দেবর্ষি মজুমদার, লেখক, বীরভূম:

"তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না, করে শুধু মিছে কোলাহল"। রবীন্দ্রনাথের কথা কেহ বলে না, এটা আমাদের আত্মোপলব্ধি। কিন্তু মিছে কোলাহল? কোলাহল মিছে হতে পারে। তবে মিছি মিছি নয়। আমরা হরলিক্স বয় নই, যে আমরা এমনি এমনি খাই! 

বর্তমান শিক্ষিত মাম্মি, ড্যাডিদের বলি, দেখো- কেমন বাড়ছি, আমরা! 

বিশ্ব ভারতীতে যেভাবে ভুবন ডাঙার মাঠে গেটটি পেলোডার দিয়ে  ভাঙা হলো,  ইমারতি দ্রব্য লুঠ হলো, সেটাও নাকি মানুষের ক্ষোভ, জনরোষ ইত্যাদি! এরাও নাকি রবীন্দ্র ঐতিহ্য রক্ষায় সামিল হয়েছিলেন! 

যেটুকু জানি, তাতে মেলার মাঠ বিশ্ব ভারতীর নয়, শান্তি নিকেতন ট্রাস্টের। তাছাড়া, মেলার মাঠ কোন হেরিটেজ সাইট নয়। তাই ঐতিহ্যের প্রশ্নে মেলা আসতে পারে, মাঠ নয়।

 পুরানো মেলার মাঠ অবশ্যই হেরিটেজ সাইট। যে মেলার মাঠ নিয়ে বিতর্ক, সেটা ১৯৪৬-৪৭ সালে মজুমদার পরিবারের কাছ থেকে কেনা। এই মেলার মাঠে পাঁচিল যে একেবারেই নেই তা কিন্তু নয়। মাঠের পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে দুটো পাঁচিল আছে। যাদের উচ্চতা যথাক্রমে ৬ ফুট করে। তার উপর অবশ্য কিছুটা তারকাঁটা আছে। 

এখন স্বাভাবিক ভাবেই একটা প্রশ্ন উঠে আসে, ৭ অগাস্ট, কবির প্রয়াণ দিবস থেকে মাত্র ১০ দিনের মাথায় এমন ভাঙচুরের ঘটনা কেন ঘটলো? 

প্রথম পক্ষ অবশ্যই মামলা ও বিশ্ব ভারতী।  দ্বিতীয় ব্যবসায়ী ও ক্ষুব্ধ আশ্রমিকদের একাংশ।  আদর্শ, ঐতিহ্য এগুলো যদি শুধু মাত্র কলার মতো বিমূর্ত হতো, লেঠা চুকে যেত। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর ২০ বছর পর, সময়ের প্রয়োজনে বড় মেলার মাঠের প্রয়োজন হলো। এত বড়ো মেলার মাঠে মেলা হলে, তার দায়িত্ব, ট্রাস্ট ও বোলপুর পুরসভার। কারণ পুরসভা তথা সরকার ট্যাক্স নেয় ট্রাস্টের কাছ থেকে। পুলিশ ও প্রশাসন ছাড়া এই মেলা সম্ভব নয়।  এতদিন যেভাবে মেলা হতো, সেভাবে হলে, ব্যবসায়ী থেকে কোন পক্ষের সমস্যা হয় নি, হতো না। কিন্তু দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধি এক স্বাস্থ্যকর  বাধ্যতামূলক পরিস্থিতি। যেটা কোন পক্ষ ঠিক ঠাক মানতে পারে নি। তাই শাসন দণ্ড হাতে উপাচার্য, এমনটাই অভিযোগ। উনি নরমে গরমে যেভাবেই আসুন না কেন, ব্যর্থ হতে হয়েছে। মামলার সংখ্যা বেড়েছে। তাই তাঁর কাছে মেলা আক্ষরিক অর্থেই-- "কম্বলি নেহি ছোড়েগা"।

কিন্তু আমরা যারা বুড়ো ঠাকুরের নামে একটু রিল্যাক্স করতে যায়, একদিনের আউটিং হয়, হোটেলে খানা পিনা হয়, তা ছাড়বো কেন? প্রশ্ন উঠবেই- - ব্যবসাটা দেখলেন না? রবীন্দ্রনাথ সবার! গ্রামীণ অর্থনীতি এখন কলোনিয়াল হাব।

 একটু পিছনে দেখা যাক। ২০০৪ সাল।  উপাচার্য সুজিত বসু। সুজিত কুমার বসু সেন্ট্রাল অফিসের পিছনে পাঁচিল দিয়ে ঘিরে ছিলেন বলে, সবাই তাকে পাঁচিল কাকু বলতো। আর এখন বর্তমান উপাচার্য। তাঁকে কে কেউ কেউ বলছেন জেল কাকু। কি সমাপতন! 

কিন্তু অতীতে যে এমনটা হয় নি, তা নয়।  পাঁচিলের পাঁচালি লিখতে গিয়ে সহকর্মী ও দাদা গোপাল চট্টোপাধ্যায়ের একটি পোস্ট থেকে জানতে পারলাম, শান্তিনিকেতনে  প্রথম কাঁটাতারের বেড়া শুরু হয়েছিল ১৯৭২ সালে। প্রতুল গুপ্ত সেই সময় বিশ্বভারতীর দায়িত্বে ছিলেন। নকশাল আন্দোলন  চলছিল। গৌড় প্রাঙ্গণের উল্টোদিকে তখন শিক্ষা ভবনের কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল গ্রন্থাগার। প্রয়োজন  হয়ে পড়েছিল কলাভবন সংগীত ভবনের ছাত্র ছাত্রীদের নিরাপত্তা দেওয়া।তৈরি হয়েছিল কাঁটাতারের বেড়া। উপাচার্য রজত কান্তি রায়ের আমলে একই ভাবে, এণ্ড্রুজ পল্লী, ফর্টিফাইভ  সুরুচিপল্লী বালিডাঙ্গা,বিনয় ভবনের পিছনে পাঁচিল তোলা হয়। যথারীতি পাঁচিল নিয়ে বিতর্ক বাঁধে। ইউজিসির নির্দেশ সমস্ত কেন্দ্রীয় বিদ্যালয় তার নিজস্ব সম্পত্তি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সীমানা ঘিরে ফেলতে চায়। প্রায়ই  নয় ফুট  পাঁচিল উঠেছিল। আশ্রমিকরা প্রতিবাদ করেছিলেন রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়েই। তাই আশ্রমে মূল বিতর্ক ভিত্তি বিভিন্ন সময়ে-- ১) পাঁচিল- ফেন্সিং, ২) পাঁচিল ও ৩) ফেন্সিং। 

সেটার কারণ, মোটামুটি চর্বিত চর্বণ। আর একটা উদাহরণ দিয়ে বলি,  বিশ্বভারতীর কেন্দ্রীয় অফিসে এক সময় বহিরাগতদের হাতে রেজিস্টার সুনীল সরকারের উপর আক্রমণের পর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের চারপাশে জন্ম নিয়েছিল চার ফুটের পাঁচিল তার উপর ফেন্সিং।  উপাচার্য সুশান্ত দত্তগুপ্ত উপাসনা গৃহের উল্টোদিকে পুরনো মেলার মাঠ ঘিরে ফেলেন ফেন্সিং দিয়ে। 

এখন প্রশ্ন মেলার মাঠ উন্মুক্ত রাখা ও না রাখা। মেলা চলাকালীন টিন দিয়ে ঘেরা হয়, সেটা অস্থায়ী। যদি আগে থেকে ফেন্সিং করা হয়, তাহলে কি ক্ষতি?

সেটা আমাদের বুঝতে হবে। পরিবেশ আদালত শুধুমাত্র ডিমারকেশন বলে নি। বলেছে ব্যারিকেডের কথা। যদিও তা স্থায়ী বা অস্থায়ী কিনা, তা বলা নেই। যাইহোক, মেলার মাঠ ফেন্সিং হলে, কার কার অসুবিধা, সেটা বুঝতে পারলে, বোধগম্য হবে, কোলাহল মিছে নয় মোটেই। শান্তি নিকেতন থানা, বিশ্ব ভারতীর জায়গায়। থানার উল্টো দিকে মেলার মাঠের জায়গা। কোন ভি আইপি, শান্তি নিকেতনে এলে, পুলিশ জমায়েত ও তার পরে ওখান  থেকেই পুলিশ পাঠানো হয়। তাছাড়া এরকম জায়গা বোলপুরে আর কোথাও নেই। ওখানেও ঘেরার কাজ শুরু হয়েছিল। তাই মাঠ ঘেরা হলে পুলিশের অসুবিধা হবে, বুঝতে অসুবিধা থাকার কথা নয়। পুলিশের শতাধিক গাড়ি সেই পরিস্থিতিতে মাঠ ব্যবহার করে। তাই পাঁচিল ভাঙা নিয়ে ফোন ধরতে তাঁদের মন সায় দেওয়ার কথাও নয়। 

একবার পূর্ণ দাস বাউল ও দিবাকর কুণ্ডুর ১৫ ফুট জমির বাগান উদ্ধার করে বিশ্ব ভারতী। তা নিয়ে হৈচৈ হয়। ঐতিহ্য ছুটে আসে। এটা নয় যে, আশ্রম কন্যারা অবসরের পর থাকতেন না। সেটা রবীন্দ্র প্রবর্তিত ঐতিহ্যই। অমিতা সেনের মত আশ্রমিকরা সেই নিয়মেই থাকতেন। তবে সেক্ষেত্রে যে বাসভবন দেওয়া হতো, সেটা একতলা, বাংলো টাইপের। অবশ্যই নিঃশুল্ক ও শর্ত সাপেক্ষে লিজ দেওয়া। কিন্তু তা হস্তান্তরযোগ্য বা বিক্রয় যোগ্য নয়। কেউ না থাকলে, বিশ্ব ভারতী তা দখল নেবে। এখন যাঁদের ছেলে মেয়েরা বিদেশে আছেন, তাঁরা এটা হাতছাড়া করতে চাইছেন না। সাবলিজে অধিকার টিকিয়ে রাখতে চাইছেন। তাই একাংশের সাথে বিশ্ব ভারতীর দ্বন্দ্ব আছেই। সেখানেই ঐতিহ্য খতরে মে! টাইম ইজ রাইপ নাও।  তাই কামড়ে ধরো।

ভাবার দরকার আছে কী কেন ভুবন ডাঙার গেট ভাঙলো? সেটাও তো প্ররোচণা। নিখাদ জনরোষ। কিঞ্চিৎ মিশ্রিত রবীন্দ্র আবেগের ককটেল। অবাক হবো না, যদি গান গেয়ে গৃহস্থের ঘরে এসে সুর করে কোন শিক্ষিত তস্কর বলে, "খোল খোল দ্বার! রাখিও না আর"!  অভ্যর্থনা করবেন তো! 

এখন একটু ভেবে দেখুন!  ভুবন ডাঙার বড় গেট ভাঙার কারণ একটা আছে। কারণ এই গেট থাকলে পর্যটকরা ক্ষুদ্র কুটির শিল্পের স্টল, যেগুলো শ্রীনিকতনের মুখ বা ট্যুরিস্ট বাজারে মণিষার মুখ পর্যন্ত যেতে পারছে না। কোন খদ্দের ওখানে যেতে পারছে  না। তাই ওই গেট ভাঙা দরকার ছিল। বড় গেট ভাঙা হলে, পর্যটকদের জন্য "পে এণ্ড ইউজ"  শৌচালয়ের  ব্যবহার করা যাবে। ব্যবসায়ী সমিতির নিজস্ব শৌচালয় নেই। এখন তারা সহজেই শৌচ কর্ম সারতে পারবেন।

টোটকা দিই-  গলাটা একটু ভিজিয়ে নিয়ে গান না মশাই, দেখবেন একদম কোঁৎ মারতে হবে না- গান---

"একদিন যারা মেরেছিল তাঁরে গিয়ে 

                       রাজার দোহাই দিয়ে 

                 এ যুগে তারাই জন্ম নিয়েছে আজি,

                 মন্দিরে তারা এসেছে ভক্ত সাজি"–-

                 সত্যি,      কেউ কিচ্ছুটি বলবে না। 

জানেন তো, রবীন্দ্র ঐতিহ্য বিরোধী পাঁচিল। এটা অস্বীকার করবো, এমন বিদ্যে নেই। তবে  দেখেছি বাম আমলে ও শিবপুরেও কৃষক ক্ষেপিয়ে পাঁচিল ভাঙা হয়েছিল। ভাগ চাষিরা কয়েক বছর চাষ করলো। সেই জমিতেই আবার পাঁচিল হলো। হাউসিং কমপ্লেক্স হলো। তাই পাঁচিল ভাঙা আমাদের সংস্কৃতি। আর এখানেই বেচারা রবীন্দ্রনাথ হাঁস ফাঁস করছেন। তাঁর অস্ত্রে আমরা তাঁকে বধ করতে চাইছি। এ যেন ভস্মাসুরের তাড়া খাওয়া শিব!

আমার বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গা যদি কোন ব্যক্তির পড়ে থাকে, ততদিন শান্তি, যতদিন তিনি বাড়ি না করছেন। বিশ্ব ভারতীর ক্ষেত্রে সেটা ধোপে টেকে না। যদিও বিশ্ব ভারতী ১৪ ফুট ছেড়ে পাঁচিল দিচ্ছে। তাতে কাসাহারা বা শান্তি দেব ঘোষের মেয়ের বাড়ি যাওয়ার রাস্তায় কারো কোন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তবে অসুবিধা হচ্ছিল বিশ্ব ভারতীর। সঙ্গীত ভবনের গেট দিয়ে গাড়ি পার্কিং হচ্ছিল ওখানে। বাউল উৎসব হচ্ছিল। আবার কাসাহারায় উল্টো দিকে প্রতিমা হোস্টেল। সেখানে দোকানে জমায়েত, আড্ডা।  হোক না, কার আপত্তি হতে পারে! কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে আগলাবেন কেন? তা বাপু হোক না, ১৫  ফুট পাঁচিলের নিচে! কে মাথার দিব্যি দিয়েছে! 

তবে, আশ্রমিকরা বলতেই পারেন, বাড়ির ব্যালকনিতে বসে মুক্ত আকাশ দেখতে চাওয়া অপরাধ নয়। তাঁরা তো, সামনে পার্ক চাইছেন না! ২০০৪ সালের পর

রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে পড়াশোনা করা অন্তত দুই জনের নাম চলে আসে এক রজত কান্তি রায়। দ্বিতীয় জন অস্থায়ী উপাচার্য সবুজ কলি সেন। আর সেখানে বর্তমান উপাচার্য তাঁদের ধারে কাছে যান না। স্মার্ট বয়। বলতে পারেন, দাবাংয়ের  পোস্টার বয়! তাই বড্ড বেমানান! 

আসলে বর্তমান উপাচার্য ভূমিপুত্র হতে পারেন। হয় তিনি মাটির কিছুই বোঝেন না, না হয় বুঝে সুঝে কোমড় বেঁধে মাঠে নেমেছেন।   

উপাচার্য সম্পর্কে এই মুহূর্তে আরেকটি অভিযোগ তিনি বিজেপির দালাল। এটা এখন মূল অভিযোগ। তবে, জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের স্ত্রীর মরদেহে উপাচার্যের মাল্যদানের মাধ্যমে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন, বিশ্ব ভারতীর নিজস্ব কর্মসূচিতে শান্তি নিকেতন লাগোয়া গ্রামে ত্রাণ বিলি করেছেন, স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক চন্দ্র নাথ সিনহার হাত দিয়ে। সবটাই কী সৌজন্য? আবার বিজেপির সাংসদ স্বপন দাশগুপ্তকে ডেকছেন বিশ্ব ভারতীতে। তিনি শ্যাম বা রাই কূল রাখতে চাইলেন। তবে, মোদ্দাকথা তাঁর গায়ে রং লেগেছে।

বিশ্ব ভারতীর পাঁচিল তো এক এক সময় ভার্চুয়াল মনে হয়!আসল পাঁচিল তো অন্য খানে। তবে এটাও ঠিক, উপাচার্য আরও অনেক উঁচু উঁচু পাঁচিল টপকে যেতে চাইছিলেন। মেলা করে লাভের গুড়, ব্যবসার আঁতুড় ঘর, বিশ্ব ভারতীর মৌচাকে  খুঁচিয়েছেন। মনে পড়ছে, রামকৃষ্ণ কথামালার সেই গল্প-- যেখানে খদ্দের এলে একজন বিক্রেতা আওড়াতো, হরি হরি । অন্যজন সায় দিয়ে বলতো-- হর, হর। অর্থাৎ হরণ করো। ক্রেতা সর্বস্বান্ত হয়েও ভাবতো-- আহ্ কি ঈশ্বর ভক্তি!


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours