তিলক পুরকায়স্থ, লেখক, চিকিৎসক ও চিত্রগ্রাহক, আসানসোল:
রাঢ় বাংলার চুরুলিয়ার মাটি থেকেই উঠে এসেছেন সকলের প্রিয় কবি নজরুল ইসলাম। আমরা নজরুল ইসলামের তারুণ্যে ভরপুর অফুরন্ত জীবনীশক্তি এবং অসাধারণ কবিপ্রতিভা নিয়ে গর্ব বোধ করলেও উনার বাল্য জীবনে দুখু মিঁঁয়া থেকে নজরুল ইসলামে উত্তরণে, সলতে পাকানোর কাজ মুখ্যত যে দুজন করেছেন- পিতা ফকির আহমেদ এবং পিতৃব্য বজলে করিমের সম্মন্ধে প্রায় কিছুই জানি না।
চুরুলিয়া গ্রাম, নজরুলের শৈশবে যেমন ছিল, এখনও প্রায় তেমনি গণ্ডগ্রামই হয়ে আছে। রুখা শুখা কয়লাকুটির দেশ। চতুর্দিকে বিশাল টাঁঁর বা ডহর জমি, কবির ছোট বেলায় যাতায়াতের জন্য ছিল গরুর গাড়ি ও সাইকেল। নইলে শ্রীচরণ ভরসা। অবশ্য ইংরেজ আমলে একটা রেল ইস্টিশন ছিল- চুরুলিয়া নামে। অন্ডাল- তপসি-চুরুলিয়া- গৌরান্ডি , সারাদিন চলত কয়লা ভরা মালগাড়ি, আর দিনে একটি মাত্র মালগাড়ির সঙ্গে একটি প্যাসেঞ্জার বগি জোড়া থাকত সাধারণ যাত্রীদের যাতায়াতের জন্য । তবুও তো স্টেশন ছিল, প্যাসেঞ্জার বগি জোড়া মালগাড়িও ছিল। আজ চুরুলিয়া স্টেশন কেবলই ইতিহাস।চুরুলিয়া গ্রামে হিন্দু মুসলিম জন বিন্যাস প্রায় সমান সমান। বাউড়ি, বাগদী, তাঁতি, নাপিত, বামুন, সদগোপ, কাজী, শেখ, সৈয়দ সব মিলে মিশে একাকার। তাইতো এখানকার কবি লিখতে পারেন-" মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান"।
এখন দেখা যাক, চুরুলিয়া নামটির উৎস কি ? কোন পাথুরে প্রমান পাওয়া যায় না এ বিষয়ে, কিন্তু যে মতগুলি বন্ধুবর শচীনন্দন পাল ও লেখক অমর চট্টোপাধ্যায় দিয়েছেন, সেগুলি থেকে পাচ্ছি যে হয়ত বা চারজন ধর্মগুরু বা আওলিয়া থেকে এই নামকরণ। আবার নরনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় মত দিয়েছেন, তামিল শব্দ চুরুল( মানে বহমান বা প্রবাহিত) থেকে এই নাম এসেছে। চুরুলিয়ার উত্তর দিকেই তো বহমান অজয় নদ, কাজেই এটা হতেই পারে। এখন কথা উঠতে পারে তামিল শব্দ এখানে এলো কি ভাবে ? তাহলে শুনুন বাঙালি জাতির ইতিহাস।
আর্য জাতি তাঁদের ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে যখন ভারতে, ভালো করে বললে উত্তর ভারতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বা প্রতিষ্ঠা পাবার জন্য যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত আছে, বাংলাদেশে তখন আদিতম দ্রাবিড় গোষ্ঠী এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ আদিম জনজাতি গোষ্ঠী বা প্রটো অস্ট্রোলয়েড গোষ্ঠীর লোকেদেরই বসবাস ছিল যেমন সাঁওতাল, মুন্ডা, কোল, মাহালি ইত্যাদি। এরা সবাই তখন পরিচিত ছিল খেরওয়াল গোষ্ঠী হিসাবে। পরে অনেক ছোট ছোট গোষ্ঠী খেরওয়াল গোষ্ঠী থেকে বেরিয়ে গিয়ে নিজেদের স্বতন্ত্র গোষ্ঠী গড়ে তোলে, অনেকে হিন্দুও হয়ে যান।
পরবর্তী কালে অবৈদিক আর্য যেমন আলপিও, দিনারিও ইত্যাদি জন গোষ্টিও বাংলার মাটিকে বাসভূমি হিসাবে গ্রহণ করে থিতু হয়ে বসে। এই দ্রাবিড় এবং মুখ্যত অবৈদিক আর্য আলেপিও , দিনারিও গোষ্ঠীর লোকেদের সঙ্গে অস্ট্রিক সংস্কৃতি ও সভ্যতার ধারক গোষ্ঠীর মিলনের ফলেই আজকের বাংলাদেশের বাঙালি গোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক উৎপত্তি। অর্থাৎ বাঙালি হচ্ছে মিশ্র শংকর জাতি।বৈদিক আর্যদের বঙ্গ বিজয় এবং বৈদিক সংস্কৃতির আবির্ভাব এর অনেক পরের ঘটনা।বঙ্গ সংস্কৃতিতে অনার্য প্রভাব নিয়ে বলা যায় যে নৃতাত্ত্বিক ভাবে বাঙালি যে উন্নত জাতি ( গো বলয়ের আর্যদের থেকে, এটি আমার নিজস্ব বিশ্বাস) তার কারণ তার রক্তে আছে তিনটি সভ্যতার - প্রোট অস্ট্রোলয়েড, দ্রাবিড় এবং মিশ্র আর্যভাষী- সভ্যতার মিশ্রণ।
আসছি চুরুলিয়ার কাজী পরিবারের কথায় ।এখানকার কাজী পরিবারের আদি নিবাস বিহারের হাজীপুরের "কাজী মহল্লায়", সম্রাট শাহ আলমের সময় এঁদের সৈয়দ বংশীয় এক পূর্বপুরুষ , কাজী নজরুল ইসলামের উর্দ্ধতন ষষ্ঠতম পুরুষ গোলাম নকশবন্দ সম্ভবত চুরুলিয়া গ্রামে আগত কাজী বংশের প্রথম পুরুষ। উনার পিতার নাম সৈয়দ নুরুল ইসলাম এবং পুত্র কাজী কেফাতুল্লা, অর্থাৎ চুরুলিয়া গ্রামে প্রথম কাজী উপাধিধারী পুরুষ হচ্ছেন এই কাজী কেফাতুল্লা। দিল্লির সম্রাটের আমন্ত্রণে ইনারা এখানে আসেন কাজী অর্থাৎ বিচারক হিসাবে।এখানে সংক্ষেপে শাহ আলম সম্মন্ধে জানাই যে, ইনি হলেন সম্রাট আওরঙ্গজেবের এক পুত্র, যিনি তাঁর অন্য দুই ভাইকে হত্যা করে আবুল নাসের সৈয়দ কুতুবউদ্দিন মোহাম্মদ শাহ আলম বাহাদুর শাহ নাম নিয়ে ১৭০৭ সালে দিল্লির সম্রাট হয়ে বসেন।
নজরুলের প্রপিতামহ হচ্ছেন কাজী গোলাম হোসেন, পিতামহ কাজী আমিনুল্লাহ এবং পিতার নাম ফকির আহমেদ, মাতা জাহেদা খাতুন। নজরুলের পিতা ছিলেন সৎচরিত্রের মুক্তমনা ধার্মিক মানুষ।উনাকে নিয়ে কিছুটা আলোচনা না করলে বোঝা যাবেনা যে চুরুলিয়ার মতন গণ্ডগ্রাম থেকে কিভাবে ধূমকেতুর মতন কবির আবির্ভাব ঘটতে পারে!
সর্ব অর্থে ফকির আহমেদ, ছিলেন মানবতাবাদের পূজারী, সুফী ফকির। সাংসারিক জীবনে একেবারে অনভিজ্ঞ , তায় আত্মভোলা। এর খেসারত দিতে, তাই বন্ধু, আত্মীয় স্বজনের কাছে বারে বারে প্রতারিত হয়েছেন তিনি। পাশা খেলার সঙ্গী মহানন্দ আশ মহাশয় পাশার দানের সঙ্গে সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের মতন এই সুফী ফকিরকেও প্রায় নিঃশেষ করে দেন। ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রাও ঝোপ বুঝে কোপ মারতে থাকে। এদিকে প্রথম সন্তান সাহেবজানের পরে পর পর চারটি সন্তানের অকালমৃত্যু। তাই ষষ্ঠ সন্তানের নাম রাখা হয় দুখু মিঞা, এমন নাম রাখাই হয়েছিল যাতে অপদেবতার নজর না পড়ে । এই দুখুই হচ্ছেন পরবর্তী কালে বাংলা মায়ের দামাল ছেলে নজরুল।
অনেক আত্মীয় স্বজন ফকির আহমেদকে পরামর্শ দেন, কলিয়ারীতে গিয়ে কাজ নেবার জন্য। যেমন মুক্তোর মতন হাতের লেখা, তেমনি দখল বাংলা, উর্দু, ফার্সি ভাষায়। কিন্তু সুফী সাধক এবং তাঁর ভাই বজলে করিম সেই ধাতের লোকই নন। যাঁদের চোখে স্বপ্ন-"এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়"- তাঁরা তাঁদের পথ খুঁজে নিয়েছিলেন, নিজের নিজের মতন করে।তাই দেখতে পাই, ফকির আহমেদ খাদেমগিরি, ইমামতি করছেন, আবার কেউ ডাকলে ধর্ম গ্রন্থ থেকেও মিলাদ-শরীফ পাঠ করে শোনাতেন, গৃহ শিক্ষকতাও করতেন । চমৎকার হাতের লেখার জন্য দলিল লেখার জন্যও গ্রামে গ্রামে ডাক পেতেন। বলতে গেলে, এটিই ছিল তাঁর মুখ্য আয়ের পথ। শোনা যায় ফকির আহমেদের হস্তাক্ষর ছাড়া অনেকেই দলিল রেজিষ্ট্রি করতে চাইতেন না।
বাল্যকাল থেকে নজরুল যেমন দুরন্ত তেমনি মেধাবী, এ ব্যাপারটা পিতা ফকির আহমেদ এবং কাকা বজলে করিম, দুজনেই নজর করেছিলেন।
জেনে নিন চুরুলিয়ার প্রাচীন কথা- কবির ছোটভাই স্বর্গীয় কাজী আলী হোসেন এর পুত্র- কবি ও সমাজসেবী, বর্তমানে নজরুল একাডেমীর সাধারণ সম্পাদক কাজী রেজাউল করিমের কাছে।
প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে বর্তমানের চুরুলিয়া আদিতে ছিল বর্ধমান মহারাজের দেওয়ান রাজা নরোত্তম সিংহের গড়। ইনি ছিলেন মহারাজের তহসিলদার।বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট অফ গেজেট, বর্ধমানেও, রাজা নরোত্তমের উল্লেখ আছে।গড়ের চতুর্দিক ছিল পরিখা ঘেরা।আর এই গড়ের অনতিদূরেই ছিল পীর হাজী পালোয়ান সাহেবের দরবার শরীফ।হাজী সাহেবের অনুগতের সংখ্যাও কম ছিল না।দুর্ভাগ্যক্রমে এই দুই পরাক্রমশালী ব্যক্তির মধ্যে সদ্ভাব ছিল না।একবার কোনো কারণে এই দুই দলের অনুগামীদের মধ্যে দাঙ্গা বেঁধে গেলে, উভয় পক্ষেরই এত লোকের মুণ্ডচ্ছেদ হয় যে, জায়গাটির নামই হয়ে যায় মুন্ডমালা।সে সব মিথ বা ইতিহাস এখন কালের গর্ভে। মিথ এই কারণেই লিখলাম যে হাজী পালোয়ান ছিলেন সুফী সাধক। সুফী সাধক আর হিন্দু জমিদারের মধ্যে যুদ্ধের কারণ কি, সেটা কোথাও লেখা নেই।
যাইহোক বর্তমানে গড়ের বা পরিখার কোনো অস্তিত্ব নেই।কিছুদিন আগে অবধি গড়ের মাঠে উঁচু উঁচু ঢিবি ছিল।সেই ঢিবির মধ্যে একটি শিমুল গাছে নাকি সন্ধ্যা হলেই ভূতেদের আড্ডা বসত।দুরন্ত, অকুতোভয় কিশোর নজরুল, মা এবং প্রতিবেশীদের নিষেধ অগ্রাহ্য করে প্রায়ই সেই শিমুল গাছে চড়ে বসতেন ভূত দেখতে, আর আনমনে বাজাতেন আড়বাঁশি।বলা বাহুল্য তাঁর আর ভূত দর্শন হয়নি, কিন্তু এই ঘটনার মধ্য দিয়েই বোঝা যায়, কিশোর বয়সেই তার মনে যুক্তিবাদের কিরকম প্রভাব পড়েছিল।
পীর পুকুরের জলেই দামাল বালক নজরুল হুটোপুটি করতেন।তিনি পুকুর পাড়ে দুটি বট গাছ পুঁতে সে দুটির নাম দিয়েছিলেন 'হারুত' ও 'মারুত'।নজরুলের সময়ের মাটি ও খড় দ্বারা নির্মিত মসজিদ এখন চকমিলান আধুনিক মসজিদ।
ফিরে আসি নজরুলের সময়ে চুরুলিয়া গ্রামে পড়া শোনার কি ব্যবস্থা ছিল দেখতে । তখন চুরুলিয়ায় ছিল বিনোদবিহারী চট্টোপাধ্যায়ের একটি পাঠশালা আরেকটি টোল। টোলে তো অহিন্দুদের ভর্তি নিতোনা। তাই নজরুল ভর্তি হলেন বিনোদবিহারী বাবুর পাঠশালায়।
কিন্তু কাজী বাড়ির ছেলে আরবী/ফার্সি একদম জানবেনা, তাই বা কি করে হয় ! এই ব্যাপারটা খুব পীড়া দিত কাকা বজলে করিমকে। বজলে করিমও নিয়মিত ফকির আহমেদের সঙ্গে মসজিদে যেতেন নামাজ পড়তে। কিন্তু অন্তরে অনুভব করতেন গরিব ঘরের মুসলিম ছেলে মেয়েদের পড়াশোনার সমস্যাকে।তাই সমমনস্ক ফজলে আহমেদ সিদ্দিকীর সঙ্গে মিলে ১৮৭০ সালে তৈরি করলেন কাঁচা বাড়ী ও খড়ের চাল দেওয়া কাঁচামাটির মক্তব।এখানেই বাল্যবয়সে পাঠশালা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দুখু মিঁঁয়াকে ভর্তি করে দেন ফকির আহমেদ। মক্তবের শিক্ষক ছিলেন ফজলে আহমেদ সিদ্দিকী। আগেই লিখেছি যে এই মক্তবের স্থাপনা কাল ১৮৭০ সালে।পরে এর নাম বদলে রাখা হয় মুসলিম অবৈতনিক বিদ্যালয়।এখন এটি পাকা দ্বিতল প্রাথমিক বিদ্যালয়- নাম ' চুরুলিয়া নজরুল বিদ্যাপীঠ(প্রা)। আবার পিতার মৃত্যুর পরে এই মক্তবেই ছোট ভাই আলী হোসেন এবং বোন উম্মেকুলসুমকেও ভর্তি করে দেন স্বয়ং নজরুল। বড় দাদা সাহেব জান তখন কলিয়ারীতে রমজান শাহের পিতার কাছে কেরানির কাজে যোগ দিয়েছেন।
মাত্র ন বছরের মধ্যে পিতৃহারা হয়ে( ফকির আহমেদের মৃত্যু ২০ শে মার্চ, ১৯০৮ সালে) , দুখু মিয়াকে কঠোর জীবন সংগ্রামের পথে নামতে হয়। শুরু হয় হাজী সাহেব পালোহানের মাজারে খাদেমগিরি করা। অনেকে তাঁদের লেখায় উল্লেখ করেছেন যে নজরুল পীর পুকুরের মসজিদে ইমামতি করতেন। সেটি ঠিক হতে পারেনা কারণ মসজিদে ইমামতি করার বয়স এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা তখন বালক নজরুলের হয়নি।
এখানে উল্লেখ্যযোগ্য যে নজরুলের পিতা ও পিতামহও আজীবন হাজী সাহেব পালোহানের মাজারে খাদেমগিরি এবং পীর পুকুরের মসজিদে ইমামতি করা এই দুটি কাজ করে গেছিলেন।পীর পুকুরের একপাশে হাজী সাহেবের মাজহার, অন্যপাশে মসজিদ। এই মাজারে এবং মসজিদে ছোটবেলা থেকেই পিতার হাত ধরে নজরুলের যাতায়াত। মাজারে সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়ে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়া , কখনও কখনও পিতার উৎসাহে আজান দেওয়া, এভাবেই চলছিল বাল্য জীবন। আবার অন্য দিকে কাকা বজলে করিমের হাত ধরে শুরু হয় গান, কবিতা লেখার প্রেরণা, কবি জীবনের উন্মেষ । আবার মক্তবের শিক্ষক ফজলে আহমেদের কাছে ফার্সি শিক্ষা এবং পড়াশুনোর সঙ্গে সঙ্গে জানতে পারছেন জীবনের পাঠ- পরাধীন ভারতের কথা, ইংরেজ এবং জমিদার শ্রেণীর শোষণ এবং অত্যাচারের কথা , গরীব চাষির বেদনাময় দুঃখের জীবনের বারোমাস্যা। সর্ব অর্থে বালক নজরুল চুরুলিয়ার মতন গণ্ডগ্রামে থেকেও সম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠলেন, বাবা-কাকাদের সংস্পর্শে।
হাজী সাহেবের মাজারে গাঁয়ের মেয়ে, বৌদের বেদম ভিড়, বিশেষ করে ফি শুক্কু বারে। সবাই আসে মাজারে মানত করতে। সুতোয় বাঁধা মান্নতের পোড়া মাটির ঘোড়া ঝুলিয়ে দিয়ে যায়। জনশ্রুতি বলে মানত পূর্ণ হলেই সেই ঘোড়া নাকি নিজে থেকেই সুতো ছিঁড়ে মাটিতে পড়ে যায়।
কিন্তু বাঘের বাচ্চা বাঘই হয়। তাইতো ধার্মিক, উদার, অসাম্প্রদায়িক ফকির আহমেদের পুত্র এমন চাঁছাছোলা ভাষায় প্রকাশ করতে পারেন তাঁর অন্তরের সত্যকে-
"সে নমাজ আর বন্দেগীতে নাই ফল ভাইরে, যাতে দেহের সাথে দিলের যোগ নাইরে।
মন আছে ক্ষেতে ভুঁইয়ে, তন আছে মসজিদ ছুঁইয়ে, দেহ আর দিল দূরে দূরে ঠাঁই রে।
তার চেয়ে গান গাওয়া ভালো, তারে-নারে নাইরে।"
নজরুলের কাকা কাজী বজলে করিম ছিলেন কবি, লোকগানের গীতিকার, সুরকার এবং লেটো গানের দলের ওস্তাদ। বাংলা, উর্দু, আরবী, ফার্সি ভাষায় বজলে করিমের এতই দক্ষতা ছিল তিনি নিজেই গজল রচনা করে তাতে সুরারোপিত করে গাইতেন।প্রসঙ্গত জানাই যে, লেটো গান একসময় বীরভূম এবং বর্ধমান জেলা, বিশেষ করে বর্তমান পশ্চিম বর্ধমানে বহুল প্রচলিত ছিল। এটি মুখ্যত ছিল যাত্রা আশ্রিত লোকসংগীত পালা।আমার ছেলেবেলায় লেটো, আলকাপ, কৃষ্ণ যাত্রা, বোলান ইত্যাদি যে কি অসম্ভব জনপ্রিয় ছিল, বলার বাইরে।আলকাপ শিল্পীরা আসতেন মুর্শিদাবাদ ও বোলান গানের শিল্পীরা অনেকেই নদিয়ার বলে মনে পড়ে, তবে জনপ্রিয়তায় আমজনতার সবচেয়ে প্রিয় ছিল লেটো গান, লেটোর আসরে তো সবাই হেঁসে এ ওর গায়ে ঢলে পড়ত। এমন কি শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলার আসরেও নিয়মিত এসব গানের আসর বসত। কিন্তু হায় ! আজকের পশ্চিমি সভ্যতার ছায়ায় বড় হওয়া যুগ বাংলার এসব কৃষ্টিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। ছোট বেলার একটি লেটোর আসরের একটি সংলাপ মনে পড়ে গেল। পন্ডিত সংস্কৃত শেখাচ্ছেন জেলেকে , বল বেটা- "হরে মুরারে , মধুকৈটভারে" , তো জেলে বলছে-"মধুর মা কই মাছ ধরে", একদম নির্মল হাস্যরস।
সুন্দরবনের বনবিবি পালার মতন, লেটো গানও হত একেবারে ধর্ম নিরপেক্ষ। পালা শুরু হতো হিন্দু দেব দেবী বিশেষ করে সরস্বতী বন্দনা এবং আল্লাতালার বন্দনা গান দিয়ে । এছাড়াও বন্দনা করা হত আসরের, গুরুর, পিতার, গ্রাম দেবতার এবং সমবেত শ্রোতৃ মন্ডলীর।
দেখে নিই , বজলে করিম রচিত লেটো গানের একটি আসর বন্দনা- "এস আসরেতে বারিতাল্লা/ তুমি না তরাইলে, নাহি কোন হিল্লা।/ তোমার পদে স্মরণ করি, ওগো বারি,/ তুমি না তরাইলে , কেমনে তরি।"
এবার শুনেনি নজরুলের আসর বন্দনা- " এসো বিনাপানি, বিদ্যা তরঙ্গিনী, ভক্তিভরে আমি করি মা প্রণাম।/ ডাকি মা কাতরে, এস এস এ আসরে, মোদের উপরে হও কৃপাবান।"
মুখ্য নায়ক হতেন সংদার, তাঁকে যোগ্য সহযোগ করতেন দোহারেরা। যাত্রা পালার ঢঙে, আসরের দুই দিকে বসতেন যন্ত্র সংগীত শিল্পীরা তাঁদের ঢোল,তবলা, বাঁশি, ক্লারিওনেট ,করতাল, হারমোনিয়াম ইত্যাদি নিয়ে, যাঁদের বাজনদার বলে ডাকা হত। এছাড়া অনেক আসরে যাত্রার মতন ঝাঁঝর, সারিন্দা, মাটির কলসী, ঘুঙুর ইত্যাদিও বাজতে দেখেছি বলে মনে পড়ছে। মহিলা চরিত্রে পুরুষেরাই অভিনয় করতেন, এঁদের বলা হত বাই বা সখী। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ছোট ছেলেরাই মেয়ে সাজত আবার প্রয়োজনমত ছেলেও সাজত। এই ছোট ছেলেদের লেটোর দলে ,ডাকা হত বেঙাচি বলে, অর্থাৎ ভবিষ্যতে বড় শিল্পী হবে । করিমদার কাছে শুনলাম- নজরুলের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে লেটো গানের কবি শেখ চকর নজরুল সম্মন্ধে একদা বলেছিলেন, এই বেঙাচি ভবিষ্যতে গোখরো হবে। এটি অতিরঞ্জিত হতে হতে সব বাচ্চাদের বেঙাচি নামকরণ হয়ে যায়।
যাঁরা নাচে, গানে, সংলাপে গুরু গম্ভীর বিষয়ও রঙ্গ রসের আধারে পেশ করত তাঁদের ডাকা হতো সংদার বলে। লেটো দলের জনপ্রিয়তা ও নামডাক অনেকাংশে নির্ভর করত সংদারের উপরে। সেই হত মুখ্য অভিনেতা এবং কমেডিয়ান। আসরের পরিস্থিতি অনুসারে তাকে তাৎক্ষণাৎ যুক্তিযুক্ত মজাদার সংলাপ রচনা করে নাচ, গান, অভিনয় করে দেখাতে হত।
তবে মূল পালা যিনি রচনা করতেন তিনি হতেন লেটো দলের মাস্টার বা সূত্রধর । মাস্টারকে লেটো দলের পরিচালক বলা যেতে পারে। মঞ্চে লেটো পালার পরিবেশনের আগে, এই মাস্টার ই সমবেত দর্শকদের কাছে পালা পরিবেশনের জন্য অনুমতি চান।
আর লেটো দলের প্রশাসনিক কর্তা ব্যক্তিকে ম্যানেজার বাবু বলে ডাকা হত।
সংদার কিন্তু রাজা, উজির সাজতেন না। যদিও তিনিই লেটো দলের মুখ্য অভিনেতা হতেন, কিন্ত কমেডিয়ান বা ভাঁঁড়ের চরিত্রে অভিনয় করতেন। রাজা, উজির, মন্ত্রী ইত্যাদি চরিত্রাভিনেতাদের একটি অদ্ভুত নাম হত- পাঠক। তেমনি লেটো দলের অস্থায়ী শিল্পীদের ডাকা হত আরেকটি অদ্ভুত নামে- আসামী।
অনেক জায়গায় দেখলাম লেটোর দলের মুখ্য কবিকে নাকি বলা হত 'গোদা কবি'। এটি ভুল, নজরুলের কাকা বজলে করিমের বন্ধু ,তৎকালীন বিখ্যাত লেটো গানের কবি শেখ চকরের পায়ে গোদ বা ফাইলেরিয়াসিস ছিল বলে স্থানীয় লোকজন উনার নাম দিয়েছিল চাকরা গোদা।
যাত্রার আঙ্গিকে সমবেত বাদ্যযন্ত্র একসঙ্গে সুর তুলে বেশ কিছুক্ষণ বেজে চলার পরে চারজন সখী জ্বলন্ত ধুপকাঠি নিয়ে আসরে প্রবেশ করতেন। এঁরা ধুপকাঠি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে যে গানটি পরিবেশন করতেন, তাকে বলা হত আরতি করা।
এরপর আসরে উপস্থিত হতেন মাস্টার বা সূত্রধর। সমবেত দর্শকদের প্রণাম করে পালা শুরু করার অনুমতি চাইতেন। এরপরেই সংদার শুরু করতেন বন্দনা গান।
লেটো গানের আসরে মানুষ শুনতে এবং দেখতে আসতো মুখ্যত সংগদারের অভিনয় এবং রঙ্গরস। বেশির ভাগ সময় কবির লড়াইয়ের মতন লেটো গানের দুই দলের মধ্যে লড়াই হত। দুই সংগদারের বুদ্ধিদীপ্ত লড়াই চলতে চলতে অনেক সময় রাত কাবার হয়ে যেত। তবুও কোন দর্শক আসন ছেড়ে নড়ত না।
ইতিহাসের পাতা খুঁজে কাজী বজলে করিমের লেখা যে কটি লেটো গান উদ্ধার করা গেছে, তার থেকে গুটিকয়েক উদ্ধৃত করছি, এই গান গুলি কাজী রেজাউল করিমের সৌজন্যে প্রাপ্ত -
"কেন মন দুনিয়ায় , ভুলেছ মিছে মায়ায়, ভেবে দেখ মন, কেহ কারো নয়রে।।/যারে ভাব আপন আপন, সকলি অকারণ, একদিন দুষমন হইবে নিশ্চয় রে।।/ জীবন যৌবন ধন, সকলি যে অকারণ, মিছে কর তাহার যতন রে।।/ সকলি পড়ে রবে, সঙ্গে কিছু নাহি যাবে, ছেড়ে যেতে হইবে নিশ্চয়রে।।/ ভাই বন্ধু জরূ নাতি, পিতা মাতা নারী পতি, সঙ্গের সাতি কেবা কাহার হয়রে।।
যেদিন রে তোর আসবে সমন, শুনবে নারে কারূ বারণ, বড় কঠিন পিয়াদা সেজনরে, / নয় দুয়ার নয় থানা, পহরী তার নয় জনা, পলাইবে সবাই পেয়ে ভয়রে।।/ খালি ঘর পেয়ে সে জন করবে চুরি মানিক রতন, তবে কেন তাহার জতনরে।।/ ধূলার ঘর উড়ে যাবে, ভবের খেলা ফুরাইবে, পাখির বাসা মিছে আশা মনরে।।"
এতো সব সুফী সাধকেরই কথা। আমাদের প্রিয় লালন সাইঁঁও তো একই কথা বলেন-
"তুমি কার আজ কেবা তোমার এই সংসারে।
মিছে মায়ায় মজিয়ে মন কি কর রে।।
আপনি যখন নাই আপনার, কারে বল আমার আমার;
সিরাজ সাইঁঁ কয়, লালন তোমার জ্ঞান নাহি রে।।"
আবার মনের মানুষের সনে মিলনের আশায় বসে আছেন রাঢ় বাংলার কবি কাজী বজলে করিম-
"মনের মানুষ পাইনা খুঁজে,(তবু তারে পাইনা রে)।
প্রাণ বুজি ঘরে রয়না রে।।
খেতো যদি দুগ্ধ ছানা তবু কি তাই করতাম মানা,
উড়ে যেত পাখির ছানা, তবু তারে পাইনা রে।।
থাকে পাখী রং মহলে দেখা পাইনা দেখতে গেলে,
পঞ্চ বেলা বুলি বলে হীরা ময়না টিয়া রে।।"
রাধা-কৃষ্ণ লীলা কি চমৎকার ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে-
"তুমি এমন করে আড়াল দিয়ে , লুকিয়ে গেলে চলবেনা।
এসহ হৃদে এস, তোমায় কিছু বলবনা।।
তুমি আমার কালো সোনা, ময়লা পড়লে রং যাবেনা,
তোমার জন্য প্রাণ কান্দে মোর, তোমার কি প্রাণ কান্দে না।।"
এরকমই আরেকটি গান-
"কাজ কি আমার জাতি কূলে, দাস হব ঐ চরণে।
তারি প্রেমে মজে রব, জীবনে কি মরণে।।
পীরিতে মজিলে মন, রয়না তাহার কুল মান,
জাতিভেদ রহেনা মন মজিলে পরের সনে।।"
অসাধারণ সারস্বত সত্যের কি সুন্দর ভাবে প্রকাশ করেছেন বজলে করিম সাহেব।
কাকার চেলা ছোট্ট নজরুল ও কম যেতেন না। তিনিও রাধা কেষ্ট নিয়ে লিখলেন-
"বেলা গেল ও ললিতে কৃষ্ণ এলনা।
বাঁশি লয়ে চলে গেল, ফিরে এলনা।।
সে ,জে , আমার গুণমনি, (তারে) রেখেছে কোন চাঁদ বদনী।
আমায় করে অনাথিনী, ধম্মে' সবে না।।
আসি বলে গেল কালা, (আমি) গেঁঁথেছি বনফুলের মালা।
মালা হলো জপমালা, উপায় হোল না।।"
এবার বজলে করিম লিখিত একটি অসাধারণ সূফী তত্ত্ব আধারিত ইসলামিক গান শুনুন।আগেই লিখেছি, কাজী নজরুল ইসলামের উর্দ্ধতন ষষ্ঠতম পুরুষ গোলাম নকশবন্দ সম্ভবত চুরুলিয়া গ্রামে আগত কাজী বংশের প্রথম পুরুষ। সুফী মতবাদের একটি পরম্পরা হচ্ছে নকশবন্দ, ইসলামিক আধ্যাত্মিক চর্চার দর্শন ।আত্মার পরিশুদ্ধি হচ্ছে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের পন্থা।পারস্যের দরবেশ খাজা বাহাউদ্দিন নকশবন্দ প্রতিষ্টা করেন এই নকশবন্দ পরম্পরা।
"কলেমা পড়িবে মুখে, সদাই রহিবে সুখে,
এখানে সেখানে, দাগা দিতে পারে কে?
রহম করিবে আপে, রহমান রহিম।।
ভেবে বজলে করিম কয়, তোমার কদমে আশ্রয়,
পরকালে কর দয়া, ওগো দয়াময়।"
কবির ভাইপো রেজাউল করিমের কাছে জানতে পারলাম , কাজী নজরুল ইসলামের শৈশব ও কৈশোরকালে তাঁর কাকার অনুপ্রেরণায় পঁচিশটির মতন লেটো পালা রচনা করেন। তার কয়েকটির নাম এরকম- রাজপুত্রের সঙ, চাষার সঙ, আকবর বাদশা , শকুনি বধ, কবি কালিদাস, মেঘনাদবধ , সিন্ধু বধের সঙ, বিদ্যাভুতুম, দাতা কর্ণ, নীলকুঠি,হাস্যরসাত্মক সঙ ইত্যাদি । একসময় কাজী নজরুল এবং বজলে করিমের লেখা লেটো গানগুলি লোকের মুখে মুখে ফিরত। আস্তে আস্তে কালের স্রোতে এবং রেডিও, টিভি, সিরিয়ালের দৌলতে বাংলার লোকসংগীত এবং তার কৃষ্টি ক্ষয় পেতে পেতে লেটো গান প্রায় হারিয়ে যাবার মতন অবস্থা হয়। তখন এই বাংলারই একজন প্রয়াত লেটো গানের শিল্পী শেখ ফকির মন্ডল, যাঁর বাড়ি ছিল চুরুলিয়ার পাশের গ্রাম খোশনগরে, তিনি বজলে করিম এবং নজরুলের লেটো গানগুলি উদ্ধার করতে সচেষ্ট হন। লোকের মুখে মুখে ফেরা গানগুলির অনেক কটিকেই পরবর্তী সময়ে ফকির মন্ডলই লিপিবদ্ধ করান। এই লিপিবদ্ধ লেখার একটি কপি তিনি নজরুল একাডেমিকেও দিয়েছিলেন রাখবার জন্য। সেই লিপিবদ্ধ গানের খাতাটির একটি প্রাচীন জেরক্স কপি উদ্ধার করা হয়েছে যেটি বর্তমানে রেজাউল করিমের কাছে রাখা আছে। যদিও তখনকার নিম্নমানের জেরক্স মেশিনের জন্য, অনেক লেখা খুব অস্পষ্ট। এর মধ্যে কোন লেখাটি নজরুলের আর কোনটি বজলে করিমের তা নির্ণয় করে দিয়েছেন স্বয়ং কাজী রেজাউল করিম বাবু।
একটি অপ্রিয় সত্য কথা বলি।এই বঙ্গের বাঙালির মননে নজরুল এখনও অনেক দূরে। তা নইলে বলুন তো যে বাঙালি সংস্কৃতি মনস্ক জাতি হিসাবে গর্ব বোধ করে, জোড়াসাঁকো বা শান্তিনিকেতনে হুট হাট করে চলে যায়, খোয়াইয়ের হাটে গিয়ে হাতে হাত ধরে আদিবাসী নৃত্যের তালে পা মেলায়, সেই বাঙালি কবি নজরুল কে ভালোবেসে 'কবিতীর্থ চুরুলিয়া' আসেন না কেন? যতজন পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি চুরুলিয়া তে আসেন, তার থেকে ঢের বেশি সংখ্যায় আসেন বাংলাদেশের বাঙালিরা।
রবি ঠাকুরকে জানতে গিয়ে , বাঙালি ট্যুরিস্ট জোড়াসাঁকো, শিলাইদহ যাচ্ছেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ থেকে প্রিন্স দ্বারকনাথ, জ্যোতি দাদা, কাদম্বরী বৌঠান - এঁদের সম্মন্ধে আমরা সবাই প্রায় কম বেশি জানি কারণ রবি ঠাকুরকে বুঝতে এঁদের জানা জরুরি।
ঠিক সেভাবেই নজরুল ইসলামকে জানতে হলে, পিতা ফকির আহমেদ ও চাচা বজলে করিমকে জানাও ঠিক ততটাই দরকার। নইলে নজরুল ইসলামের সৃষ্টি নিয়ে, তাঁর হিন্দু কন্যা বিবাহ নিয়ে একদিকে সেযুগের সারস্বত বাঙালি ব্রাহ্ম সমাজ, শনিবারের চিঠি, প্রবাসী অন্যদিকে কাঠ মোল্লার দল যখন আদাজল খেয়ে কবির পিছনে পড়েছিল, তখন পিতার মতনই পিতার আদর্শে, সাংসারিক দুঃখ কষ্টের মধ্যেও শির উঁচু রেখে এঁদের মোকাবিলা করে গেছেন।ফকির আহমেদের মতন দারিদ্র ছিল তাঁর শিরভূষণ।
"হে দারিদ্র, তুমি মোরে করেছ মহান।
তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীষ্টের সন্মান।"
রতনে রতন চেনে, তাই রবিঠাকুরের আশীর্বাদ কিন্ত সর্বদাই নজরুলের মাথার ওপরে ছিল। তাই ১৯২২ সালের ১১ই আগস্ট ধূমকেতু প্রকাশিত হয়েছিল , রবিঠাকুরের আশীর্বাদ নিয়ে।
"আয় চলে আয় রে ধূমকেতু, আঁধারে বাঁধ অগ্নি-সেতু, দুর্দিনের এই দুর্গ-শিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয়-কেতন।"
আর নাচে, গানে, কবিতায়, অভিনয়ে, সংলাপে তুখোড় যে নজরুল চিত্র সারা বাংলা জুড়ে বর্তমান , তার ভিত্তি কিন্তু গরে ওঠে কাকা বজলে করিমের হাতে । অথচ আমরা তাঁর কোন খবরই রাখিনা।
এখানে বজলে করিম এবং নজরুলের সম্পর্ক নিয়ে দুকথা বলি।নজরুলের পিতা ফকির আহমেদের আপন কাকার মধ্যম পুত্র হচ্ছেন এই কাজী বজলে করিম।
রেজাউল করিমদার কাছে বসে নজরুল ও বজলে করিমের গল্প শুনছি। বজলে করিম ছিলেন সাংস্কৃতিক মনস্ক, লোকসংস্কৃতি শিল্পী। লোকসংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরেই তিনি জীবনের চলার পথের রসদ জোগাড় করতেন। পশ্চিম বর্ধমানের লেটো গান ছিল তাঁর প্রাণ, মন জুড়ে। আজীবন লেটো গান প্রচার এবং তাঁর উন্নতির চেষ্টা করে গেছেন নিরলসভাবে। অথচ সংস্কৃতিমনস্ক বাঙালি এই গন্ডগ্রামের নিরলসভাবে লোকসংস্কৃতির সেবা করা মানুষটির খোঁজও রাখেনা।
বজলে করিম ও তাঁর পত্নী কোরেশা বিবি ছিলেন নিঃসন্তান। বজলে করিমের শ্বশুর সোবহান মিঞার বাড়ি পাণ্ডবেশ্বরের কাছে নিমসা গ্রামে( শেখ অজিবুল হক- নজরুল ইসলাম ও বাংলা সাহিত্য) ।অত্যন্ত মেধাবী, সংগীত অনুরাগী নজরুল ছিলেন তাঁর পুত্রসম। নজরুলের জীবন গঠনে উনার পিতার এবং কবিসত্তা গঠনে অত্যন্ত উদার হৃদয়ের, ধর্ম নিরপেক্ষ বজলে করিম চাচার অসাধারণ প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। বজলে করিম নজরুলকে প্রকৃত মানুষ হবার , মনুষ্যত্ব অর্জনের শিক্ষা দিতেন। কাজী বজলে করিম বাংলা লেটো গান ও লেটো পালা যেমন রচনা করেছেন, তেমনি রচনা করেছেন বেহুলা-লখিন্দরের গান, ইসলামি সংগীত, রাধা- কৃষ্ণ কে নিয়ে গান, বাংলা-উর্দু মিশ্রিত গজল ইত্যাদি । শুধু গীতিকারই নন, গানগুলির সুরকারও ছিলেন তিনি নিজেই।
চুরুলিয়ার নিমশা গ্রামের লেটো গানের দল তখন বর্ধমান জেলায় বিখ্যাত। এই দলটির পরিচালক, ওস্তাদ ছিলেন বজলে করিম। আর ছিলেন গোদা কবি বা চাকরা গোদা ( কবি শেখ চকর)। পিতার মৃত্যুর পরে ছোট্ট দুখুকেও করিম সাহেব তাঁদের দলে টেনে নেন। বজলে করিমের হাতে পরে ছোট্ট দুখুও হয়ে ওঠেন ওস্তাদ। বজলে করিমের দেহান্তের পরে প্রথমে কবি মনু মোল্লা এবং পরে কবি শেখ চকর হয়ে ওঠেন নজরুলের লেটো গান শিক্ষাদানের প্রকৃত গুরু।
আবার চুরুলিয়ার বিখ্যাত লেটো দলের সঙ্গেও জড়িয়ে ছিলেন বজলে করিম।এই দলের বিখ্যাত সংদার ছিলেন আবু তাহের মোল্লা।
নিমসার চাকরা গোদা মাস্টার প্রায়ই বলতেন দুখু বেঙাচি একদিন গোখরো হবে । এই খুদে গোখরাকে প্রথমে দুবরাজপুরের এক গ্রাম্য মেলায় ' ক্ষুদে ওস্তাদ' উপাধিতে ভূষিত করা হয়। অসাধারণ গীত-সংগীত পরিবেশন করার জন্য নজরুলকে 'ভ্রমর কবি' নামেও ভূষিত করা হয়েছিল।
চুরুলিয়া অঞ্চলে তখন অনেক বিখ্যাত লেটো গানের শিল্পী- সবচেয়ে সম্মানিত কাজী বজলে করিম এছাড়াও ছিলেন কবি বাসুদেব, কবি শেখ চকোর, অসাধারণ সুকণ্ঠের অধিকারী খোশনগরের শেখ গোলাম মাজী, রবি বাউড়ি, কেলেজোড়ার মলিন্দ বাউড়ি, বদিনাথপুরের কাজী মোহাম্মদ মনসুর ইত্যাদি।
আর নামি দলও অনেক - নিমশা, চুরুলিয়া ,খোশ নগর,কেলেজোড়া, বদিনাথপুর ইত্যাদি । এবার মুস্কিল হল নজরুলের। প্রতিটি দলই চায় ওই ঝাঁকড়া চুলের দুখু যেন তাদের দলের পালা রচনা করে। ওই টুকু বাচ্চা দুখুর কলমে যেন কাকার প্রেরণায় মা সরস্বতী ভর করেছে।ঐটুকু ছেলের লেখা চাষার সঙ পড়া যাক।
"চাষ কর দেহ জমিতে
হবে নানা ফসল এতে
নামাজে জমি উগালে
রোজাতে জমি সামলে
কলেমায় জমিতে মই দিলে
চিন্তা কি হে ভবেতে
সুখে থাকবে তুমি-
কয় নজরুল ইসলামেতে।"
কিন্তু দেখার মতন ব্যাপার হলো, ওইটুকু বাচ্চার মনেও তখন ইংরেজ জাতির প্রতি বিতৃষ্ণা প্রবেশ করেছিল। তাইতো তাঁর লেখায় পাই-
" মোরা ভাই বাউল চারন।
মানি না শাসন বারণ-
জীবন মরণ মোদের অনুচর রে।"
আরো তীব্র ভাবে, কষাঘাত করে, ইংরেজি আদব কায়দাকে বিদ্রুপ করে এমন একটি লেটো গান লিখলেন যে বিশ্বাস করা শক্ত এটি একটি অতি কম বয়সী কিশোরের রচনা।
" রব না কৈলাশপুরে/ আই এম ক্যালকাটা গোয়িং।/ যত সব ইংলিশ ফেসেন/ আহা মরি, কি লাইটনিং।।/ ইংলিশ ফেসেন সবি তার/ মরি কি সুন্দর বাহার,/ দেখলে বন্ধু দেয় চেয়ার,/ কামন ডিয়ার গুড মর্নিং।/বন্ধু আসিলে পরে,/ হাসিয়া হেন্ডশেক করে,/ বসায় তারে রেসপেক্ট করে,/ হোল্ডিং আউট এ মিটিং।।/ তারপর বন্ধু মিলে/ ড্রিঙ্কিং হয় কৌতূহলে/ খেয়েছে সব জাতি কূলে/ নজরুল ইসলাম ইজ টেলিং।।"
আবার কি মরমী হৃদয়স্পর্ষী ভাষায় অন্ধক মুনির পুত্রের শরাঘাতে মৃত্যু যন্ত্রণা বর্ণনা করেছেন দেখে নি-
"কে মারিল জ্বলন্ত বান, হারাইব এবার পরান,
অন্ধ পিতামাতা আছে, কে দেখিবে তায় গো- কে দেখিবে তায়।।
ওরে নিষ্ঠুর মারিলি বাণ , বিনা দোষে বধিলি প্রাণ
কিশোর মেরে পাবিনা ত্রাণ, দয়া কি তোর নাই।।
দুখু কাজী ভেবে বলে, লেটোর এই আসর তলে,
জলভরণের শব্দ তুলে, মরলে তুমি ভাই।।"
শকুনি বধ পালার একটু নমুনা পেশ করছি-
"শিবা হয়ে পরাজিতে পশুরাজে সাধ ?
জ্ঞান নাই কি তোর কাণ্ডাকাণ্ড হয়েছিস উন্মাদ।
অজা হয়ে কোন সাহসেতে বাধ সাধিস মহাবলী বাঘের সাথে,
ভেক হয়ে ফণীর সাথে বাধ, তুই বাদ!"
হাস্যরসাত্মক সঙে সতীশ নাম চরিত্রের মুখে একটি অসাধারণ কবিতা আছে-
"থাকব নাক বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে।
কেমন করে ঘুরছে মানুষ , যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।।
বুঝতে অসুবিধা হয়না, ছোট্ট নজরুলের এই কবিতাটা ছিল বীজ, যা পরে অঙ্কুরিত হয়ে পরিণত হয় "সংকল্প" কবিতায়। সেরকমই আরো একটি এরকম অসাধারণ গান-
"ভাঙ ঐ কারার দুয়ার জোরসে টান
অত্যাচারীর মাথার উপর খড়্গ হান,
পালারে অত্যাচারী জেগেছে আজ সকল প্রজা।।
লাঠি মার লাঠি মার কারার দ্বারে,
ঝনঝনিয়ে ভাঙুক কারা ভয় কারে রে।"
বোঝাই যায় এটাই ছিল দুখু মিয়ার হৃদয়ে লুকিয়ে থাকা "ভাঙার গান" এর মকসো।
আর নজরুলের কলম যখন ছুটছে, তখন বজলে করিম আস্তে আস্তে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু কেন- তাঁরও তো তখন কিছুই বয়স হয়নি। তিনি কি নিজের মধ্যে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, মহাকালের ডাক এসে গেছে ! নইলে কেন তিনি স্নেহময়ী মাকে নিজ রচিত এই গানটি শোনাবেন-
"আমি চলিলাম নিজ ঘরে গো জননী
এ ঘরের আশা মিছে ভরসা।
ঠিক যেন পাখির বাসা,
আমি চলিলাম।
একদিন সামান্য ঝড়ে
উড়ে যাবে গো জননী
কেঁদ না মা কেঁদ না,
এটা কাঁদার সময় নয়-
এখন লা- ইলাহা পড় মনে মনে।"
চলে গেলেন কাকা বজলে করিম, সবাইকে চোখের জলে ভাসিয়ে দিয়ে, ১৯১০ সালে ।নজরুলের জন্ম ১৮৯৯ সালের ২৪ শে মে, মাত্র ন বছর বয়সে পিতা ফকির আহমেদ এবং ১১ বছর বয়সে পিতৃসম পিতৃব্য বজলে করিমকে হারালেন। প্রিয় কাকার মৃত্যুতে মাত্র ১১ বছরের বালক এত শোকাহত হয়েছিলেন যে ওই বয়সেই লিখে ফেললেন একটি মর্মান্তিক শোকের গান-
"হায়! আমরা কি ভাগ্যহীন-
হেন ওস্তাদ প্রতিম কাজী বজলে করিম হারায়েছি
ধিক এ ছার পোড়া কপাল, হারায়ে রত্ন অকালে
শোকে বুক নয়ন জলে ভাসিতেছে
হায় ! নিঠুর কালে অকালে আশা মোর বিনাশিলে
শোক সাগরে সকলে ভাসিতেছে।...
একে পিতৃবিয়োগ তাহে চাচাজানের শোক
হায়রে ! এ ছার মর্তলোক মিছামিছি।"
নজরুল চর্চা বলতে পশ্চিম বাংলার বেশির ভাগ জায়গায় দেখছি একসঙ্গে রবীন্দ্র- নজরুল জয়ন্তী পালন, আবার স্কুল-কলেজ জীবনে দেখতাম রবীন্দ্র-নজরুল- সুকান্ত জয়ন্তী,অর্থাৎ আমরা অত্যন্ত ব্যাস্ত বাগীশ জাতি, তাই এক নৈবেদ্য দিয়ে কি সুন্দর করে তিন কবিকে স্মরণ করা হলো!
বাঙালি জাতি সৌভাগ্যবান যে নজরুলের মতন উদার, মুক্তমনা, অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি ও লেখক এই রাঢ় বাংলায় জন্মেছিলেন।আজকের দিনে যে হিংস্র জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মান্ধতার কালো মেঘ সারা পৃথিবীতে ছেয়ে গেছে, সেখানে লেখক নজরুল দিনে দিনে আরো বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন।
"গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।
নাই দেশ কাল পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,
সব দেশে সব কালে ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জাতি।"
এই সহজ সত্যটি এত সাদা মাটা ভাবে যিনি বলতে পারেন, তিনি সত্যের কবি, তিনি জনগণের কবি, তিনি দেশ-কাল-পাত্রের উর্দ্ধে মহাকবি।তিনি শুধু কবিই নন, তিনি সুরকার, তিনি গায়ক, তিনি লেখক, তিনি বিপ্লবী, তিনি বিদ্রোহী, তিনি সাম্যবাদী, তিনি বন্দে পুরুষোত্তম।
আমার মতন এক ব্রাত্যজনের কিছু জিজ্ঞাসা আছে সুধী বঙ্গসমাজের কাছে। সেই একই প্রশ্ন, একহাতে বাঁশের বাঁশরী ও অন্যহাতে রণ-তুর্য, প্রেম-মানবতা -জন জাগরণ- দ্রোহকালের কবি কি এই বঙ্গে তাঁর প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা আদৌ পেয়েছেন?
দেখেনি আজকের সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে ৯৩ বছর আগে করা তাঁর একটি মন্তব্য কে।
২ সেপ্টেম্বর, ১৯২৬ সালে 'গণবানী' তে কবি লিখেছেন - "টিকিত্ব দাড়িত্ব অসহ্য, কেননা ঐ দুটোই মারামারি বাধায়।টিকিত্ব হিন্দুত্ব নয়, ওটা হয়ত পণ্ডিত্ত্ব ! তেমনি দাড়িত্ব ইসলামত্ব নয়, ওটা মোল্লাত্ব। এই দুই 'ত্ব' মার্কা চুলের গোছা নিয়েই আজ এত চুলোচুলি।"
এমন ভাবে হিন্দু মুসলিমের সম্প্রদায়ের বিভেদ নীতির বিরুদ্ধে আর কেউ কি এমন সিংহ বিক্রমে গর্জন করেছেন কোথাও কখনও ?
কাকতলীয় হলেও জানাই কবি যেন জন্মেছিলেন ঝড় ঝঞ্ঝা মাথায় নিয়েই।
এক প্রচণ্ড ঝড় জলের রাতে, শেষ প্রহরে কবির জন্ম হয়।সেই বিভীষিকাময় রাতের বিষয়ে যখন বড় হয়ে তিনি জানতে পারেন, তখন সেই রাত নিয়ে এক অসাধারণ কবিতা লেখেন।
"অবিশ্বাসীরা শোনো শোনো জন্মকাহিনী মোর
আমার জন্মখনে উঠেছিল ঝঞ্ঝা তুফান ঘোর
উড়ে গিয়েছিল খড়ের চাল, ভেঙেছিল গৃহদ্বার
ইস্রাফিলের বজ্রবিষান বেজেছিল বার বার
আল্লাহ আকবর ধ্বনি শুনি প্রথম জনমি আমি
আল্লাহ নাম শুনি মোর রোদন গেছিল থামি।
জন্মক্ষনের সেই ঝড় মোরে টেনে এনে গৃহ হতে
লইয়া ফিরেছি কত অজানা- অদেখা পথে।"
বর্তমানে নজরুল ইসলামের জন্মভিটার দেওয়ালে, মার্বেল ফলকে এই কবিতাটি উৎকীর্ণ আছে।
অসম্ভব প্রতিভাবান কবি কত যে বিভিন্ন বিষয়ে গীত রচনা করেছেন এবং তাতে সুরারোপ করেছেন- তার শেষ নেই। শিশু-কিশোর মনের উপযোগী গান, সারি-জারি, ঝুমুর, লেটো গান, কীর্তন, আগমনী, শ্যামা সংগীত, আধুনিক, রাগ-প্রধান, গজল, ইসলামী গান, ঋতু পর্যায়ের গান আরো কত কিছু তিনি লিখেছেন, অথচ আমরা তাঁর এই সৃষ্টিশীল জগৎকে ভুলে গিয়ে, মোটা দাগে তাঁকে দাগিয়ে দিয়েছি বিদ্রোহী কবি বলে। বাংলা সাহিত্যে অনেকেই বিভিন্ন ধরনের গান রচনা করেছেন, কিন্তু একেবারে বাংলার মাটি থেকে উৎসারিত শ্রমিকের গান, কৃষকের গান, লেটো গান মায় ছাদ পেটানোর গান অবধি আর কেউ রচনা করেছেন বলে জানা নেই। লোক সংস্কৃতির শিকড় অত্যন্ত গভীরে প্রোথিত না থাকলে, এত বিভিন্ন ধরনের মাটির গান তৈরি সম্ভব নয়!
" মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান/ মুসলিম তার নয়নমনি, হিন্দু তাহার প্রাণ।" এই উক্তিটি কিন্তু নজরুল একটি শিশু-কিশোর মনের উপযোগী নাটক- "পুতুলের বিয়ে" উপলক্ষে লিখেছিলেন ? আমরা কি তার খোঁজ রাখি?
ক্ষুদায় কাতর তাঁর শিশুকালের অসাধারণ বর্ণনা নজরুল নিজেই দিয়ে গেছেন- ' আমার কৈফিয়ত' এ। " ক্ষুদাতুর শিশু চায়না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত একটু নুন / বেলা বয়ে যায়, খায়নিক' বাছা, কচি পেটে তার জ্বলে আগুন।
চুরুলিয়ায় কবির বাড়ির পাশ দিয়ে গিয়েছে গ্রামের প্রধান রাস্তা, সেই রাস্তা দিয়ে কত লোক যাতায়াত করে। কবি কিন্তু সেই ছোট্ট বেলাতেই উন্মুখ হয়ে থাকতেন সেখান দিয়ে চলাচল করা দিগুলি গ্রামের সাঁওতালদের জন্য। ভারী সুন্দর বাঁশি বাজাতে পারত ওই গ্রামের বাসিন্দারা। সেই মেঠো বাঁশির সুর বালক কবির কানের মধ্যে দিয়ে হৃদয়ে গেঁথে যেত। তাই প্রায়ই দেখা যেত সাত বছরের একটি ভাসা ভাসা চোখের সৌম্যকান্তি বালক একা একা পৌঁছে যেতেন দিগুলি গ্রামে। কখনো আড় বাঁশিতে সুর তুলে, কখনো তাঁদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গান গেয়ে উঠতেন । তাঁদের সেই মেঠো সুর পরে তিনি চমৎকার ভাবে অনেক গানে প্রয়োগ করেন। সৃষ্টি হয় কালজয়ী বহু গানের যেমন-
"রাঙামাটির পথে লো মাদল বাজে, বাজে বাঁশের বাঁশি,
বাঁশি বাজে বুকের মাঝে লো, মন লাগে না কাজে লো,
রইতে নারি ঘরে ওলো প্রাণ হলো উদাসী লো।"
এখানে জানাই যে, প্রতি বছর নজরুল জয়ন্তী উপলক্ষে চুরুলিয়া গ্রামে যে ৭ দিন ব্যাপী নজরুল মেলা অনুষ্ঠিত হয়, তাতে এখনও প্রতি বছর দিগুলি গ্রামের আদিবাসী শিল্পীরা অংশগ্রহণ করে আসছেন।
আড়বাঁশির কথায় মনে পড়ল- বাড়ির কাছে একটি শিমুল গাছে নাকি সন্ধ্যা হলেই ভূতেদের আড্ডা বসত। দুরন্ত, অকুতোভয় নজরুল, মা এবং প্রতিবেশীদের নিষেধ অগ্রাহ্য করে প্রায়ই সেই শিমুল গাছে চড়ে বসতেন ভূত দেখতে, আর আনমনে বাজাতেন আড়বাঁশি।বলা বাহুল্য তাঁর আর ভূত দর্শন হয়নি, কিন্তু এই ঘটনার মধ্য দিয়েই বোঝা যায়, সেই ছোট বয়সেই তাঁর মনে যুক্তিবাদের কিরকম প্রভাব পড়েছিল।
লিচু চোর কবিতার প্রতিটি ছত্র তো গ্রাম বাংলার প্রতিটি ছেলের বাল্যকালের কথা - "পুকুরের ওই কাছে না লিচুর এক গাছ আছে না হোথা না আস্তে গিয়ে গাছে গে যেই চড়েছি ছোট এক ডাল ধরেছি, ও বাবা মড়াৎ ক'রে প'ড়েছি সড়াৎ জোরে!"
উদাহরণ আর বাড়িয়ে লাভ নেই, যেহেতু কবির জন্মস্থানের অতি নিকটেই আমার বাসস্থান, এবং কবির বর্তমান প্রজন্ম আমার অত্যন্ত নিকটজন, তাই অত্যন্ত ক্ষোভে আমাদের প্রিয় কবিকে নিয়ে এত কথা বললাম।
নজরুলের আদর্শকে যদি আমরা সত্যিই ভালোবাসি , নজরুলকে জানতে চাই, বুঝতে চাই, তবে আসুন- চিনুন জানুন অজানা নজরুলকে। উপলব্ধি করুন কিভাবে বাংলার এক অবহেলিত গণ্ডগ্রামে নজরুল ইসলামের মতন অসামান্য প্রতিভার জন্ম হোল। আমাদের নৈতিক দায়িত্ব নজরুলের গান, সংগীত, তাঁর জাতপাতহীন সমাজের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখা। একা নজরুলের পরিবার এবং চুরুলিয়া নজরুল আক্যাডেমী তাঁদের সীমিত আর্থিক ক্ষমতায় আর কত করবে ? অথচ করার মতন অনেক কিছুই আছে, যা আর্থিক প্রতিবন্ধকতায় করা যাচ্ছেনা। মহা মূল্যবান বই এবং ঐতিহাসিক চিঠিপত্র গুলি ক্রমশ বিলুপ্তির পথে এগিয়ে চলেছে।
নজরুল ইসলামকে যদি ভালোবাসেন তবে অবশ্যই আসবেন কবিতীর্থ চুরুলিয়া, থাকার জায়গা - Kaji Nazrul Youth Hostel, Churulia. Booking : www.youthhostelbooking.wb.gov.in অথবা State Youth Centre, Moulali, Kolkata 700014.
এখানে এলে দেখবেন প্রাপ্তির ঘর আপনা আপনি কত ভরে উঠবে।হলফ করে বলতে পারি- এক বুক তাজা হাওয়ার সঙ্গে এক অনির্বচনীয় আনন্দ নিয়ে ফিরে আসবেন।
তথ্যসূত্র ও ঋণ স্বীকার :-
১) চুরুলিয়া ও নজরুল কথার নানা প্রসঙ্গ। অমর চট্টোপাধ্যায়, শচীনন্দন পাল। যোধন প্রকাশনী, রূপনারায়নপুর, পশ্চিম বর্ধমান।
২)লেটো গান । সংগীতের ইতিকথা।। chorchapod.blogspot.com>blog-post
৩)ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে কবির ছোটভাই স্বর্গীয় কাজী আলী হোসেন এর পুত্র- কবি ও সমাজসেবী, বর্তমানে নজরুল একাডেমীর সাধারণ সম্পাদক কাজী রেজাউল করিম।
৪) লেটো দলের 'ব্যাঙাচি' - bdnews24.com
https://bangla.bdnews24.com › 2015/05/25
৫) যুগস্রষ্টা নজরুল, খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দিন। জোনাকি প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা।
৬) ফকির মন্ডলের লেটো গানের লিপিবদ্ধ লেখার কপি- নজরুল একাডেমির সম্পাদক কাজী রেজাউল করিমের সৌজন্যে প্রাপ্ত।
৭)লেটো, বরুণকুমার চক্রবর্তী। লোক সংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র। তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ। পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
(ছবি সৌজন্যে: প্রতিবেদক ও নজরুল একাডেমি, চুরুলিয়া)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours