প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:

ইতিহাস পরম্পরার কথা বলে; নিরন্তর জীবনে সূর্য উদয় যে প্রকট থেকে প্রকট হয়, একথা মানা গেলেও, তার স্থায়িত্ব যে চির অমলিন একথা বলাটা নেহাতই অমূলক। কারণ সৃষ্টির সাথে লয় জড়িয়ে আছে জীবন।তাই ভাস্কর পণ্ডিতের স্থায়িত্ব বিলীন হলো অনায়াসে। বর্গিরা বর্ধমান, হুগলী, মেদিনীপুর, নারায়ণগড় পেরিয়ে এবার নবাব বাহিনীর চাপে ওড়িষ্যার  চিল্কা হ্রদে আস্তানা গেড়ে বসলো। নবাব আলিবর্দি খাঁ, মুর্শিদাবাদে ফিরে এলেন।  কিন্তু সুখ যে অসুখের আবাসস্থল, তাই মহাসংকট যেন আলিবর্দির জীবন ছেড়ে যেতেও চাইলো না।

 নবাবের চিঠি গেলো মহম্মদ শাহ ও মারাঠা শাহুর কাছে।  সফদর জঙ্গ এর হাতে  ভার পড়লো বিহার ; এবার গোদের উপর বিষ ফোঁড়া; পারসিক সেনারা এসে উপস্থিত হলো । কোথায় লাগে বর্গি, পারসিক সেনারা ছাড়িয়ে গেলো বর্গিদের; নবাব জানালেন মুর্শিদাবাদে সফদরকে তাঁর লাগবে না ; এদিকে বালাজি বাজীরাও ৫০,০০০ বর্গিসেনা নিয়ে পাটনা আক্রমণ করলেন। এই সেনা আবার অস্বাভাবিক নারী লোলুপ। তারপর লুঠপাট আর হত্যা তো দোসর তাদের; ভাস্করের দলবল চিল্কা থেকে ভগ্নমনোরথে ফিরে নাগপুর আক্রমণ করে। এবার রঘুজি ভোঁসলে,  অপমানে আবার আক্রমণে মন - প্রাণ নিমর্জিত করলেন;

আলিবর্দি বিচক্ষণ মানুষ। দ্রুত সাক্ষাতে এলেন গঙ্গাধর রাও ও অমৃত রাও। দুইপক্ষের সাথে সমঝোতা ছাড়া আর উপায় কি!  উপঢৌকনের  বিনিময়ে পদ হস্তান্তর, এতো ইতিহাসে একবার নয়!  নবাবও তাই করলেন। ৪ টি হাতি, ২ টি মোষ, ৫ টি ঘোড়া দিলেন বালাজিকে। আর এবার যে বর্গিহানা রোখা যাবে, তা নবাব বুঝেছিলেন। "সবে মিলে করি কাজ, হারি জিতে নাহি লাজ৷ " তাই তো পতনের ডঙ্কা বাজলো সেইদিন বর্গিদের। এদিকে রাজকোষে তখন মহাটান। মাঝখান থেকে রঘুজি বালাজির সাথে মিটমাট করে নিলেন। ভাস্কর পণ্ডিত তখন ময়দানে একা। রক্তের হোলি খেলা শুরু এবার। আলিবর্দির মাথা নত করতে বর্গিরা লুঠপাট, ধর্ষণ বাড়িয়ে দিলো। চারিদিকে আতঙ্ক, সন্ত্রাস, ভয়াবহ হানায় সাধু  সন্ন্যাসী কেউ রেহাই পেলেন না৷ আলিবর্দি অবাক  হলেন। কারণ তিনি তো উপঢৌকনে আদায় করেছিলেন প্রতিশ্রুতি, কি পেলেন!  আবার বালাজি ও ভাস্কর এক হয়ে গেলেন। আলিবর্দি কিন্তু ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। কারণ আর নয়!  বিপর্যয়ে  এবার মুস্তাফার সাহায্যে মারাঠা সেনাপতি কারিওয়েলকে হস্তগত করলেন। শুরু হলো সন্ধির প্রস্তাব৷ 
এবার বলবো দিগনগরের কথা; এই স্থান কি বর্গি হানার সাথে যুক্ত!  কেন বিখ্যাত এই দিগনগর৷ এইস্থানেই নাকি ভাস্করের সাথে নবাবের সন্ধি হয়েছিলো। আসুন!  একটু বিস্তৃত করে বলি ; কিংবদন্তি বলে যে, পূর্ব বর্ধমানের বিস্মৃত মানচিত্র ধরে আছে দিগনগর গ্রামের চাঁদনি,একটি জলটুঙি। সময়টা ১৭১০ ; কীর্তিচন্দ্র চতুর্দিক বাঁধানো জলাশয়ের মাঝেই ভবন তৈরি করলেন৷ কিংবদন্তি বলে, বর্ধমান ছিলো দিল্লীর সম্রাটদের একান্ত  নিরাপদ আশ্রয়। তাই তো প্রিয় ঘরে গড়ে উঠেছে পীর, ওলি,আওলিয়াদের মাজার, মসজিদ, পুকুর ইত্যাদি৷  বিবিধ প্রান্তের মন্দির ও মসজিদের কারুকার্য বর্ধমানের স্থাপত্যকে সম্বৃদ্ধ করে। আসলে মোঘল আমলে বর্ধমানকে বলা হতো সম্ভ্রান্তদের বাসস্থান৷ উল্লেখ্য যে আইন - ই - আকবরী অনুসারে  সমগ্র বাংলা ১৯ টি সরকারে বিভক্ত করা হয়েছিলো। তার মধ্যে বর্ধমানের উল্লেখ আছে। 

শাহাজাহান, শেরশাহ, নূরজাহান থেকে আজিম - উস - সান -ই বর্ধমানে এসেছিলেন। তথ্য বলছে বর্ধমানের পুরাতন চকের খোক্কর সাহেবের মাজারের কাছে কালো মসজিদ শেরশাহ ৯৫০ হিজরিতে তৈরি করেন। তথ্য বলে যে, এই জলটুঙিতে মেহফিল বসতো৷ চাঁদনির ছাদ, নৈশবাসর, অনেকটা অতীতে ফিরিয়ে দেয় আমাদের। এখন সেই ইতিহাস প্রেত ছায়া ছাড়া আর কিছুই নয়। এই দিগনগরের পুরাসম্পদ পার্বতী মূর্তি, আসলে অমরাগড়ের রাজবংশের কুলদেবী। এই দেবীমূর্তি বর্গিরা হরণ করে নিয়ে যায়। শোনা যায় ভাস্কর সময়পেলেই এই দিগনগরে পার্বতী আর চামুন্ডার পুজো দিতেন৷
এখানেই নাকি ভাস্কর জানতে পারেন যে, আলিবর্দি সন্ধি পিয়াসী। কিন্তু যার রক্তে ধূর্ততা আর বিশ্বাসঘাতকতা, তাকে তো আর স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে মেনে নেওয়া যায় না। কারণ কাক সবার মাংস খায়, কিন্তু কাকের মাংসের খেলেই কাক, কা - কা করে।

 এবার ভাস্করের বিশ্বাস লাভ করতে গঙ্গাজল ও তুলসীপাতা দিয়েই শপথ করানো হয়৷ এরপর সন্ধি হয় যে, উভয় পক্ষ নিরস্ত্র থাকবে৷ এতো গেলো ঘোষণা,  এবার সন্ধির সভা স্থান হলো মানকরা গ্রাম৷ সেখানেই তৈরি হলো একাধিক বাহারি পটমন্ডপ। চারপাশে সুচতুর কৌশলে ডবল কানাত দিয়ে দেওয়াল তৈরি হলো। সেখানে লুকিয়ে রাখা হলো নবাব সৈন্যদের। এই হলো আলিবর্দি ; যতই গালিচা পেতে রাস্তা হোক, তাঁবু হোক, কিন্তু আলিবর্দি তো বশ্যতা স্বীকার করবেন না৷ ভাস্করের সঙ্গে এলো ২১ জন সেনাপতি৷ ভাস্কর জানতেন, যে আলিবর্দির উপর বিশ্বাস রাখা মানে অতিরিক্ত বিশ্বাসে খাল কেটে কুমীর আনা। তবুও বিশ্বাস করলেন, রয়ে গেলেন পলাশির বর্গিঘাঁটিতে৷ পলাশি থেকে ভাস্করের দূরত্ব ১৮- ২০ কিমি; রঘুজি গাইকোয়েড বললেন, তাঁর শরীর খারাপ। কারণ অজুহাত ছাড়া তখন তাঁর মন আর কিছুতেই সায় দিচ্ছিলো না। ভাস্কর এলেন পটমন্ডপে। সাদর অভ্যর্থনা দিলেন মুস্তাফা খাঁ ও জানকীরাম।  তারপরে একটু গুছিয়ে নিতেই নবাব আলিবর্দি আদেশ করলেন, "হত্যা কর এই কাফেরদের! " তথ্যসূত্র বলে, আলিবর্দির আদেশে সৈন্যরা কচুকাটা করছিলো  ভাস্কর বাহিনচম। ভাস্করের মুন্ডচ্ছেদন করলো আলিবর্দির বাহিনী।  বাংলার আকাশে রক্তের স্রোতে শান্তি নেমে এলো। নবাব খুব আনন্দিত হয়ে ১০ লক্ষ টাকা বিতরণ করলেন ; স্থিমিত হলো বর্গিরাজ..। শান্ত  বাংলা আবার।

তথ্যঋণঃ 
১) বঙ্গে বর্গিহাঙ্গামা ইতিহাস ও কিংবদন্তি.. 
 স্বপনকুমার ঠাকুর 
২) "গিরিয়ার প্রথমযুদ্ধের গ্রাম্যকবিতা " মুর্শিদাবাদ কাহিনি, নিখিলনাথ রায়
৩) ইন্টারনেট  উইকিপিডিয়া 
৪) বর্ধমান সহায়িকা 
৫) অন্নদামঙ্গল কাব্য 
৬) প্রচলিত লোকগাথা 
৭) বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস 
৮) "মহারাষ্ট্র পুরাণ" 
৯) "বণিক বার্তা " ( ইন্টারনেট)  
১০) "বঙ্গদর্শন " ( ইন্টারনেট)  
১১) ইতিহাস অভিধান 
১২) পলাশির অজানা কাহিনি,  সুশীল চৌধুরি
১৩) " বঙ্গদর্শন ইতিবাচক বাংলা " 
১৪) bengali.koulal.com
১৫) অন্যান্য 
১৬) আইন- ই - আকবরী

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours