মহুয়া বন্দ্যোপাধ্যায়, লেখিকা, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর:
বড় দ্রুত বদলাচ্ছে সময়। বদলে যাচ্ছে চারপাশ। আমাদের ছোটবেলায় সব কেমন অন্যরকম ছিল। একটা পাড়া ছিল তখন। বাঙালি আর পাড়া কালচার ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল।পাড়া আর প্রতিবেশী জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠতো সে সময়।পাড়ার মন্দির চত্ত্বরে মানত করা ঠাকুমা, পিসিমারা আসতেন পুজো দিতে । ঠাকুরের প্রতি ভক্তির সাথে সাথেই এ বাড়ি ও বাড়ির হাঁড়ির খবর , কেচ্ছা কেলেঙ্কারি নিয়েও অপরিসীম উৎসাহের সাথে আলোচনা করতেন।খবরের কাগজ পড়ে পাড়ার মোড়ে আড্ডারত পুরূষদের থেকেও জ্ঞাণী ছিলেন এইসব মহিলারা।পাড়ার প্রতিটি ছেলেমেয়ের অলিখিত অভিভাবক এই সব মহিলারা। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে পাড়ার জেঠিমা কাকীমাদের আদর , কাকু জেঠুদের শাসন এবং তাদের ফাইফরমাশ খাটার সেই আনন্দ আমাদের ছেলেবেলাকে যে রঙিন কাগজে মুড়ে রেখেছিল তা আজ আবাসনের দেখনদারিতে পর্যবসিত। আমাদের পাড়ায় যে সব মানুষেরা বাড়ির মুনিশ বা ঠিকে কাজ করত তাদের একটা আলাদা দাপট ছিল। মা বাবার থেকেও তারা শাসন করতেন বেশি। মা কাকীমারাও তাদের শাসন মেনে নিতেন।
এটাই বোধহয় ভালোবাসা আর সম্মানের বন্ধন।আমার বাড়িতে রান্নার দেরী হলে প্রতিবেশীর বাড়ির মুড়িও অমৃত লাগতো। পাড়ার কয়েক ঘর টেলিভিশন সেটের সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ত গোটা পাড়া। বিশ্বকাপ হোক বা অমিতাভ_মিঠুনের সিনেমা, টিভির ঘর দখল করতো পাড়ার লোকেরা।আর হাসিমুখে তাদের চায়ের যোগান দিতেন বাড়ির বৌয়েরা।পাড়াটাই ছিল তখন পরিবার।
পাড়ার একটি মাত্র মাঠে প্রতিদিনের খেলা, ঝগড়া মারপিটের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত করা ছেলেবেলার মজা এখনকার প্রজন্ম জানেই না।
এক বাড়ির তালের বড়া পৌঁছে যেত অন্য বাড়ির ফুল ঠাকুমার পাতে।সেলাই না জানা মেয়ের স্কুলের সেলাই পাড়ার পিসির নিখুঁত হাতে পরীক্ষার আগে ঠিক তৈরী হয়ে যেত। পরের সন্তানকে দোষ না নিয়ে নিজের বাচ্ছার দোষ ধরা মায়েদের গুনে ছেলেমেয়েরা অজান্তেই মানুষ হয়ে উঠতো।রবীন্দ্র -নজরুল জয়ন্তীতে পাড়ার বয়স্কদের কাছ থেকে সাদা ধুতি, লালপাড় শাড়ি, পাড়ার নতুন বৌয়ের বিয়েতে পাওয়া সাজগোজের জিনিস সব জড়ো হোত গ্ৰীনরুমে। সেখানে পাড়ার মেয়ে বৌরা কলাকুশলীদের সাজাতে ব্যস্ত।আর থাকতো কয়েকজন মুশকিল আসান দাদা বা কাকুরা। এদের দৌলতে সব সমস্যার নিমেষে সমাধান হোত। আজকাল এরকম বাউণ্ডুলে পরোপকারী মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার।
সন্ধ্যারতি, শাঁখের আওয়াজ, তাসের আসর, মুদি দোকান, ঝগড়া, বিপদে একে অপরের পাশে থাকা এ সব নিয়েই একটা গোটা পাড়া আমাদের সে সময়কে ভরিয়ে রেখেছিল। ক্ষুদ্র স্বার্থ আর একা থাকার এ সময়ে ওই রকম একটা পাড়ার আজ বড় প্রয়োজন।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours