ইরানী বিশ্বাস, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, নাট্যকার ও পরিচালক, বাংলাদেশ:

‘অস্ট্রেলিয়ার এক প্রতিনিধি আমার সাথে আলাপ করতে করতে বলেন, তোমার দেশের রাষ্ট্রদূতরা মনে করে, দুনিয়ার মানুষ আহম্মক। আমি বললাম, কেন এ কথা বলছেন? তিনি উত্তর করলেন যে, রাষ্ট্রদূত ও কর্মচারীরা যেভাবে থাকেন, আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীও সেভাবে থাকতে পারে না।... তোমাদের দেশের মাথা প্রতি আয় কতো? দেশের লোক না খেয়ে মরে, কাপড় পর্যন্ত জোগাড় করতে পারে না। ... অথচ তোমাদের দেশের মানুষ বাজে খরচ করে। ভাবলে আমাদের লজ্জা হয়।’  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবরের লেখা ‘আমার দেখা নয়াচীন’ বইটির ৪৫ পৃষ্ঠায় এভাবেই তিনি লিখেছেন। ১৯৫২ সালে বঙ্গবন্ধু চীনে গিয়েছিলেন পিস কনফারেন্স অব দি এশিয়ান এন্ড প্যাসিফিক রিজিওন্স-এ যোগ দিতে অভিভক্ত পাকিস্তানের প্রতিনিধি হয়ে। বঙ্গবন্ধু যে লজ্জা পেয়েছেন, সেটা এখনো বহাল আছে। সত্যি তো বাঙালীর চলনে বলনে অভাবী নয়। তাহলে কি তাদের স্বভাবেই..? করোনা কালে অনিয়ম-দুর্নিতীর খসড়া খাতা যেন শেষই হতে চাইছে না। বিদেশে অর্থপাচার থেকে গ্রাম্য চেয়ারম্যান সব জায়গায় রয়েছে দুর্নীতির ছাপ। অন্যায় ভাবে অর্থ উপার্জনের টাকায় বিলাসীতা করা খুব সহজ। কিন্তু সৎপথে অর্থ রোজগার করে বিলাসিতা করা অত সহজ নয়। বাংলাদেশে একটা কথা খুব প্রচলিত আছে ‘অর্ধেক ডিম দিয়েছি, পুরোটাই খাবেন’। জানি না কথাটা কে কবে বলেছিল। তবে প্রবাদ বাক্যের মতো মুখে মুখে ফিরতে থাকে। বাংলাদেশের মানুষের ধারনা কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ আন্তরিক বা আতিথেয়তা জানে না। ছোটবেলা থেকে এই কথাগুলি শুনে শুনে বড় হয়েছি। সামাজিক জীবন যাত্রার পরিবর্তন নিয়ে গবেষনা করতে করতে একদিন আমার মনে হলো, বিষয়টির অন্তর তত্ত্ব আসলে কি?

১৯৪৭ সালে ইংরেজ শাসন থেকে মুক্তি পায় ভারতবর্ষ। একসময় শ্রীলংকা, ভুটান, আফগানিস্তান ভারতবর্ষের অংশ ছিল। তবে ভারতবর্ষ স্বাধীন হয় পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তান(বাংলাদেশ) এবং ভারত নিয়ে। বিনা যুদ্ধে ওই বছরই মাত্র একদিন পর ভারতের সঙ্গে পাকিস্তান আলাদা হয়ে যায়। ভারত-পাকিস্তানের সীমারেখা আঁকা হয় বাংলার বুকজুড়ে। এতে বাংলা হয় দ্বিখন্ডিত। বাংলার এক পাশ রয়ে যায় ভারতের পতাকা হাতে। অন্য পাশ রয়ে যায় পাকিস্তানের পতাকা হাতে। বাঙালীর বিরহ বুঝি তখন থেকেই শুরু হয়। অনেকের আত্মীয় স্বজন রয়ে যায় এপার বাংলা, ওপার বাংলা। পশ্চিম বাংলায় বাস করা অনেক মুসলমান যেমন বাংলাদেশে চলে আসে। আবার অনেক হিন্দু চলে যায় পশ্চিমবাংলায়। পরবর্তীতে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ১৯৭২ সালে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশ ডকুমেন্টস অনুয়ায়ী ২৬ মার্চ থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারত ৯৮ লাখ ৯৯ হাজার ৩০৫ জন বাংলাদেশি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিল। সবচেয়ে বেশি শরণার্থী আশ্রয়দাতা রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে আশ্রিতের সংখ্যা ছিল ৭৪ লাখ ৯৩ হাজার ৪৭৪ জন। দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল ত্রিপুরা। তবে সেখানে আশ্রিত ১৪ লাখ ১৬ হাজার ৪৯১ জন। যা ত্রিপুরার মোট জনসংখ্যার প্রায় সমান। মেঘালয়ে ছয় লাখ ৬৭ হাজার ৯৮৬ ও আসামে তিন লাখ ১২ হাজার ৭১৩ জন। এ ছাড়াও বিহার, মধ্যপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশেও শরনার্থী পাঠানো হয়। দীর্ঘ ৯ মাস ভারত সরকার বাংলাদেশের শরনার্থীদের আশ্রয় দিয়েছেন এবং সৈনা পাঠিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করতে বিশেষ ভুমিকা রাখেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারত সরকার ঘোষনা করেছিল, কোন হিন্দু পরিবার যদি এ দেশে থেকে যেতে চায় তাহলে তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। অনেক পরিবার মুক্তিযুদ্ধে ঘরবাড়ি, অর্থ সম্পদ হারিয়েছেন। তারা হয়তো মনে করেছেন দেশে গিয়ে আর কি হবে বরং এখানেই স্থায়ী থেকে যাওয়া ভাল। আবার অনেকেই দেশের টানে ফিরে এসেছে। ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে নিহত হওয়ার পর এ দেশের হিন্দুরা অভিভাবকহীনতায় ভুগতে থাকে। তাই রাতের অন্ধকারে বাড়িঘর ফেলে ভারতে পালিয়ে যায়। ’৭৫ পরবর্তী বাংলাদেশ ছিল এক বিভিষীকাময় অধ্যায়। সকল শাসকই হিন্দুদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করেছে। ফলে বাংলাদেশ থেকে দলে দলে হিন্দুরা আত্মরক্ষার্থে পাড়ি দিয়েছে ভারতে। যৌথ পরিবারের একজন সদস্য ভারতে গেলে পরবর্তীতে পুরো পরিবার চলে যাওয়ার পরিকল্পনায় থাকে। এভাবে একের পর এক বাংলাদেশ হিন্দু শুন্য হতে হতে একসময় সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে। 

বাংলাদেশ থেকে রাতের অন্ধকারে এক কাপড়ে পালিয়ে যাওয়া পরিবার পশ্চিমবঙ্গে রিফিউজি হয়ে যায়। মাথা গোঁজার ঠাই আর দুবেলা দুমুঠো খাবার জোগাড় করতেই তাদের হিমসিম খেতে হয়। সম্পূর্ন নতুন পরিবেশে নতুন জীবন যাত্রায় এই মানুষগুলি হয়ে পড়ে দিশেহারা। যাদের ছিল গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গরু আর পুকুরভরা মাছ, তারা পশ্চিমবাংলা গিয়ে প্রিয়জনের মুখে ঠিকমতো খাবারই জোগাড় করতে হিমসিম খায়। সেই মানুষগুলির কাছে অতিথি আপ্যায়ন একরকম বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই না। বাংলাদেশের অনেকেই হিন্দু সম্পত্তি দখল করে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন। অথচ তাদের সম্পত্তির উপর দাঁড়িয়ে তাদেরই হেয় করে কথা বলছে। 

পৃথিবীর অন্যান্য দেশে বাংলাদেশ থেকে অনেক মানুষ প্রতিদিনই যায়। সবাই ভাগ্য বদলাতে যায়। কেউ কেউ বাংলাদেশ সরকারের অনুদানে ডিগ্রি অর্জন করতে যায়। তারপর সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ নিয়ে সে দেশের নাগরিকত্ব লাভ করে। তারাই আবার বাংলাদেশে এসে বড় বড় কথা বলে। দেশপ্রেম দেখানোর প্রবল চেষ্টা করে। অথচ এসব মানুষদেরই সমীহ করে বাংলাদেশের মানুষ। কেবলমাত্র কোন বাংলাদেশী ভারতের নাগরিকত্ব লাভ করার পর বাংলাদেশের প্রতি তার কোন অধিকার থাকে না। এর কারণ আমি আজও খুঁজে পেলাম না। 

স্বাধীনতা পরবর্তীতে বাংলাদেশ থেকে যারা ডাক্তার দেখাতে কলকাতা যেতেন। সদ্য স্থায়ী হওয়া পশ্চিমবঙ্গে বসবাস করা মানুষদের কাছে গিয়ে উঠতেন। বাংলাদেশের মানুষ কলকাতা গিয়ে হোটেলে থাকার প্রচলন খুব কম সময়ে হয়েছে। নিজেদের চলার মতো পরিস্থিতি না থাকলেও বাংলাদেশের আত্মীয়-স্বজনদের যত্ন করতে হতো। এই পরিস্থিতি আঁচ করতে পারলে কখনোই তাদের উপহাস করতেন না।

একবার যদি চিন্তা করি, পশ্চিমবঙ্গে যাদের কাছে আমরা বছরে তিনবার আতিথেয়তা গ্রহন করি, সেই পরিবারের মানুষগুলি হয়তো ৩০ বছরেও বাংলাদেশে আসার চান্স নাই। আবার দেশে ফিরে এসে নেমক হারামের মতো নিন্দা করি। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালীর সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের নাড়ির সম্পর্ক। আজকে বলিউডের বিখ্যাত বচ্চন বধূ জয়া ভাদুড়ী, মিঠুন চক্রবর্তী, অনুপ কুমার, মুম্বাইয়ের মিউজিক ডিরেক্টর প্রীতম, ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রনব মুখার্জী বাংলাদেশের মানুষ। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব ১৯৭১ সালে ত্রিপুরা শরনার্থী ক্যাম্পে জন্ম নেন। স্বাধীনতা পরবর্তীতে তাদের পরিবার আর ফেরত আসেনি। এছাড়া, সুচিত্রা সেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী, বৌদি এ রকম অনেক উদাহরণ দেবার মতোই আছে। আমরা আমাদেরই শত্রু হয়ে যাই খুব সহজে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, আমার ভাইকে সাহায্য করতে হবে। সেই ভ্রতৃত্বের বন্ধন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টে ছিন্ন হয়ে গেল। সেই ছিন্ন তার কোন ভাবেই যেন জোড়া লাগছে না।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours