সজল বোস, সমাজকর্মী, দুর্গাপুর:

সাড়া বৃটেন তোলপাড় তার সাথে তোলপাড় গোটা বিশ্ব। কারন সন্ত্রাসের আঁতুড় ঘরের গৃহবধূ  অদম্য আইনী লড়াইয়ে জয়। বৃটেনের নাগরিকত্ব নিয়ে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত শামীমা বেগম বৃটেনে ফেরার আপিল করতে পারবে আদালতের রায়ে।

কিন্ত কে এই শামীমা? কেন বৃটেনে ফিরতে চাই? কোথা থেকে ফিরবেন? কি, কেন, কোথায় এতো প্রশ্ন মাথার মাঝে ঘুরছে বনবন। তাহলে দেখেনি কি ভাবে একটি মেয়ে উঠে এলো আজকের চর্চাতে?  কেন খ্যাত হলো আই এস বধু নামে? 

বছর পনেরো বয়সী শামীমা আর দশজন কিশোরীর মতোই ছিল তার জীবন। বয়ঃসন্ধিকালীন নানা দুশ্চিন্তা, মিথ্যা মোহ, খামখেয়ালি- কোথাও কোনো ছন্দপতন ছিল না। সাহিমার দিদির মতে শামীমা একেবারে সাধারণ একটি মেয়ে ছিলো। সমবয়সী অন্যান্য ব্রিটিশ মেয়েদের দেখাদেখি সারাক্ষণ অনুসরণ করে বেড়াত কার্দাশিয়ান বোনদের। কিন্তু হলিউডের ঘোর লাগা দৃষ্টি ছাড়াও দুনিয়াকে একেবারে নতুন করে আবিষ্কার করার এক দুর্বার আকর্ষণ ছিল শামীমার কিশোরী মনের।

উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার আর মাত্র মাস চারেক বাকি। ব্রিটেন প্রবাসী বাংলাদেশি বাবা-মা'র কন্যা শামীমাকে এককথায় সবাই মেধাবী, প্রগতিশীল আর বুদ্ধিমতী বলেই সকলেই জানত। কাজেই তাকে নিয়ে সবার প্রত্যাশার পারদও ছিল গগনচুম্বী। ঘুণাক্ষরেও কেউ টের পায়নি বেথনালের এই শিক্ষার্থী তখন চুপিসারে পরিকল্পনা করছে ঘর থেকে পালিয়ে লন্ডনের পূর্ব প্রান্তে এক পরিচিত ব্যক্তির বাসায় ওঠার, যেখান থেকে সে নির্বিবাদে সিরিয়ায় পালিয়ে গিয়ে হতে পারবে জিহাদি বধূ! ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড লেভান্ত বা আইএসআইএল-এ (বর্তমান আইএস) যোগ দেয়াই ছিল তার প্রধান লক্ষ্য।

অল্পবয়সী নরম মনে জিহাদী ভাবনা সিরিয়ার ধ্বংসস্তূপ আর আক্রমণ দেখে প্রভাব পরে। স্কুলে শামীমার ও তার দুই বান্ধবী, খাদিজা সুলতানা এবং আমীরা আবাসির উপর, এই দুই বান্ধবীর সাথে পরিচয় ছিল শারমীনা বেগমের, মাস দুয়েক আগে সে সিরিয়ায় পাড়ি জমিয়েছে। পাঁচ সদস্যের এই পরিকল্পনাকারী দলের মধ্যে শারমীনা যে ফ্লাইটে পালিয়েছে সেই ফ্লাইট থেকেই একজনকে আটক করে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড। কিন্তু তাদের নাকের নীচ দিয়ে পালিয়ে যেতে সমর্থ হয় প্রথমে শারমীনা, আর তারপরে পালা আসে বাকি তিনজন। ইনস্টিটিউট ফর স্ট্রাটেজিক ডায়ালগের তথ্যানুযায়ী, শুধুমাত্র ২০১৫ সালেই আনুমানিক ৫৫০ জন নারী ও কিশোরী পশ্চিম দেশসমূহ থেকে আইএস বা ইসলামিক স্টেটে যোগদানের উদ্দেশ্যে বাড়ি ছেড়েছে। আই এসের এই ভয়ংকর জলে জড়িয়ে পরে, শামীমারাও ছিল সেই দলেরই সদস্য, যারা আইএসের মূলমন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বেচ্ছায় সিরিয়ায় পাড়ি জমিয়েছে। প্রভাব এতটাই যে জেহাদে নিজেকে উৎসর্গ করতেই জিহাদিদের বধু হয়ে তাদের সন্তানকেও জিহাদী করতে পিছপা হয় নি। সেদিন কি বুঝতে পেরেছিলো তারা কোন অন্ধকারে তারা পা বাড়াচ্ছে। 

২০১৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারির সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, শামীমা, খাদিজা ও আমীরা শীতের পোশাক হুডি পরে, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা লাগিয়ে হাসিমুখে গ্যাটউইক বিমানবন্দরে পায়চারি করছে। তাদের দেখে এতটাই শান্ত আর নিশ্চিন্ত লাগছিল যে, মনে হচ্ছিল, তারা যেন স্কুল থেকে কোথাও শিক্ষাসফরে যাচ্ছে। তুর্কি এয়ারলাইন্সের মাধ্যমে সেখান থেকে ইস্তাম্বুল পৌঁছায় তারা। সুনিপুণভাবে ফন্দি এঁটেছিল মেয়েরা। বাড়ি থেকে সোনার গহনা চুরি করে বিক্রি করে ফ্লাইটের টিকেট কিনেছে, আরও কিছু নগদ অর্থ যেন হাতে থাকে তা-ও নিশ্চিত করেছে। সিরিয়ার যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকার যেখানে আইএস খেলাফতি করছে, সীমানা পেরিয়ে তাদের সেই অবধি পৌঁছে দেয়ার চুক্তিতে এক লোককে ঐ টাকা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় শামীমারা।

শারমীনা সিরিয়ায় পালিয়ে যাওয়ার পর স্কুলে যতজন মেয়েকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, তাদের মধ্যে এই তিনজনও ছিল। কিন্তু সাফল্যের সাথে পুলিশকে ধোঁকা দিতে সমর্থ হয় তারা।  রাশিয়ান এক বিমান হামলায় নিহত হয়েছে খাদিজা। ১৯ বছর বয়সী শামীমা উত্তর সিরিয়ার এক শরণার্থী শিবিরে তৃতীয় সন্তান জন্ম দেয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। প্রথম দুটি সন্তান অপুষ্টিজনিত কারণে মারা গেছে। আমীরা আর শারমীনাকে শেষবার জীবিত দেখা গেছে গত বছরের জুন মাসে আইএস অধ্যুষিত এক এলাকায়।

এদিকে অত্যাচারে, লাঞ্ছনার স্বীকার, গণধর্ষণে জেরবার দুটি সন্তান হারিয়েছে শামীমা, তার যোদ্ধা স্বামী শত্রুশিবিরে বন্দী। সিরিয়ায় আসা নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই তার। কিন্তু অনাগত সন্তানের নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করায় আইএসকে পরিত্যাগ করেছে শামীমা। গত চার বছরের প্রতিটি দিন ভাগ্যের জোরে যুদ্ধ-বিগ্রহের সাথে লড়াই করে টিকে থাকা জিহাদি বধূ শামীমা এবার বুঝতে পারছে সে কত বড় ভুল করে ফেলেছে তাই ঘরে ফিরতে চায়। ভুল সুধারাতে চাইছে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তে লড়তে ক্লান্ত মেয়েটি আবারও ব্রিটেনের পানে ফিরে যেতে চায়।
দুঃস্বপ্নের সেই কথা গুলো মনে পড়লে গা শিউরে ওঠে। মনে পরে রাক্কার পথে শামীমারা যখন সিরিয়ায় পৌঁছায়, আইএসের ডাবল এজেন্ট মোহাম্মদ রশিদ তাদের বোন বলে ডেকে সিরিয়ান পাসপোর্ট হাতে ধরিয়ে দেয়। আবু জেল্লার এক অবৈধ সীমান্ত দিয়ে চোরাই পথে সিরিয়ায় ঢোকে তারা। আইএসের এক সেফ হাউজে রাখা হয় তাদের, যাবতীয় কাগজপত্র, পরিচয়পত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় রাক্কা এলাকায়। প্রথমদিন তাদের ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখা হয় উম লাইথ নামক এক নারীর জিম্মায়। মেয়েদের মন থেকে পশ্চিম অপসংস্কৃতি ঝেড়ে-মুছে শরিয়াহ মোতাবেক সঠিক জীবনবিধানের শিক্ষা দেয়ার দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল উমের উপর।

প্রথম সপ্তাহে আইএসের কেউ তাদের উপর আস্থা পোষণ করেনি। আইএসের কোনো সদস্যের সাহচর্য ছাড়া ঘর থেকে বের হওয়ার অনুমতি ছিল না তাদের। শরণার্থী শিবিরে বসে সাংবাদ মাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দেয়ার সময় সে দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করে শামীমা। তারা বারংবার উমকে জিজ্ঞেস করত কেন অন্য নারীদের কাছে তাদের পাঠানো হচ্ছে না। তখন কোনো উত্তর না আসলেও পরবর্তীতে বুঝতে পারে তারা গুপ্তচর কি না তা নিশ্চিত না হয়ে তাদেরকে কোথাও পাঠানো হবে না। খুব শীঘ্রই বিয়ে দিয়ে দেয়া হয় শামীমাদের তিনজনের। খাদিজার বিয়ে হয় সোমালিয়ান এক জিহাদির সাথে। আমীরার বিয়ে হয় ১৮ বছর বয়সী অস্ট্রেলিয়ান জিহাদি আবদুল্লাহ আলমীরের সাথে। বিয়ের কিছুদিন পরে বিমান হামলায় মারা যায় আবদুল্লাহ। আর শামীমার বিয়ে হয় ধর্মান্তরিত ডাচ মুসলিমের সাথে। শামীমার কথা মতো তার জীবন ছিল একেবারে ‘স্বাভাবিক’। চারদিকে বোমা আর মৃত্যুর ঝুঁকি ছাড়া আর সবকিছুই তার খুব সহজ-স্বাভাবিক লাগছিল। চোখের সামনে কোনো হত্যাকাণ্ড না দেখলেও ময়লার স্তূপে কাটা মুণ্ডু দেখার অভিজ্ঞতা ছিল তার। আবেগহীন আর ধীরস্থির মস্তিষ্কের এক নারী যেন আটকা পড়েছে ১৯ বছর বয়সী শামীমার শরীরে। দুটি সন্তান হারানোর কষ্টও খুব বেশি দমিয়ে রাখতে পারেনি তাকে। তবে তৃতীয় সন্তানের বেলায় যেন একটু বেশি সচেতন সে। এ কারণেই ব্রিটেনে ফিরে যাওয়ার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেখানে গেলে অন্তত বাচ্চাটা অপুষ্টিতে মারা যাবে না এটুকু সে নিশ্চিত। খাদিজার কথা প্রায়ই মনে পড়ে তার। বিশ্বাসঘাতক এক গুপ্তচরের পাল্লায় পড়ে অকালে প্রাণ হারাতে হয় মেয়েটাকে। 
তবে পরিবারের অটুট মনোবল ছিল একদিন না একদিন শামীমা ফিরে আসবেই।

শারমীনার বাবা মোহাম্মদ নাজিমউদ্দিনের দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ব্রিটিশ সরকারের উচিত মেয়েদেরকে দেশে ফেরত আনা। তারা যেমন কষ্ট পাচ্ছে, তেমনি প্রতিটি মেয়ের পরিবারই তো কষ্ট পাচ্ছে। মেয়েরা ভুল করেছে এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কিন্তু তাই বলে আরেকটা সুযোগ তারা পাবে না, এটা তো হতে পারে না। দেশ থেকে পালানোর সময় মেয়েগুলো ছোট ছিল, তাদের মগজ ধোলাই করে এই কাজ করানো হয়েছে। এবার পূর্ণবয়সে ঐ ভুলের পথে তারা আর পা বাড়াবে না এমনটাই মনে করেন নাজিমউদ্দিন।সিরিয়ায় একসাথে গেলেও আইএস তাদেরকে এক জায়গায় থাকতে দেয়নি, একেকজনকে রাখা হয়েছে একেক এলাকায়। শরণার্থী শিবিরে এসে বেথনাল গ্রীন অ্যাকাডেমির এক মেয়ের সাথে দেখা হয়ে গিয়েছে শামীমার। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস কাকে বলে বুঝতে পেরেছে দুজনই। বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য বেপরোয়া হয়ে ওঠা মেয়েদের ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। শামীমা জানায় মেয়েরা সবাই যে চলে আসতে চাইছে, এমনটাও নয়। যাদের স্বামী মারা গেছে, স্বাধীন নারী হিসেবে ভবিষ্যৎ কর্তব্য ঠিক করা তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব। নিজেকে সে এখন একজন মানুষ নয়, একজন মা হিসেবে দেখছে। সুস্থ একটি সন্তানের মা হয়ে বাকি জীবন কাটানো তার প্রধান লক্ষ্য।

ব্রিটিশ সরকার বলছে যেহেতু তারা আইএসে যোগ দেয়ার জন্য অনুতপ্ত নয়, তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে সরকার তাই সন্দিহান। দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের ফেরত আনতে চাইছে না সরকার। এদের মধ্যে কয়েকজনের নাগরিকত্ব বাতিল করে দেয়া হয়েছে ইতোমধ্যে। শামীমার ব্যাপারেও একই রকম সিদ্ধান্ত নেয়ার চিন্তা করছে যুক্তরাজ্য। তারা শামীমাকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিতে।
তার পরই শুরু হয় হয় নিজের নাগরিকত্ব ফিরে পাবার আইনী লড়াই। 

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত শামীমা বেগম তার নাগরিকত্ব নিয়ে আইনি লড়াইয়ের জন্য ব্রিটেনে ফিরতে পারবেন বলে আপিল আদালত যে রায় দিয়েছে তাতে খুশি শামীমা বেগমের বাবা। আরও বলেছেন তার মেয়ে “ন্যায় বিচার” পাবে বলে তিনি আশা করেন। তবে ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠীতে যোগ দিতে সিরিয়ায় যাওয়া বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত শামীমা বেগম ব্রিটেনের সরকারের বিরুদ্ধে এই আইনি লড়াইয়ে জয়লাভ করলেও তাকে আরও কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে বলে জানিয়েছেন তার আইনজীবী।

তার আইনজীবী তাসনিম আখুঞ্জি বলছেন, পুরো বিষয়টা এখন নির্ভর করছে ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওপর।

তারা যদি ব্রিটেনের আপিল আদালতের আজকের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে, এবং যেটা করতে হবে আগামী সোমবারের মধ্যে, তাহলে মামলাটা চলে যাবে সুপ্রিম কোর্টের হাতে আর সুপ্রিম কোর্টের রায়ই হবে চূড়ান্ত। তাসনিম আখুঞ্জি জানাচ্ছেন, মিস বেগম এই মুহূর্তে বন্দিজীবন কাটাচ্ছেন উত্তর সিরিয়ার আলরোজ ক্যাম্পে। তার আইনজীবীরা বলছেন, এই রায়ের অর্থ হল, ২০ বছর বয়সী শামীমা বেগম যাতে লন্ডনের আদালতে হাজির হতে পারেন সরকারকে তার ব্যবস্থা করতে হবে।

তবে যাই হোক কচি মাথা গুলোকে চিবিয়ে খাবার জন্য সন্ত্রাসের যে জঘন্য খেলা শুরু হয়েছে, বিবেক চেতনাকে যারা প্রতি মুহূর্তে পঙ্গু করছে তাদের প্রতি সামাজিক ঘৃণা তৈরী হোক, ভুল বুঝে যারা এভাবে অন্ধকারের চলে যাচ্ছে তাদের কাছে বৃহত্তর মানবিক সমাজের অভিমুখে ধরে রাখতে আসুন সুন্দর স্বপ্নময় ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে নতুন দিগন্তের পথ গুলো উন্মোচিত হোক বিশ্ব দরবারে। 

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours