রিয়া সরকার, ফিচার রাইটার, জলপাইগুড়ি:

সময়টা ছিল ষাটের দশকের মাঝামাঝি। একসময়ের স্বাভাবিক নিয়মে বয়ে চলা একটি একান্নবর্তী পরিবারের অনেকেই চলে গেছে এ বাড়ি ছেড়ে। আর বাদবাকি যারা ছিল তাদেরও হঠাৎ একদিন রাতারাতি ছেড়ে আসতে হয়েছিল ঢাকা জেলার জয়দেবপুরের সাধের বাড়ি। সেদিন ছেড়ে এসেছিল বাড়ির পাশের পুকুর, বাঁধানো ঘাট, সর্ষে ক্ষেত, ধৈঞ্চা বন, সুপরি গাছে বাবুই পাখিদের নতুন বাসা, বন্ধু অমিত, মইনুল,  আলম, শেখর আর সদা অলস পোষা বেড়াল মিনিকে। বাস্তবের মাটির টানে আটকে থাকতে পারেনি। তবে বেশ কিছুদিন আগে থেকেই যতটা সম্ভব হয়েছিল তিল তিল করে গড়ে তোলা ক্ষেতের জমি-জায়গা, কাঁসা পিতলের ঘটি-বাটি, বাসন-কোসন বিক্রিবাট্টা করা হয়েছিল কিন্তু অনেক জায়গাই এমনি ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে। ওপার বাংলা থেকে এপার বাংলায়। সেদিন ফেলে এসেছিল নিকোনো তুলসী মঞ্চ যেখানে যত্ন করে মা-ঠাকুমা প্রদীপ দিত। ফেলে আসতে হয়েছিল ঘরের কোণের  প্রাচীন আম গাছটিকে। যে গাছের ডালে বসে বাড়ির অনেক ছোটরাই নুন তেঁতুল খেতে খেতে বড় হবার স্বপ্ন দেখতো। যেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে কত পাখি এসে বসত। কিচিরমিচির শব্দে বাড়ি মাতিয়ে রাখতো। যে বাড়ির আর এক কোনের লিচু গাছের নিচের বাঁশের মাচায় বসে ক্ষীপ্ত দুপুর শীতল হতো, সেই ছায়াগাছকেও ছেড়ে এসেছিল। পৌষ সংক্রান্তি, নবান্নের নতুন চাল, পিঠে পুলি পায়েসের গন্ধ, ঢেঁকির শব্দ, উঠোন জুড়ে সেদ্ধ ধানের গন্ধের সুখস্মৃতিকে বিদায় জানাতে হয়েছিল চিরতরে।
            শুধু নিয়ে এসেছিল জং পড়া একটি টিনের বাক্সে কিছু কাপড়, প্রিয়জনদের পাঠানো হলদে হয়ে যাওয়া পুরোনো কয়েকটি চিঠি, ফুটবল খেলায় পাওয়া তিনটে রুপোর মেডেল আর ফিরে না পাওয়া মুহূর্তের স্মৃতিকে।
          নতুন করে জীবন গড়ার আশায় সেইসময় ওদের হাটতে হয়েছিল যোজন যোজন পথ। সদ্য হাটতে শেখা মায়ের কোলের ছোট্ট শিশুটি হাঁপিয়ে উঠেছিল একনাগাড়ে কোলে থাকতে থাকতে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওদের সাথে থাকা সাত বছরের ছেলেটিও পায়ের তালে তালে মিলিয়ে ছিলো বড়দের সাথে। সে বুঝতেও পারেনি ওর ডাংগুলি খেলার বন্ধুদের সাথে, রূপকথার গল্প বলা ফুল দিদা আর গান গাইতে গাইতে ঘুরে বেড়ানো রবিচাচার সাথে হয়ত আর কখনই দেখা হবে না। প্রিয় বন্ধু মাইনুরের সাথে ঘাটে বসে শান্ত পুকুরে ঢিল ছোড়া হবে না আর কখনও। 
   
    সময়ের স্রোতে কতকিছু হারিয়ে গেছে, নতুন অনেক কিছুকে সামনে দাঁড় করিয়ে। নতুন জায়গায় নতুন ভাবে ঘর-দোর, গোয়ালঘর, কুয়োতলা তৈরি হয়েছে। ব্যস্ত হয়েছে ঘরবাড়ি উঠোন। সেখানে শ্যাওলা পড়েছে আবার পরিষ্কারও হয়েছে। রোদ উঠেছে, ছায়া পড়েছে। রান্নাঘরের ছাউনি লাউয়ের ডগায় ভরে গেছে। বাড়ির পোষ্য কুকুর  বুলবুলির মেয়ের ঘরের মেয়ে হয়েছে। আস্তে আস্তে দলমার বেড়া বদলে ইটের গাঁথনি হয়েছে। সব আবার ঠিক আগের মতোই স্বাভাবিক।
      সাত বছর বয়সের সেই ছেলেটির জীবনের অন্বেষণের আরো প্রায় পঞ্চাশটি বছর কেটে গেছে। কেটে গেছে কতগুলো পনেরই আগস্ট, ছাব্বিশে জানুয়ারি। ইতিহাস, সংবিধানের ধারা উপধারা, মানচিত্রের অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংস আয়ত্ত করেছে যত্ন করে। জীবনের ব্যস্ততার মাঝেও অল্প বিস্তর যে নিজের সাথে সময় কাটানো তখন যেন স্মৃতিতে ভেসে আসে শতাব্দী প্রাচীন কোনো এক আগের জীবনের নানা কথা। তার ছেলে মেয়েদের সেসব মায়া ভরা দিনের গল্প শোনায়। নেতাজী, বাঘা যতীন, ক্ষুদিরাম, বিরসামুন্ডার বীরগাথা বলতে গিয়ে চোখ-মুখ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। আর বেশ কিছু স্মৃতিগন্ধ যা  শুধু আত্মোপলব্ধি করা যায়, যা কোনো ভাবেই বর্ণনা করা যায় না, তা কেবল থেকে যায় মনের গভীরে।
      এত বছর পর এই বছরের প্রথম দিকে টিভির পর্দায় চোখ রেখে জানতে পারে 'পরিযায়ী' মানুষদের কথা। তারা সকাল-দুপুর-রাত হাঁটছে ক্রমাগত। বাড়ি ফিরে আসতে চাইছে। সেই মানুষগুলোর মধ্যেই যেন সে নিজের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পায়। মাটির টান, পেটের টান আর জীবনের টানের সংজ্ঞায় এলোমেলো হয়ে যায় সমস্ত ভাবনা। 
         বিদেশে গেলে নিজের জায়গার মানুষদের দেখলে যেমন ছটপট করে মন, মনে হয় খুব আপনজন। তেমনি ভাবেই ওপার বাংলার খুব প্রিয় জায়গা ভবানীপুর, জয়দেবপুরের কথা শুনলেই ছুটে যেতে ইচ্ছে হয়। খুব দেখতে ইচ্ছে হয়, যেখানে সে প্রথম হাটতে শিখেছিলো সেই মাটিকে। সারা শরীরে সেই মাটি জড়িয়ে খুব বসে থাকতে ইচ্ছে হয়।
       তবে খুব ইচ্ছে থাকলেও ওপার বাংলায় আর যাওয়া হয়নি। আর যা হয়নি তা নিয়ে চুপচাপ নীরবে আপসোস করতে হয় একটু। খড় কুটো দিয়ে তাকে ঢাকা খুব কঠিন। তাইতো কতজনকে জয়দেবপুরের প্রাক্তন বাড়ির ঠিকানা দিয়ে খোঁজ নিতে বলেছে। সেখান থেকে একটু মাটি আনতে বলেছে। যদিও সে শুনেছিল সেখানে নাকি অনেকদিন হলো পাকা রাস্তা হয়েছে, আকাশ ছোঁয়া বহুতল বাড়ি তৈরি হয়েছে। তবুও যদি একমুঠো মাটি পেতো সেখানকার তাহলে মনটা হয়তো আরো একটু আরাম পেতো। কিন্তু তা আর হয়নি। উনি চলে গেলেন চিরদিনের মতো। গান স্যালুট করে তেরঙায় মুড়ে দাহ করা হলো। একটা গোটা জীবনের সমস্ত ওঠা নামা, ছন্দপতন, প্রাপ্তি, সমস্ত কিছুর সাক্ষী থেকে গেলো এক ও অবিভক্ত আকাশ।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours