প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:
 
এক নিঃসঙ্গ অভিযাত্রী জীবন, ইলা; বৈবস্বতের একমাত্র কন্যা তিনি; বিদ্রোহী অভিযানে আজ ঈশ্বরের পথে হেঁটে চলেছেন, একা; "জাগো! নারী, ইলার মতো"; পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করেও পিতা পুত্র সন্তান পেলেন না; ইলা তাই তাঁর পুরুষত্বের কলঙ্ক; অবাঞ্ছিত ইলা, ডুগরে কাঁদছেন নিত্য; তবে কি কন্যা হয়ে জন্ম নেওয়াটাই অপরাধ! অনাদর অপমানে স্বপ্নভঙ্গ হলে, আকন্ঠ বিষপান শ্রেয় মনে হয়।

 আচ্ছা বিধাতা পুরুষ কি রসিকতা করেছেন! আজ মনে ভেবেছেন মনু; ইলা, তাঁর অন্তর্দ্বন্দ্বের ছিন্ন তরঙ্গ। না, এটা সহ্য করা যায় না; মানবী তো অপরাধী নন, তবু ইলাকে আপন নারীত্বের বলি দিয়ে পুরুষের সাজে সাজাতে হয় তাঁকে, এও কি কম অসুখ! কিন্তু, নাম পাল্টে সুদ্যন্ন রাখলে বুঝি দাঁড়কাক ময়ূর হয়ে যায়! অপমান আর লাঞ্ছনা আজ আর মনের গহ্বরে "ছিঃ" বলে ভৎর্সনা করে না, বরং সইতে শেখায়। যে নারীকে ভাত কাপড়ের ভারে, অলংকরণে ভরিয়ে সাজিয়ে রেখেছে, সেই পরিচয় যদি একটু একপেশে সাজে ঠুনকো অস্তিত্বের মণিদীপা হয়ে জ্বলে, ক্ষতি কি!  বোবা কান্নার আর্তনাদ, এমন করে ভাবতে নেই। 

নারীর কি প্রভুর উপর জমানো ক্ষোভ উপড়ে দিতে আছে! ছিঃ, অমঙ্গল হয় দাসত্বের! তৃপ্তির সুখে যদি বেহিসাবি গড়নে গ্লানি আঁকা যায়, তাতে আর যাই হোক পরিতৃপ্তির সুরটা হৃদয় ছুঁয়ে দেয় না। দাসত্ব ছুঁয়ে থাকবে সিঁথি, শিকল ধরে বইতে হবে পলা, লাল রাঙা আবীর গোলাপী আভরণে প্রেমের বুকে চন্দ্রকলা হতে হবে, আহা! পরম, কি বলবেন মনু!  

মানবীর মনে যেদিন নারীসত্ত্বা কথা বলে, সেদিন মানবী আশ্বস্ত করে, "পাক না একটু আদর, একটু ভালোবাসা!  মুখোশের গভীরে যদি ছুঁয়ে থাকে দায়, তবে পুরুষ সাজতেও তো ক্ষতি নেই! "আহা! নেই, অশান্তির অসুখ মেখে অকারণ দুঃখ, এটা মানায় না; সংসারে তো নারী মনের জোরে পুরুষকেও টপকে গেছে; স্বামীকে মানবী শিক্ষা দেয়, প্রাচীন প্রথা, সংস্কার সে আর মানে না; লড়াই তো পাল্লা দিয়েই তবে অবাঞ্ছিত প্রতিরোধে সংসার নামক জালে গণ্ডীবদ্ধ করাটা তো ন্যায্য পাওনা হতে পারে না। মনু সারা শরীরে রে রে করে ওঠে অনুভূতিগুলি; একা ইলা মনে করে যৌবনের জোয়ারে শরীর জুড়ে বয়ঃসন্ধির ঢল, তাই আর তো সুদ্যন্ন সেজে থাকা যায় না; নারী তো মানুষ। মর্যাদায় সে পুরুষ অপেক্ষা বেশী সংবেদনশীল।  

কিন্তু, আজ ইলা এ প্রশ্ন বিধাতাকে করতে চায়। কেন তবে, মেয়েমানুষকে ঘেন্নার বীজানু দিয়ে ঘিরে থাকে সমাজ৷ মনুষ্য জন্ম যদি হলো তবে পছন্দের পুরুষ নয় কেন? অনাদরের কান্না কি বোবা ইতিহাস বলেই চালিয়ে দেওয়া যায়! আত্মমর্যাদার জন্য আজ তাই সুরোলোকে যাত্রা তার। নির্জন পথে রাশি রাশি ফুলবাহার, চোখ ফেরাতে পারছে না ইলা; গভীর মুক্তির পথে অবাক তন্ময়তা ছুঁয়ে আছে পৃথিবী। আজ ইলার ঝিরঝির ঝরণার জল ভাঙা, বদলে দেয় সব; সুরলোক থেকে বিতাড়িত তখন বুধ। বৃহস্পতি পুত্র ইলাকে ক্লান্ত, অচৈতন্য দেখে অবাক হয়; সেদিন বুধের গতিও শ্লথ; মুহুর্তের শিহরণ বয়ে যায় অনাস্বাদিত অনুভূতির বুকে। বুধ ভাবে এমন আর্ত মৃগের আর্তি কেন! মিলনে যে সুখ, সে ঘরে এমন আনমনা আড়ষ্ট আর্তি, উফফ! এটাই কি পরম্পরা!  

ক্লান্ত অবসন্ন ইলার বুকে তখন সূর্যপ্রভা; পাহাড়ময় বিকট গর্জন; ইলার ঘুম ভাঙে; পড়ন্ত কমলার ছিল ছেঁড়া অবসন্ন আজ প্রসন্নতায় পর্যবেসিত হয়৷ কে তুমি কল্যাণী! "আশ্রমের নিরাপদ আশ্রয় আগে চলো তুমি!  এসো! এই দূর্গম রজ্যে উদ্বিগ্নতা, ব্যাকুলতা তোমাকে ঘিরে; ইলা বলে, পুরুষের সততা, নিষ্ঠা, দৃঢ়তা, সাহস যে স্বপ্রতিভ হয় তা আজ তিনি বুধের চোখে দেখলেন; ইলা কল্পনা করলেন, এ সুরলোক অধিবাসী। বুধ কৌতূহলী হয়ে বলে, তুমি সুরলোক অভিলাষী। কিন্তু, তা ইলা কি করে জানলেন! বিষন্নের বুকে পুরুষ ডুগরে বলে, সুরলোক তাঁর ঘৃণা করে; হৃদয়ের পরশে অহং মলিন হয়ে ওঠে৷ বুধ কি তবে দেবভূমির শঠতায়  আজ অভিমান প্রকাশ করছে!  উফফ! এই গভীর অনুকম্পার বুকে ইলার হৃদয়ে শুধুই বিষাদ।  তবে কি স্বপ্ন ছিঁড়ে যাচ্ছে অকস্মাৎ!  পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় সম্পর্কটা নাড়া দেয়। 
কুটুরে পাতার আগুন যেন বয়োঃসন্ধির বদল; চোখে চোখ এলে কাছে পাওয়ার বাসনা একান্ত হয়ে ওঠে; আলাপ, আচরণ ডুগরে কাঁদে, কাঙালি মেলামেশায়।মেয়ে না হলে তো কাঙালপণা সান্নিধ্যের আকাঙ্ক্ষা কি আসে! অপ্রস্তুত প্রেমে ক্ষুধার্ত এক আশ্চর্য সহাবস্থান; মাহেন্দ্রক্ষণে দেবী সাক্ষাৎ। ইলা বলে, "তুমি কি জানো!  জন্ম জন্ম তপস্যা করেও সাগর ছেঁচা মুক্ত তুলে  আনতে পারবে না!" বুধ মানে, হ্যাঁ তো, আদরে আবদারে প্রাণের টানে লুকিয়ে ইলাকে কাঙালপণায় দেখেছে, কিন্তু তাই বলে, অপমান! না! এটা প্রাপ্য নয়। ইলা এবার শান্ত। বুধ কে সে দেখেছে, কাঙালিপনায় আদর করেছে অন্তরে, কিন্তু তাই বলে প্রকাশ নয়। মনুর কন্ঠস্বরে যে বিষাদ তাচ্ছিল্য পেয়েছে তা কি ভুলতে পারে!  ভয় হয় খুব!  

বুধ বলে, তাচ্ছিল্যের জারজ সে; অনাদর তো তারও আছে; তারার ভ্রষ্টাচার চন্দ্রের কলঙ্ক সে; তারার সুখের কাঁটা; আজ ইলার বুকে তোলপাড়। নারী হৃদয়ে তো কান্না আসে, কিন্তু ফিরে যায় উৎকীর্ণের প্রতিকারহীন যন্ত্রণায়। এখানে পুরুষের কলঙ্ক পুরুষ আঁকে, নিশ্চিত ইলা!  কক্ষচ্যুত দুইমেরুর নক্ষত্র কি সাজে!  ইলা সরিয়ে দিতে চায়। বুধ সহ্য করতে পারে না। ইলা বলে, চলে যাও!  যাও বুধ! যশ কুড়িয়ে এসো!  দেহ মনের স্নিগ্ধ আলোকে হিমশীতল রক্ত আভাস, পুরুষ চিৎকার "ছেড়ে যেওয়া না, ইলা"! 

ইলা ফিরে দেখে ; এমন আকুতি প্রেমের ঘরে, হৃদয়ের সুরমুর্চ্ছনা আসক্ত করে ; প্রশ্রয় ভরা উজ্জ্বল চোখে ইলা আলিঙ্গনে আঁকড়ে নেয়। গালে গাল রেখে অর্ধনিমীলিত দুই চোখ এক হয়। ইলার শরীরে শিহরণ জাগে। বুধের ছোঁয়ায় শরীর গলে যায় ; কম্বলে মুখ ঢুকিয়ে গায়ের ঘ্রাণ নিতে থাকে নারী শরীর; ভুজবন্ধন জুড়ে এলে ইলার চোখ বন্ধ হয়; ভালোবাসার জলধারায় অনুভূতিগুলি দলিত মথিত হতে থাকে; এ যেন কুয়াশা মোড়া জোছনা; ইলা বোঝে এমন মিলন না হলে হয়তো বোঝাই হতো না যে, একটি পুরুষ বা একটি নারী মনুষারূপের অর্ধেকমাত্র। চোখে চোখে সেতুবন্ধন হয় ; আর আত্মগ্লানি নেই ; বুধ জড়িয়ে বলে, "তুমি আমার জীবন মরুদ্যান"; হৃদয়ে হৃদয় পরশ ছাড়া জীবন যথার্থ নয়; আজ প্রেমহীন জীবনের অবসান; নতুন হয়ে ওঠা জীবন প্রতীকী সাজ,  ভালোবাসা।

ঋণস্বীকার.. 
পৌরাণিক প্রেমকথা...ডঃ দীপক চন্দ্র

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours