প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:
পাঠান মানেই সহনশীলতা হীন এক প্রেক্ষিত৷ ক্রোধ, দমনের যেন উপায় নেই। কিন্তু মনভ্রমরা বলে, মনকে আগলে রেখে শুধুই কি কাঁদবে জীবন! এমন করে তো কেঁদে উঠলে অভ্যস্ত হতে হয়।
আজ আমার কলম ধরতে গিয়ে বুকটা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। শরীর তো গভীর এক নদীর মতো, অবগাহনেই নাকি নিঃসীম আনন্দ আসে৷ কিন্তু, মনের তো এমন নদী নেই। তাই আঘাতে আঘাত পায়, আনন্দে আনন্দ। জানেন যতই ভাবি কাল কেঁদেছি, আজ আর কাঁদবো না, প্রতিধ্বনির মতো আরো এক ঘোর আকাল চোখের সামনে এসে দাঁড়ায়।বলুন না, খুব খিদে পেলে কি আর বিবেক, চেতনা.. এইসবের প্রশ্ন আসে!! এটা অনেকটা ভেজানো দরজা ঠেলে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা, উচাটনের দেহ... খাবার, আশ্রয়, বাসস্থান।
এটি আমাদের দেশের ছবি নয়, বিদেশের। তাতে কি!! মানুষ তো আমরা সবাই। জানেন মেয়েটিকে প্রশ্ন করা হয় নাম কি তোমার! মেয়েটি জানে না। যেন মনে হচ্ছে সংক্রামিত হয়েছে ভাষা। এই ছোট্ট ফুলটি শুকনো পাপড়ির মতো এইটুকু জানে, বাবা মারা গেছে।মানচিত্রের মতো বলিরেখা আর রাখলাম না। আমিও যে মানুষ ; ভুলি কি করে "ধর্ম " মানে সকলের মঙ্গল সাধন। কিন্তু এই সমাজে অনাহারের নদীর জলে হাত ধুতে ধুতে আমিও দুর্ভিক্ষের চাঁদের প্রতিনিধি হয়ে গেছি।
পাপপুন্যের বুকে সোজা পায়ে আমি হাঁটতে পারি না। ঝাপসা চোখের আলোয় তৃষিতের জল চোখে পড়ে।অন্নহীন মুখে প্লাবনের ঊর্ধ্বমুখী মুঠি আমাকে কাঁদায়। ডাস্টবিনের খাবারের কথাগুলো যেন রিক্ত পেটে ধ্রুবতারা জ্বালায়। নিত্য অভিষেক হয় আমার। আমিও লক্ষ যোজন দূরে একা হয়ে যাই, আমি আর আমার অনাহারের শিব- আলোহীন, যন্ত্রণার পাহাড়।
তবুও ভাতের থালায় ভাত, ডাল, আলুসেদ্ধ রোজ ড্রেনে ফেলতে দেখি। বিশ্বাস করুণ, অন্ধমুনির সন্তানের মতো আমরাও হোটেলে রেস্টুরেন্টে স্ট্যাটাস দেখাই, অনিচ্ছায় খাবার ফেলে উঠে যাই। দারিদ্রের হাড়্গুলো যে দিনের শেষে আজও বলে, "ফ্যান দাও " আমায়৷
আমরা ডায়েট করি; লম্বা চিৎকারে যোগাসন ; বেছে বেছে তিনঘন্টায় খাওয়া, সকালে ব্রেকফাস্ট, দুপুরে লাঞ্চ, রাতে ডিনার... ; যার কাছে খাবার নেই তার কাছে কিসের ব্রেকফাস্ট, কিসের লাঞ্চ.. বলুন না। আসলে পেট তো কুয়াশার সঙ্গে মিশে যায় বিষন্নতায়.. তখন আপনাদের ফেলে দেওয়া ডাস্টবিন বেছে নিতে হয়। কি বিস্ময়ের সমাজ তাই না!! আমরা কামনায় এই নশ্বর দেহের কাছে ঋণ করি, কিন্তু বধ্যভূমিতে অনাহারে ছিঁড়ে ফেলি ফুল.. উফফ! আর কতো!! রাগ হলে খাওয়ার টেবিলে থালা ফেলে দেয় যারা, তারা মনে হয় শুদ্ধ আলোর মায়া কাটিয়ে ফেরা বিপুল কণিকা৷ দিশাহারা ব্যথাগুলো আকাশ ফাটিয়ে কাঁদে, আমার হৃদয় অভিমানী হয়.. হে আলো!! স্বপ্নভাঙা মাঝরাতে আর কাঁদিয়ো না, ঘরে ঘরে অন্ন দাও, অনাথের মুখে ভাত, বুকে চেতনার আলো।
খুব কষ্ট হয় শব্দে প্রকাশ বার বার। বড্ড বেমানান লাগে মনে, নিজেকে মানুষ পরিচয় দিতে। দুটো পেটকে ভালোবাসতে পারি না, কিন্তু সমাজের বুকে অনাহারে দারিদ্রক্লিষ্ট প্রাণকে নিজেদের হাতে হত্যা করতে পারি আমরা।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours