মোঃ মাসুদ হাসান, ফিচার রাইটার, রঘুনাথগঞ্জ:

হিন্দুত্ববাদী‌দের একটাই স্বপ্ন ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা। তা বেশ ভালো কথা, কিন্তূ হিন্দুরাষ্ট্র হলেই কি দেশের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? কখনও নয়। আসলে বিষয়টি হল, মানুষ যখন একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করে তখন তারা বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্ৰহণ করে থাকে, সেগুলি হোক উত্তম বা অধম । সংবিধান মেনে তো নয়ই, বরং সংবিধানের সম্পূর্ণ বিপরীত হলেও একশ্রেণীর মানুষ সেটাকেই  কার্যকর করার জন্য উঠে পড়ে লেগে যায়। আর সেটা হল 'হিন্দুরাষ্ট্র' প্রতিষ্ঠার শ্লোগান। 

ভারতের একটা বিশেষ অরাজনৈতিক সংগঠন (যা বর্তমানে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলগুলোকেই পরিচালনা করছে) জাতির সামনে দুটি সবচেয়ে বড়ো ইস্যূ খাড়া করেছে-
 ১) ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা ও
২) যে কোন ভাবেই হোক ভারত থেকে বিদেশীদের (মুল টার্গেট মুসলিম)বের করে দেওয়া ।
আর এই দুটি ইস্যুতে জাতি দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেছে : একদল খুশিতে ডগমগ হয়ে লক্ষ্য অর্জনের পক্ষে যা খুশি তাই করে চলেছেন , আরেকদল বিপক্ষে যারা সংবিধান বাঁচাতে বদ্ধপরিকর এবং দেশের উন্নয়নের প্রকৃত আশাবাদী (কিন্তূ এখন প্রথম দল দেশপ্রেমী ও দ্বিতীয় দল দেশদ্রোহী হিসাবে প্রচারিত হচ্ছে)। প্রথম দলের নিকট ঐ দুটি বিষয় ছাড়া দেশের অন‍্যান্য বিষয় যেমন খাদ‍্য-বস্ত্র-বাসস্থান সহ আর‌ও যা যা সমস্যা মানুষের থাকতে পারে, সমস্ত বিষয় গৌন হতে হতে ধূসর হয়ে গিয়েছে। তারা মানুষের মনে নিজেদের ভাবধারা কে এমন ভাবে প্রচার করছে যে, পরিস্থিতি যখন তাদের অনুকূলে চলে যায় তখন এমন হয় যে, দেশের মুখ্য বিষয়গুলো নিয়ে আওয়াজ তোলাটাই অপরাধ হয়ে দাঁড়ায়। সরকার‌ নয়, জনগণ‌ই তখন এটাকে অপরাধ হিসেবে দেখতে শুরু করে।

 ইংরেজ আমলে ভারতবাসীর প্রধান লক্ষ্য ছিল 'স্বাধীনতা'। আর এটা অর্জন করার জন্য ভারতবাসী এমন মরিয়া হয়ে উঠেছিল যে, তাদের কাছে অন্ন -বস্ত্র - বাসস্থান সহ যাবতীয় মৌলিক চাহিদাগুলিই গৌণ হয়ে গিয়েছিল এবং চাপা পড়ে গিয়েছিল অন‍্যান্য সমস্ত অভাব-অভিযোগ-অনুযোগ। আর এটাই হয়। যখন বড়ো কোনো লক্ষ্য সামনে আসে, হোক সেটা ভালো বা খারাপ, জনগণ তখন গৌণ বিষয়গুলো ভুলে যায়। যাওয়া‌টাই স্বাভাবিক। 
হিন্দু‌ত্ববাদীদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে তাদের শ্লোগানে দুর্নীতি দমন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, অপরাধ নির্মূলের মতো বিষয়গুলো খুবই কম কিন্তূ রামমন্দির নির্মাণ, মুসলিম বিতাড়ন, সীমান্ত সমস্যা , আযান কুরবানী অর্থাৎ ইসলামী কালচার নির্মুলিকরনের মতো বিষয়গুলো বেশি বেশি জায়গা পায়। এবং এগুলোর সঙ্গে সবার উপরে থাকে 'হিন্দু রাষ্ট্র' প্রতিষ্ঠার সুপ্ত ঘোষণা।

দীর্ঘদিন ধরে এইসব শ্লোগান শুনতে শুনতে দেশের হিন্দু জনগোষ্ঠীর বড়ো একটা অংশ এইসব শ্লোগানে আকৃষ্ট হয়েছে, বিশ্বাস করেছে এবং মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েছে। এজন্য তাদের কম কসরত করতে হয়নি। দেশের বহু স্থানে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধাতে হয়েছে ,  মুসলিমরা খারাপ- যেকোনো মূল্যে এটা প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে , মন্দির-মসজিদ সমস্যা তৈরি করা হয়েছে , অনেক মুসলিমের অর্থনৈতিক দূরবস্থার সুযোগ নিয়ে তাকে জঙ্গী সাজানো হয়েছে , অনেক হিন্দু ভাইকেউ মুসলিম সাজিয়ে নানান ধরনের কুকীর্তি করানো হয়েছে , যার ফলে দেশের কিছু মানুষ বিশ্বাস করে নিয়েছে একমাত্র হিন্দুরাষ্ট্র‌ই সব সমস্যা‌র সমাধান। এবং হিন্দু‌রা সত্যিই বিপদে আছে। ফলত এখন আর তাদের চোখে পড়েনা সরকারের দুর্নীতি, উন্নয়নের ব্যর্থতা, অর্থনৈতিক দূরবস্থা, অন্ন বস্ত্র বাসস্থনের অভাব, সমস্ত কিছুর বেসরকারিকরন, করোনাসহ যাবতীয় মহামারী অতিমারী নিয়ন্ত্রণে সরকারি ব্যর্থতা সহ হাজারো বিষয়। তারা ভুলেই গেছে দেশে সংবিধান বলে একটা জিনিস আছে, আইন বলে কিছু একটা আছে। তাই তারা গরুর কারণে মানুষ পিটিয়ে হত্যা করতে পারে, সামান্য চুরির অপরাধে মব লিঞ্চিইং করতে পারে, ছোটোখাটো অজুহাতে বৃহৎ জাতি দাঙ্গাও বাঁধাতে পারে । 'বহিরাগত তত্ত্ব' খাড়া করে মুসলিম নিধন করতে পারে। যে 'বহিরাগত' তত্ত্বের মাধ্যমে মুসলিম ও অন‍্য জাতিদের ভারতীয় হিসেবে তারা সহ‍্য করতে চায়ছে না, সেই এক‌ই তত্ত্ব অনুযায়ী হিন্দু‌দের‌ও যে ভারতে কোনো অধিকার থাকে না ভারতীয় উপমহাদেশের উপর, সেটা তারা জেনেও জানছে না, বুঝেও বুঝছে না। তারা তো স্পষ্ট জানে যে আর্যরাও 'বহিরাগত'। আর এটাও জানে যে, এভাবে পিছোতে থাকলে দেখা যাবে ভারতে যতগুলো জাতি এখন বসবাস করে, 'আদিবাসী' বাদে আর সবাই 'বহিরাগত'। আদিবাসীদের বংশধররা হল সাঁওতাল, পাখীরা,  ভীমের মতো আদিবাসী‌রা। তাহলে কি এখন এদের হাতে দেশ ছেড়ে দিয়ে আমাদের সবারই দেশান্তরী হ‌ওয়া উচিত নয়?

হিন্দুত্ববাদী‌রা এসব শুনেও না শোনার  ভান করে এবং প্রশ্নকর্তা‌কে‌ই তারা দেশদ্রোহী আখ্যায়িত করে থাকে। কারণ, তারা এখন বড়ো একটা লক্ষ্যে আবিষ্ট হয়ে আছে। আর সেটা হল 'হিন্দুরাষ্ট্র'।
কিন্তূ তাদের এই হিন্দুরাষ্ট্রই যে একদিন বুমেরাং হবে তাদের তৈরি আইনই একদিন তাদেরকেই বিদেশি বানাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। 

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours