ব নিয়ে নানান বিতর্ক চলে আসছে। বিভিন্ন দেশের উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা কালো গোলাপ উৎপাদনের জন্য গবেষণা করে চলেছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন উদ্ভিদবিজ্ঞানীই সফল হতে পারেননি। তবে ব্যতিক্রমী তুরস্কের হালফেতি গোলাপ। প্রাকৃতিক ভাবে এই প্রজাতির রঙটা এতটাই গাঢ় যে এখন একেই সবাই স্বপ্নের কালো গোলাপ বলতে শুরু করে দিয়েছে।

তুরস্কের ফোরাত বা ইউফ্রেটিস নদীর পূর্ব উপকূলে সানলুরফা প্রদেশের হালফেতি জেলা এখন বিখ্যাত হয়ে উঠেছে এই কালো গোলাপের জন্য। গোলাপের এই জাতকে কেন্দ্র করে ওখানকার বাসিন্দারাও বলছেন ওই প্রজাতিটি খুবই বিরল। সাধারণত বসন্ত কালে পুরনো হালফেতি গ্রামে এই "কালো গোলাপ" ফোটে। প্রথমে এই ফুলটির রঙ থাকে গাঢ় লাল। তবে গ্রীষ্মকাল যত এগিয়ে আসে ততই এই গাঢ় লাল রঙ আরো গাঢ় হয়ে কালো হতে শুরু করে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন হালফেতির প্রাকৃতিক বিশুদ্ধতা ও উর্বর মাটি আর ভূগর্ভস্থ জলে দ্রবীভূত হাইড্রোজেনের আধিপত্যের কারণেই এখানকার গোলাপ কালো রঙ ধারণ করে। তবে প্রাকৃতিক পরিবর্তনের কারণে হালফেতির এই কালো গোলাপ এখন ক্রমশ বিপন্ন প্রজাতিতে পরিণত হচ্ছে।

১৯৯০ সালের দিকে ওই অঞ্চলে ইউফ্রেটিস নদীর উপর বাঁধ নির্মাণের জন্য হালফেতির বাসিন্দারা গ্রাম ছেড়ে আরো ১০ কিলোমিটার ভেতরে সরে যায়। ফলে গোলাপ চাষ ভীষণ ভাবে বাধাগ্রস্ত হওয়ায় এখন হালফেতির গোলাপ শুধু বিলুপ্তির অপেক্ষায়। নতুন হালফেতিতে কৃষকরা আবার ওই কালো গোলাপের বাগান করলেও সেই গোলাপ প্রজাতিটি ওই নতুন পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে পারে নি। তাছাড়া উৎপাদনও ফলপ্রসূ হয় নি।

আসলে তুরস্কের এই "হাফেটি রোজ" (Halfeti Rose) যেটা আমদের খালি চোখে দেখে কুচকুচে কালো বলে মনে হয় তা আসলে কালচে গাঢ় লাল রঙের।

ও হ্যাঁ, আর একটা কথা, আপনাদের মতে একটা গোলাপের বাজার মূল্য কত হতে পারে বলে মনে হয়? ১০ টাকা, ২০ টাকা, ৫০ টাকা, ১০০ টাকা?

এখন যে গোলাপটির কথা আপনাদের বলব তার দাম কত হতে পারে বলে আপনাদের মনে হয়? জানেন কত দাম? কল্পনা আছে?

গোলাপ প্রজননের জন্য বিখ্যাত 'ডেভিড অস্টিন'। যিনি ২০০৬ সালে  জুলিয়েট নামে এ পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে দামি গোলাপটি চাষ করেন। এটি আবিষ্কার করতে তার সময় লেগেছিল ১৫ বছর এবং ব্যয় হয়েছিল ৫ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৪০ কোটি টাকা। ভাবুন তবে একটা গোলাপের দাম কত!



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours