সজল বোস, সমাজকর্মী, দুর্গাপুর:

আচ্ছা আজ তো রোববার থুড়ি রবিবার মানে Sunday.

মানে সবাই বুঝলেন ক্যালেন্ডারে লাল রঙের জ্বলজ্বল করছে মানে ছুটির দিন, কি মজা তাই না! 

সম্পূর্ণ চাপ মুক্ত কর্মদিবস, স্কুল কলেজ থেকে বেশীর ভাগ কার্যক্ষেত্রে বিরাম, তাই ঘরেই হবে আরাম। কোথাও তো আবার শনি রবি দুই দিনই ছুটি। 

কিন্তু কেন রবিবার ছুটি? কি তার ইতিহাস? কবে থেকে তা চালু হলো? জানার ইচ্ছা থাকলে পড়তেই হবে এই লেখাটি। আর কেমন লাগলো সেটা জানাতে হবে।

আচ্ছা ভাবছেন তো এসবের কি দরকার, আরে বাবা কাল না হয় পরশু যদি কেউ প্রশ্ন করে বা আপনার সন্তান জানতে চাই তাহলে ঝটপট করে ওফ নিউজ খুলে তথ্য দিতে পারবেন... তাহলে সুবিধা হলো আর ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষিত হয়ে রইলো। যাক প্রসঙ্গে আসি... 

আসলে রবিবার ছুটির বিষয়টা ভারতে চালু হয় সরকারিভাবে ১৮৪০ সাল থেকে। রবিবারকে সপ্তাহের ছুটির দিন ঘোষণা করা হয়। আসলে ছুটির দিন বলে কিছুই ছিলো না। ছুটি নিলে ছুটি, না নিলে নয়। 

 ভারত যখন ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ছিল, ভারতের মিল শ্রমিকদের সপ্তাহের সাত দিন ধরে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছিল। তারা বিশ্রাম নিতে কোনও ছুটি বা কোনও ধরণের ছুটি পাননি। ব্রিটিশ আধিকারিকেরা ও শ্রমিকরা প্রতি রবিবার গির্জায় যেতেন এবং তাদের নামাজ পড়তেন, যদিও ভারতীয় মিল শ্রমিকদের জন্য এ জাতীয় কোনও রীতি ছিল না। 

সেই সময়ে নারায়ণ মেঘাজি লোখন্দে মিল শ্রমিকদের নেতা ছিলেন, তিনি ব্রিটিশদের সামনে একটি সাপ্তাহিক ছুটির প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “ছয় দিন কঠোর পরিশ্রম করার পরে শ্রমিকদের তাদের দেশ ও সমাজ সেবার জন্য একটি দিন পাওয়া উচিত। রবিবার হিন্দু দেবতা ‘খান্দোবা’ দিবস। তাই রবিবারকে ছুটি হিসাবে ঘোষণা করা উচিত ”। কিন্তু ব্রিটিশ কর্মকর্তারা তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। কিন্তু দীর্ঘ্য ৭বছরের আন্দোলনের ফলে আজকের এই সফলতা। 

ঐতিহাসিক জিম মাসেলোস বলছিলেন কীভাবে এ দেশে রবিবার ছুটির দিনের চল হয়। তাঁর কথা অনুযায়ী শুরুর দিকে ব্রিটেনের মতোই রবিবার মুম্বইতে (তখনকার বম্বে) ছুটির দিন ঘোষণা করার জন্য বেশ কিছুদিন আলোচনা হয়। সেই সময় যে ব্রিটিশ সরকারের রাজত্ব এ দেশে, তাদের কর্তাদের মধ্যেই মতানৈক্য হয়। একদল চাইছিলেন যাতে ব্রিটেনের মতোই এ দেশেও ছুটির দিন ঘোষণা করা হয় রবিবারকে। যেভাবে খ্রীস্টানরা করে থাকেন আর কী। কিন্তু আরেক দলের বক্তব্য ছিল, বম্বেতে নানা ধর্মের মানুষের বাস। তাই তাঁরা শুধুমাত্র রবিবারকেই সপ্তাহের ছুটির দিন হিসেবে ভালোভাবে নাও মেনে নিতে পারেন। শুরুর দিকে তো ব্রিটিশ অনেক শাসকরাই চাননি সপ্তাহের একদিন অর্থাত্‍ মাসের চার দিনের টাকা শুধুশুধু কর্মীদের দিতে। কিন্তু পরের দিকে তাঁরা অর্ধেক টাকার বিনিময়ে এই ছুটি মেনে নেন। আর রবিবারই ছুটির দিন ঘোষণা হয়ে যায় ভারতে। তাই আজ আপনি ছুটির দিনে বাড়িতে।

রবিবারের ছুটিতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি ছোট থেকেই। কিন্তু সপ্তাহের মধ্যে এই দিনটিই কেন ছুটি ভেবে দেখেছেন? আজ রবিবারকে কেন সারা বিশ্ব জুড়ে সরকারী ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে তার পিছনে আকর্ষণীয় কারণটি আমরা আজ এক নজরে নেব। এর পিছনে রয়েছে খ্রিস্টধর্মের প্রভাব। বাইবেলের  মতে ৬ দিন ধরে পৃথিবী সৃষ্টি করে ঈশ্বর ষষ্ঠ দিনে বিশ্রাম নিয়েছিলেন। 

তাই রবিবারকে বিশ্রামের দিন বলে খ্রিস্টধর্মে গণ্য করা হয়। ওইদিনই চার্চে বিশেষ ‘মাস’ থাকে এবং ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টানরা যাতে রবিবার নিয়ম করে চার্চে যেতে পারেন, সেই কারণেই খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী ইওরোপের দেশগুলিতে প্রথম চালু হয় রবিবারের ছুটি। 

আধুনিক যুগের গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার খ্রিস্টধর্ম দ্বারা প্রভাবিত। তাই রবিবার দিনটিকেই ছুটির দিন হিসেবে চিহ্নিত করা হয় লাল রঙে। আর স্বভাবিক ভাবে ভারত ব্রিটেনের উপনিবেশ ছিল বলেই এদেশে চালু হয় রবিবারের ছুটি। 

কিন্তু ছুটি তো চালু হলো এটা কি সরকারী নির্দেশিকা মেনে? তার জন্য কি আইন আছে? 

কিন্তু মজার বিষয় হল স্বাধীন ভারতে ‘রবিবারের ছুটি’ নিয়ে কোনও নির্দেশনামা কখনও ঘোষণা হয়নি। এমন কোনও সরকারি বিজ্ঞপ্তি কখনও জারি করা হয়নি, যেখানে বলা হয়েছে যে রবিবার এদেশের সরকারি ছুটির দিন। এই বিষয়ে জম্মুর একজন অ্যাক্টিভিস্ট রমন শর্মা একটি আরটিআই বা রাইট টু ইনফরমেশন কেস ফাইল করেন। 

সেখানে তিনি প্রধানমন্ত্রীর দফতরের কাছে জানতে চান যে এই বিষয়ে কোনও নোটিস কখনও জারি করা হয়েছিল কি না? 

উত্তরে ভারত সরকারের ডিপার্টমেন্ট অফ পার্সোনেল অ্যান্ড ট্রেনিংয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে এমন কোনও নথি নেই যেখানে রবিবারকে এদেশের সরকারি ছুটি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

নাও বোঝো ঠ্যালা.. কি সর্বনাশা কথা... দেদার ছুটি কাটিয়ে গেলো ১৬০ বছর ধরে আর কিনা কোন সরকারী বিজ্ঞপ্তী নেই?

সেই সঙ্গে ১৯৮৫ সালের ২১ মে ওই ডিপার্টমেন্ট থেকে জারি হওয়া একটি বিজ্ঞপ্তি উদ্ধৃত করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে লেখা ছিল যে ৩ জুন, ১৯৮৫ থেকে সরকারি অফিসগুলিতে সোমবার থেকে শুক্রবার অর্থাৎ সপ্তাহে পাঁচদিন কাজ হবে এবং শনিবার অফিস বন্ধ থাকবে। 

আশ্চর্যজনকভাবে রবিবারের কোনও প্রসঙ্গই ওই বিজ্ঞপ্তিতে তোলা হয়নি। তার অর্থ দাঁড়ায় এই যে রবিবারকে সরাসরি ছুটিও বলা হয়নি আবার অন্যদিকে বলা হয়েছে যে সোমবার থেকে শুক্রবার দফতরের কাজ হবে। 

এমনই এক ধোঁয়াশার মধ্যেই কিন্তু স্বাধীনতার পরে এতগুলি বছর এদেশে ‘রবিবারের ছুটি’ অনেকটা ‘টেকেন ফর গ্রান্টেড’ হয়ে গিয়েছে। তবে স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার বহু শাখা রবিবার দিন খোলা থাকে। আবার বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় একটি সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি হওয়া সত্ত্বেও রবিবার খোলা থাকে। বিশ্বভারতী বন্ধ থাকে বুধবার। শোনা যায় এই ব্যবস্থাটি স্বয়ং বিশ্বকবির নির্দেশে শুরু হয় যা এখনও বজায় রয়েছে।

পৃথিবীর বহু দেশ রবিবার দিনটি ছুটি হিসেবে গণ্য করে না। বিশেষ করে ইসলামিক দেশগুলিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শুক্রবার ও শনিবার ছুটি থাকে। শুক্রবারের নমাজ ইসলামে খুবই গুরুত্বপূর্ণ তাই ওইদিনটিকে ছুটি দেওয়া হয়। মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলিতে রবিবার হল সপ্তাহের প্রথম কাজের দিন। 

সব মিলিয়ে কিন্তু এদেশে রবিবারের ছুটিকে একটি ‘হ্যাবিট হলিডে’ বা ‘অভ্যাস ছুটি’ বলা যায়। 

বাংলাসহ বেশিরভাগ দক্ষিণ এশীয় ভাষায়, রবিবার, ভানুবার বা আদিত্যবার শব্দটি বারের নাম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ভানুবার, আদিত্যবার বা রবিবার শব্দ তিনটির উৎপত্তি ও অর্থ একই যেখানে বার অর্থ দিবস এবং আদিত্য, রবি ও ভানু হলো সূর্যের পৃথক সম্বোধনসূচক নাম অর্থাৎ সূর্য ও সূর্যদেব প্রধান সৌর দেবতা এবং আদিত্যগুলির মধ্যে একটি। রবিভরকে প্রথম দিন জ্যোতিষায় উদ্ধৃত করা হয়েছে, যা প্রতি সপ্তাহের দিনটির নাম দেওয়ার যৌক্তিক কারণ সরবরাহ করে। থাইল্যান্ডের থাই সৌর ক্যালেন্ডারে একে বলা হয় ওয়ান আর্থিত যা কি-না আদিত্য থেকে উদ্ভূত। বাংলা ও থাই উভয় বর্ষপঞ্জিতে রবিবারের প্রতীকী রং হলো লাল।

সপ্তাহের একটি দিন, শনিবারকে প্রথম দিন ধরে হিসাব করলে এটি দ্বিতীয় দিন হিসেবে গণ্য হয়। এটি শনিবার ও সোমবারের মধ্যবর্তী দিবস। ইহুদিদের ধর্মীয় বর্ষপঞ্জিকা অনুসারে এবং কিছু খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের কাছে এটা সপ্তাহের প্রথম দিন। কারণ তাঁদের কাছে শনিবার হলো সপ্তাহের শেষ দিন এবং প্রার্থণা দিবস। পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে রবিবারকে সপ্তাহের শেষ দিন গণ্য করা হয়। এদিন খ্রিস্টানদের ক্যাথলিক গির্জায় সাপ্তাহিক ধর্মীয় উপাসনা অনুষ্ঠান হয়। কারণ বাইবেলের বর্ণনানুযায়ী রবিবার হলো মৃত্যুর পর যিশুর প্রত্যাবর্তনের দিবস।

বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই রবিবার হলো ছুটির দিন। তবে বেশিরভাগ মুসলিম রাষ্ট্রসমূহে রবিবার কর্মদিবসের অন্তর্ভুক্ত।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours