পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

আশঙ্কা আগেই করা হয়েছিল। প্রথম  দফায় সরকারে বসেই রেলের ভাড়া বাড়িয়েছিল মোদী সরকার। এক ধাক্কায় দ্বিগুণ করা হয়েছিল ট্রেন টিকিট বাতিলের খরচ। সেই আশঙ্কা দৃঢ় হয় যখন এর পরেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় আলাদা রেল বাজেট তুলে দেওয়ার। ২০১৬ সালের আগে সাধারণ এবং রেলের আলাদা বাজেট পেশ হত। রেল বাজেটের আগে থেকেই নানা জল্পনা কোন রাজ্য কটা ট্রেন পাবে, রেল প্রকল্পগুলি কি হবে, চালু প্রকল্পগুলি কবে শেষ হবে, টিকিটের দাম বাড়বে কিনা, ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ রেল নিয়ে একটা বিরাট জল্পনা, আশা নিরাশার গুঞ্জন জনগণের মাঝে। রেল বাজেট উঠিয়ে দেওয়ার মানে বুদ্ধিমানেরা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন নতুন ট্রেন, প্রকল্প, ভাড়া বৃদ্ধির জল্পনা সবই চাপা থাকবে ফাইলের মধ্যে। মানুষ জানতেই পারবেন না তার প্রাপ্তি কি। হলও তাই, বিগত কয়েকটি বাজেটে রেলের কথা বলবার জন্য অর্থমন্ত্রী সময় নিয়েছেন গড়ে দুই থেকে চার মিনিট। ভাবুন আড়াই থেকে তিন ঘণ্টার ভাষণে রেলের বরাদ্দ তিন মিনিট, যেখানে রেল বাজেটেরই তিন ঘন্টার ভাষণ হত! জনতার আর জানার উপায় নেই তারা নতুন কি পাচ্ছে বা পাচ্ছে না। এখন ভাড়াও বেড়ে যায় রাতের অন্ধকারে চুপি চুপি। রেলকে বেচে দেওয়ার, থুড়ি বেসরকারিকরণের ভিতপুজো তখনই শুরু হয়ে গিয়েছিল।  

টিকিট কাটার সময় সীমা চার মাস করা হল, কারণ যত আগে থেকে আপনি টিকিট কাটবেন ততটাই অনিশ্চিৎ হওয়ার সম্ভাবনা আপনার যাত্রার। সে ক্ষেত্রে টিকিট বাতিল হলে রেলের লাভ। চার মাস আগে বুকিং এর জন্য বাতিলের সংখ্যাও বাড়ল, আবার রেলের ভাঁড়ারও বেশ ভর্তি হতে লাগল। সেই জন্যই তো মোদী সরকার এসেই ক্যানসেলেশন চার্জ দ্বিগুণ করে দিয়েছিল। 

গত ৪ অক্টোবর লখনউ-দিল্লি সেমি-হাই স্পিড ট্রেন তেজস এক্সপ্রেসের যাত্রা শুরু হয়। ভারতীয় রেলের ইতিহাসে এই প্রথম রেলের বাইরের কোনও সংস্থাকে ট্রেন চালানোর অনুমতি দেওয়া হল। তেজস এক্সপ্রেসের হাত ধরে ভারতীয় রেলে বেসরকারিকরণের দরজা খুলে দেওয়া হয়েছিল। এবার প্রাথমিকভাবে ১৫০টি যাত্রিবাহী ট্রেন এবং ৫০টি রেল স্টেশনের দায়িত্বভার বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেল মন্ত্রক। গোটা প্রক্রিয়ার নীল নকশা তৈরি করতে রেল বোর্ডের তরফে ৫ সদস্যের একটি ক্ষমতা সম্পন্ন সচিবদের কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান করা হয়েছে নীতি আয়োগের সিইও-কে। নীতি আয়োগের সুপারিশ হল, বেসরকারি ট্রেন যেন অন্তত ১৫ মিনিট আগে ছাড়ে। সরকারি ট্রেন পরে ছাড়বে। পর্যবেক্ষকদের মতে, তা না করলে ট্রেন চালাতে বেসরকারি লগ্নি পাওয়া যাবে না। বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলির মতোই এ ক্ষেত্রে ভাড়া নির্ধারণের পূর্ণ এক্তিয়ার বেসরকারি সংস্থার হাতেই থাকবে। শোনা যাচ্ছে রথী মহারথীরা এই ট্রেন চালানোর ব্যাপারে উৎসাহ দেখিয়েছেন। শোনা কথা রাজধানী এক্সপ্রেস চালাতে উৎসাহ প্রকাশ করেছে ইন্ডিগো উড়ান সংস্থা। মানছি ইন্ডিগো সস্তার উড়ান। কিন্তু ইন্ডিগোর বিমানে যারা চড়েছেন তারা ভাল করেই জানেন তাদের বিমানের ভিতরের পরিকাঠামো এবং পরিষেবা কেমন? সেই পরিষেবা যদি রাজধানীতে দেওয়া হয় তাহলে তার মান কেমন হতে পারে নিজেরাই ভেবে নিন।  

শুধুমাত্র সরকারি সংস্থার শেয়ার বেচে এই বছর ১ ট্রিলিয়ন অর্থাৎ এক লক্ষ কোটি টাকা ঘরে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মোদী সরকার। এই লক্ষ্যে এয়ার ইন্ডিয়া ছাড়াও ভারত পেট্রোলিয়াম (BPCL)-সহ আট রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলগ্নিকরণের তোড়জোড় শুরু করেছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। এই তালিকায় শিপিং কৰ্পোরেশন (SCI), THDC ইন্ডিয়া এবং NEEPCO-এর নামও আছে।

মোদী সরকার প্ল্যাটফর্ম টিকিটের দামও বাড়িয়েছিল পাঁচ থেকে দশ টাকায়। এবার করোনা কালে ভিড় কমানোর অজুহাতে প্ল্যাটফর্ম টিকিটের মূল্য দ্বিগুণ থেকে পাঁচ গুণ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। হাওড়া জংশনের নিউ কমপ্লেক্সে প্ল্যাটফর্ম টিকিটের দাম  এখন ৫০ টাকা। খড়গপুর ও টাটানগর স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম টিকিটের মূল্য হচ্ছে ৪০ টাকা। সাঁতরাগাছি, শালিমার, মেচেদা, রাঁচী, হাতিয়া, বালেশ্বর-সহ কয়েকটি স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম টিকিটের দাম করা হয়েছে ৩০ টাকা। পাঁশকুড়া, বাগনান, মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, চক্রধরপুর-সহ কয়েকটি স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম টিকিটের দাম ধার্য করা হয়েছে ২০ টাকা।  করোনার প্রকোপ কমে গেলে এই টিকিটের দাম ফের ১০ টাকায় নেমে আসবে কি? পূর্ব অভিজ্ঞতা তা বলে না। 

কদিন আগেই বেশ কয়েকটি ট্রেন বাতিল করেছে সরকার, যাত্রী হয় না অজুহাতে। তার মধ্যে কলকাতা দিল্লীও রুটও ছিল। এবার ওই রুটেই বেসরকারি ট্রেন চললে তাতে যাত্রী পেতে সমস্যা হবে না বোধ হয়? তা শুধু রেলকে না বেচে গোটা সরকারটাকেই তো বেসরকারি করে দিলে হয়। ভোটের পর ক্ষমতায় এসেই কোনও ভাল কোম্পানি দেখে লিজ দিয়ে দেবেন সরকারকে। আর আমরা বসে বসে দেখব, আর ভোট দিয়ে নাচব। (ক্রমশঃ) 



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours