নারী ও আম। দুটিই প্রকৃতির অপার দান। অথচ চরিত্রে ও বৈশিষ্ট্যে কতই না ফারাক। তবু কখনও কখনও ভিন্ন প্রজাতির হার্ডেল পেড়িয়ে তারা একাত্ম হয় এক সেতুতে। তেমনই এক নামকরণের সেতু-আম্রপালি। আর এই নিয়েই যে এখন ট্রোল স্যোসাল দুনিয়া। তাই একটু কলম ছোঁয়াছুঁয়ির নিছক খেলা আম্রপালির মুগ্ধতায়।
আমরা প্রত্যেকেই জানি, যে আম হলো আমাদের দেশের জাতীয় ফল। এই ফলটি সাধারণত গ্রীষ্মকালে পাওয়া যায়। জাতিভেদে এই ফলের নাম ভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। যেমন হিমসাগর, ল্যাংড়া, দ,সহেরী, ফজলি আরো কতো কি। তবে হিমসাগর বলুন আর ল্যাংড়াই বলুন স্বাদের দিক থেকে বিচার করতে গেলে "আম্রপালি" আমের ধারে কাছে কেউ ঘেঁষতেই পারবে না।
আপনারা নিশ্চয় এই আম্রপালি নাম টা এর আগেও শুনেছেন। আবার কেউ কেউ হয়তো এই আমের আস্বাদনও করেছেন। যারা এর স্বাদ পেয়েছেন তারা তো ভালো করেই জানেন এই আমটির সম্পর্কে। কিন্তু আপনারা কি এটা জানেন যে এই আমটির নাম কেন আম্রপালি রাখা হয়েছিল? আর কি ভাবেই বা এই আমের উৎপত্তি।
চলুন আজ আমরা এই "আম্রপালি"কে ঘিরে কিছু অজানা তথ্য একটু জেনে নিই। যারা এই আমটির সম্পর্কে জানেন, তারা বিষয়টি আর একবার ঝালিয়ে নিন। আর যারা জানেন না তারাও আজ জেনে নিন এই আম কে ঘিরে কিছু রহস্যের কথা।আসলে এই "আম্রপালি"নামটির পিছনে রয়েছে একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। ভারতের বিহার নামক রাজ্যে বৃজি নামে এক গনযুক্তরাষ্ট্র ছিল। এই রাষ্ট্রের রাজধানীর নাম ছিল বৈশালী। বৈশালী নামটা এসেছে মহাভারতের রাজা বিশালের নাম থেকে। এই শহরের অপর নাম "বিশালা"। আবার কথিত আছে এই শহরটি বিশাল বড় হওয়ায় এর নামকরণ করা হয়েছিল বৈশালী।
এই বৈশালীতে রাজোদ্যান নামের এক স্থানে আম্রবৃক্ষ অর্থাৎ আম গাছের নিচে এক শিশু কন্যাকে পরে থাকতে দেখা যায়। তার পিতা ও মাতা যে কে, তা কিন্তু ইতিহাস ঘেঁটে আজও অবধি পাওয়া যায় নি। আম গাছের তলায় ওই কন্যাটিকে পাওয়া গিয়েছিল বলেই তার নাম রাখা আম্রপালি। পালিভাষায় আম্রকে অম্ব বলা হয়। আবার সংস্কৃত ভাষায় আম্র মানে আম আর পল্লব মানে পাতা। অর্থাৎ আমগাছের নতুন পাতা। এই নগরের এক উদ্যান পালক যার নাম ছিল মহানামন, তিনিই ওই অম্বপালির ভরণপোষণের দায়িত্ব নেন। কেউ কেউ বলেন আম্রদান পালকের কন্যা বলেই তার নাম রাখা হয় অম্বপালি বা আম্রপালি।
এই আম্রপালি যখন শৈশব পেরিয়ে সদ্য কৈশরে পৌঁছেছিলেন তখন থেকে তার রূপের ছটায় মোহিত হননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল ছিল। তাঁর সৌন্দর্য এতটাই ছিল যে তাকে কোন পরীর সাথে তুলনা করলেও যেন কম মনে হ'তো। নিখুঁত বলতে যা বোঝায় আম্রপালি ছিল তাই-ই। এই সময় দেশে-বিদেশে হু হু করে ছড়িয়ে পরেছিল তার এই সৌন্দর্যের কথা। রাজা থেকে শুরু করে রাজপুত্র, সাধারণ মানুষ, প্রত্যেকেই তাকে একবার কাছ থেকে দেখতে চায়, তাকে বিয়ে করে কাছে পেতে চায়। আর এই নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় দ্বন্দ্ব ও বিবাদ লেগেই থাকতো। তার সৌন্দর্য ও বিবাদের খবর চারদিকে ছড়িয়ে পরতেই আম্রপালির মা বাবা খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। তাই তারা তখন বৈশালীতে সব গণ্যমান্য ব্যক্তিদের একটা সুরাহা বের করে দেয়ার জন্য বললেন। এরপর বৈশালীর সমস্ত ধনবান ও ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা মিলে এক সভায় আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নিলেন যে আম্রপালি হবে বৈশালী নগরের নগরবধূ অর্থাৎ ওই নগরের সভানর্তকী। কারণ ওই সময় বৈশালীতে একটি আইন প্রচলন ছিল। সেই আইনে বলা ছিল বৈশালীর কোন সুন্দরী নারী কখনোই বিয়ে করতে পারবে না। তাকে উৎসর্গ করা হবে জনগণের উদ্দেশ্যে আনন্দ দেয়ার জন্য।
তখন মগধের রাজা ছিলেন বিম্বিসার। শোনা যায় তার নাকি স্ত্রীর সংখ্যা ছিল পাঁচশো। একদিন এক নর্তকীর নাচ দেখে তিনি বলে "বসলেন এই নর্তকীর নাচই বিশ্বসেরা"। এরপর তার এক সভাসদের মাধ্যমে তিনি আম্রপালির নাম, সৌন্দর্য ও নাচ সম্পর্কে জানতে পারেন। ফলে তিনিও আম্রপালিকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। ওই আম্রপালিকে একবার চোখের দেখা দেখার জন্য তিনি একদিন ছদ্মবেশ ধারণ করে পৌঁছে গেলেন বৈশালীতে।ওখানে কিছুদিন প্রতীক্ষার পর তিনি আম্রপালির দর্শনের সুযোগ পেলেন তারই প্রাসাদ আম্রকুঞ্জে। আম্রপালিকে প্রথম দেখতেই তিনি চমকে উঠেছিলেন। এত অপরূপা নারী যে পৃথিবীতে থাকতে পারে তা হয়তো তিনি কল্পনাও করতে পারেন নি। তিনি অবশ্য আরো বেশি হতবাক হয়েছিলেন যখন তিনি জানতে পারলেন যে আম্রপালি তার ওই ছদ্মবেশ সম্পর্কে সব জেনে গিয়েছেন সাথে এ ও জানেন যে তিনি মগধের রাজা। এমন কি তিনি যে তাকে বিবাহের জন্য ব্যাকুল তা ও সে জানে। রাজা এই কথা শোনার পরই তাকে সরাসরি বিবাহের প্রস্তাব দেন। কিন্তু আম্রপালি জানায় যে তার রাজ্যের মানুষ কখনোই তা মেনে নেবে না। এতে বহু মানুষের জীবন হানি ঘটতে পারে। তাই তিনি রাজাকে ওখান থেকে চলে যেতে বলেন। তার রাজ্যের কোন ক্ষতি আম্রপালি চান না তাই তিনি রাজাকে তার রাজ্যে ফেরৎ পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। এদিকে বিম্বিসারের পুত্র অজাতশত্রুও আম্রপালিকে কাছে পাওয়ার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিলেন। তাই তার পিতা বিম্বিসারকে আটকে রেখে নিজেই রাজ্যের সিংহাসন দখল করে বসেন।এমনকি আম্রপালির জন্য তিনি বৈশালীও আক্রমণ করে বসেন। যদিও তিনি সেই দখলে জয়ী হয়ে উঠতে পারেন নি। বরং খুব বাজে ভাবে গুরুতর আহত হন। পরে অবশ্য আম্রপালির সেবা শুশ্রূষায় ঠিক হয়ে উঠলে তাকে গোপন পথে তার রাজ্যে ফেরৎ পাঠানো হয়। সেদিনও আম্রপালি অজাতশত্রুর বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ।
আম্রপালি যে শুধু সৌন্দর্যের অধিকারী ছিলেন তা কিন্তু নয়। তিনি যেমন রূপবতী ছিলেন তেমন ছিলেন গুণবতীও। তিনি নাচ,গানের সাথে সাথে বীণাও বাজাতে পারতেন। এমন কি তিনি পালি ভাষাতেও অনেক কবিতাও লিখেছেন।
গৌতম বুদ্ধ বহুবার এই বৈশালীতে এসেছিলেন। সে সময় এই বৈশালী রাজ্য ছিল প্রচুর প্রাচুর্যে ঠাসা। এই শহরে মোট ৭৭০৭ টি প্রমোদ উদ্যান ছিল । সাথে ছিল সম সংখ্যক পদ্ম পুকুর। প্রচুর অর্থের অধিকারী হওয়ায় আম্রপালি বৈশালী শহরের সৌন্দর্যায়নের জন্য অর্থ ব্যয় করতেন। বিষ্ণুপুরাণ মতে বৈশালীতে ৩৪ জন রাজা ছিলেন। এদের মধ্যে প্রথম রাজা ছিলেন নভগ। আর সর্বশেষ রাজার নাম সুমতি। মনে করা হয় এই সুমতি, প্রভু রামচন্দ্রের পিতা দশরথের সমসাময়িক ছিলেন।
শোনা যায় আম্রপালি নাকি তার শেষ জীবনে গৌতম বুদ্ধের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। এই বৈশালী শহরের সাথে গৌতম বুদ্ধের একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সন্ন্যাস গ্রহণ সময় কপিলাবস্তুর ত্যাগ করার পর তিনি প্রথমেই বৈশালীতে এসেছিলেন। এবং রামের পুত্র উদ্রক ও আলার কালামের কাছে আধ্যাত্মিক শিক্ষা গ্রহণ করে ছিলেন। বোধিলাভের পর তিনি প্রায় এই বৈশালীতে এসেছেন। তিনি বৈশালীর প্রজাতন্ত্র অনুযায়ী সেখানে একটি ভিক্ষু সংগঠন তৈরি করেছিলেন। প্রায় ১০০ জন সন্ন্যাসীকে নিয়ে তিনি একদিন হাজির হন এই বৈশালীতে। সে সময় একদিন হঠাৎ আম্রকুঞ্জের বারান্দা থেকে এক যুবক সন্ন্যাসীকে দেখতে পান আম্রপালি। তাকে দেখা মাত্রই তার মনে এক সুপ্ত কামনার জন্ম নেয়। তিনি ভাবেন যেখানে দেশ বিদেশের রাজারা, তাকে একবার দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকে। কাছে পাওয়ার জন্য পাগল হয়ে যায় সেখানে এই অতি সামান্য সন্ন্যাসী ব্যক্তিটি তার দিকে একবারও তাকালো না। তাই তিনি সেই সন্ন্যাসীকে জব্দ করার জন্য তাকে তার কাছে চার মাস থাকার জন্য অনুরোধ করলেন। প্রত্যুত্তরে সেই সন্ন্যাসী তাকে জানায় যে তার স্বামী তাকে আদেশ না করলে তিনি কোথাও থাকতে পারবেন না। এদিকে এই ঘটনার কথা অন্য সন্ন্যাসী মারফত বুদ্ধের কানে গিয়ে পোঁছয়। সবাই ভেবেছিল যে বুদ্ধ হয়তো এই প্রস্তাব মেনে নেবেন না। কারণ তিনি একজন সন্ন্যাসী কে কখনোই এক পতিতালয়ে থাকতে অনুমতি দেবেন না। সবার সেই ভাবনায় তিনি জল ঢেলে দিয়ে ওই সন্ন্যাসীকে চার মাসের জন্য আম্রকুঞ্জে থাকার জন্য অনুমতি দিয়ে দিলেন। কারণ তিনি ওই সন্ন্যাসী "শ্রমনের"(ওই সন্ন্যাসীর নাম) চোখে কোন রূপ কামনা বাসনা দেখেন নি । তাই তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে শ্রমন নিষ্পাপ হয়ে ফিরে আসবে।
চার মাস অতিক্রম করার পর বুদ্ধ যখন রাজ্য ছাড়বেন তখন তিনি দেখেন যে শ্রমন ফিরতে দেরি করছে। ফলে সবাই তখন ভাবতে লাগল যে শ্রমন বুঝি আম্রপালির মোহে পড়ে সেখানেই রয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর সবার ভুলকে ভুল প্রমান করে শ্রমন ফিরে আসেন। আর তার পিছু পিছু আসে এক সুন্দরী মহিলা। সেই মহিলা আর কেউ নন, তিনি ছিলেন ওই বৈশালী রাজ্যের নগরবধূ আম্রপালি। তিনি বুদ্ধের কাছে এসে বলেন "জীবনে এই প্রথমবার তিনি কোন পুরুষকে বশ করতে ব্যর্থ হয়েছেন"। তাই তিনি সর্বস্ব ত্যাগ করে তার চরণে ঠাঁই নিতে চায়।
শোনা যায় তার ওই বিপুল ঐশ্বর্যের সবটাই ত্যাগ করে বাকি জীবনটা তিনি গৌতম বুদ্ধের চরণে কাঠিয়ে দিয়েছিলেন।শেষ জীবনে তিনি দিব্যজ্ঞান অর্জনের চেষ্টাও করেছিলেন ।স্বীয় দেহের ক্রমধ্বংসশীল প্রকৃতি তার দৃষ্টি গোচরে আসে। পরবর্তীতে তিনি পৃথিবীর সকল বস্তুর নশ্বরত্নকে উপলব্ধি করতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন।
এরপর আসি আম্রপালি আমের কথায়।
১৯৭৮ সালে ভারতে ইন্ডিয়ান এগ্রিকালচার রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক বাঙালি বিজ্ঞানী ড. পিযুষ কান্তি মজুমদার উত্তর ভারতের(লখৌন অঞ্চল) বিখ্যাত আম দ,সহেরী ও দক্ষিণ ভারতের আরো একটি বিখ্যাত আম নীলম। এই 'দু,সহরী' ও 'নীলম' এর মধ্যে শংকরায়ন ঘটিয়ে এক নতুন প্রজাতির আম গাছের উদ্ভাবন করেন। যার নাম দেয়া হয় আম্রপালি। নীলম জাতের পুরুষ মুকুল আর দু,সহেরী জাতের স্ত্রী মুকুলের পরাগায়ণ ঘটিয়ে সৃষ্টি করা হয় এই অভিজাত আম আম্রপালি। তবে এই জাতটির কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। উন্নত জাতের আম গাছে, যেমন যে বছর ফলন ধরে তার পরের বছর তাতে আর ফলন ধরে না। তবে , এই আম্রপালি জাতের আম গাছে কিন্তু প্রতি বছরই আমের ফলন হয়। এই আমটির আর একটি বৈশিষ্ট্যতা হল এই আমের গা খুব মসৃণ আর খোসা খুব পাতলা হয়। তা ছাড়া আঁটিটি হয় খুব পাতলা আর গায়ে কোন আঁশ থাকে না। আমটি অত্যন্ত সুস্বাদু রসালো ও সুগন্ধযুক্ত হয়। এই আমে খাদ্যাংশের পরিমান ৭৫ শতাংশ আর মিষ্টতার পরিমাণ ২৪ শতাংশ। মিষ্টতার দিক থেকে বিচার করতে গেলে এই আম ল্যাংড়া বা হিমসাগরের থেকেও অনেক বেশি। এই গাছের উচ্চতা খুব একটা বড় হয় না। আম্রপালি আমের জাত সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে। একটি একটু ছোট আর অপরটি তুলনায় একটু বড়। ছোট আমটির গড় ওজন হয় ১৭০ গ্রামের মতো আর বড়টির গড় ওজন হয় ২৫০ গ্রাম। পোক্ত অবস্থায় এর গায়ের রং সবুজ অথবা লালচে হলুদ রঙের হয়ে থাকে। পাকলে এর রং হয় দেখার মতো। বিজ্ঞানীরা বৈশালীর আম্রপালির নামে এই আমটির নাম রাখেন "আম্রপালি" । এই আমের নাম আম্রপালি রেখে হয়তো গবেষকরা আম্রপালিকে এক অমরত্ব প্রদান করেছেন এটা বলা বাহুল্য।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours