জয়িতা ভট্টাচার্য, লেখক ও শিক্ষক, কলকাতা:

পৃথিবীতে মানুষের আমন্ত্রণে এসে গেছে ভাইরাস জনিত মহামারী।এর আগেও যে হয়নি তা নয় তবে এই কোভিড 19 মড়ক ডেকে এনেছে সর্বক্ষেত্রে।তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো মৃত্যু, অর্থনৈতিক, সামাজিক পরিকাঠামো ও বেকারত্বের কবলে একেবারে মুখ থুবড়ে পড়েছে।
আজ গুরুপূর্নিমায় প্রাসঙ্গিকভাবে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার পটভূমি মনে করিয়ে দিচ্ছে অনেক কথাই।
গত মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে যাবতীয় বিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ।সরকারিভাবে বলা হচ্ছে বন্ধ হলেও বন্ধ নয় শিক্ষাদানের প্রক্রিয়া।সর্বত্র অনলাইন ক্লাস চলছে।
প্রথমেই স্বল্প কথায় একটু দেখে নেওয়া যাক এই ই-ক্লাসরুম ব্যাপারটা সম্পর্কে।  জেনে নেওয়া যাক এই অনলাইন শিক্ষা বা ই_এডুকেশনের ইতিহাস।পৃথিবীতে বৈদ্যুতিন মাধ্যমে শিক্ষাক্রমের চিন্তাভাবনা কিন্তু শুরু হয়ে গেছিলো ১৮৪০ খৃষ্টাব্দে।ডিসট্যান্স এডুকেশনের প্রয়োজন উপলব্ধি করে আইজ্যাক পিটম্যান তৈরি করলেন সর্টহ্যাণ্ড লেখার জন্য ও করেসপণ্ডেন্স কাজের জন্য সাংকেতিক অক্ষর বা সিম্বলিক লেখনী।এরপর ১৯২৪খৃ  আবিষ্কার হলো প্রথম পরীক্ষামূলক মেশিন ।অতঃপর ১৯৫৪ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বি.এফ.স্কিনার কেবলমাত্র  বিদ্যালয় শিক্ষাদানের জন্য "টিচিং মেশিন"টি আবিষ্কার  করেন। 
১৯৬০ সালে প্রথম কম্পিউটার ভিত্তিক শিক্ষাপাঠ সূচনা হলো পৃথিবীতে।ইলিনয়  বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত স্কুলগুলোতে  সর্বপ্রথম ছাত্রছাত্রীদের এই সুবিধা মিললো।একে বলা হয় সি বি টি বা কম্পিউটার বেসড ট্রেনিং যা কিনা PLATO বা Programme Logic for Automated Teaching পরিকাঠামোর  ওপর তৈরি।
ব্রিটেন সাগ্রহে এই ব্যবস্থা চালু করে দিলো ১৯৭০এ অনলাইন ইন্টার্যাক্টিভ কোর্স যা মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা শিক্ষায় খুবই কার্যকর হলো ইউরোপে।
আমাদের দীন দরিদ্র দেশগুলো স্বভাবতই পেছিয়ে ছিলো এই পটভূমি থেকে।
ভারতে এপ্রিল,  ২০০০ সালে প্রথম NIIT অনলাইন লার্নিং লিমিটেড বা (NOL)এর সূচনা করে।
বাংলাদেশে মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রধানত,ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্স এর সূচনা ২০০৯ সালে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ ভিশন যদিও আগামীতে প্রচলন হতে চলেছে এটা ইতিবাচক দিক।
এবার দেখা যাক একটা সাধারণ পরিসংখ্যান কী বলে।দৃষ্টান্তস্বরূপ ভারতে এখনো ২২% মানুষ বাস করেন দারিদ্রসীমার নিচে।বাংলাদেশে ২৪.৩ %।অর্থাৎ এই 22-24% মানুষ প্রথমেই বাদ চলে গেলেন এই বৈদ্যুতিন শিক্ষা থেকে। এবার দেখা যাচ্ছে ভারতে আধুনিক শৌচাগার না থাকলেও মোবাইল ফোন সবার হাতে। মুটে মজুর শ্রমিক, কৃষক ও পতিতাবৃত্তিতে রত সকলেই। কিন্তু কেমন সেই মোবাইল। সস্তার ফোন আনস্মার্ট যাতে সব রকম apps এর সুবিধা নেই। জনসংখ্যার ৬০% মানুষের কাছে রয়েছে একটি মোবাইল যা বাড়ি র সব লোক ব্যবহার করেন।সরকারি স্কুলে মিড ডে মিল পাওয়া যায়  জুতো জামা পাওয়া যায় বলে প্রত্যন্ত  গ্রামগঞ্জের শিশুরা আসে তারা জানে না স্মার্ট ফোন, এণ্ড্রয়েড ,ল্যাপটপ বা কম্পিউটার, এগুলো  তাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। অতএব এই বিপুল সংখ্যক ছাত্র ছাত্রীদের পক্ষে ই- ক্লাসরুম করা প্রায় অসম্ভব।বাকি মাত্র  ৪০%র ও কম শহরে বসবাসকারী ছাত্র ছাত্রীদের মধ্য মাত্র অর্ধেক যেতে পারে নামী দামী ইসকুলে।তাদের ঘরে সব ব্যবস্থা।তারা কখনো এই ই- ক্লাসরুম করে কখনো নয় কারন প্রত্যক্ষ শিক্ষা যতটা বাধ্যতামূলক করা সম্ভব  এক্ষেত্রে নয়। এছাড়া রয়েছে দুর্বল  পরিকাঠামোগত সমস্যা।সব অঞ্চলে  সব টাওয়ার বা নেটওয়ার্ক একরকম নয়,সব apps পাওয়া সম্ভব নয়।বাংলাদেশের ডিজিটাল পরিকাঠামোর অবস্থা আরও সঙ্গীন।যদিও শিক্ষা মন্ত্রী দিপু মণি এই ব্যাপারে উদ্যোগী ও উৎসাহী।
অর্থাৎ এই ই-ক্লাসরুম বা অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থার দ্বারা উপকৃত হচ্ছে কতিপয় এলিট পরিবারের ছেলেমেয়ে। বাকিরা ভগবান/আল্লাহ্ র ভরসায়।
আমাদের দেশে এখনো  ৩০শতাংশ মানুষ নিরক্ষর, বাংলাদেশ এ ২৬ শতাংশ যেখানে জাপানের মতো ক্ষুদ্র ভূকম্প পীড়িত ও মার্কিন পরমাণু বিস্ফোরণ এ ধ্বংস দেশটিতে নিরক্ষরের হার প্রায় শূন্য শতাংশ।
সন্দেহ নেই একটা বড়ো সড়ো ফাঁক রয়ে গেছে শিক্ষাব্যবস্থার পরিকাঠামোয়।আমরা শিক্ষকরা এর দায় ঝেরে ফেলতেও পারিনা কারন জাতির ভবিষ্যত আমারা তৈরি করি।
এখানে মনে রাখতে হবে সাক্ষর বলতে কিন্তু শুধু যে নিজের নামটুকু লিখতে সক্ষম তাদের বোঝানো হয়।
আমাদের গ্রামগুলিতে শিক্ষক পদ খালি থাকে,বালক বালিকাদের শ্রমের কাজে লাগানো হয়ে উচ্চ আদালতের  রায় যাই হোক না কেন।
চাষের সময়  তারা মাঠে চলে যায়  বাবাকে সাহায্য করতে।শহরে আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি স্কুল না এসে দোকানে বসতে হয়।মা গর্ভবতী  ও অসুস্থ তাই সেরা ছাত্রীটি স্কুলে আসে না কতদিন।
মোটাচালের ভাত ডাল খেতে আসে প্রত্যন্ত গ্রামের শিশুরা লেখাপড়া করতে নয়।সেখানেও মিড ডে মিলের খাবার চাল প্রভৃতি  তছরুপ হয়।
শহরের কতিপয় দামি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ছাড়া  অধিকাংশ ছাত্র ছাত্রীরা এখনও  ফার্সট জেনারেশন লার্নার।অর্থাৎ  সেই পরিবারে সে প্রথম উচ্চ শিক্ষা করতে আসছে।
স্বাভাবিক ভাবেই জিনগত ভাবে তাদের বুদ্ধি ও ধারন ক্ষমতা এলিট ছাত্রদের চেয়ে কম যাদের মা বাবা এমনকি  ঠাকুমাও শিক্ষিত।
একটি বিষয়ে একবার দুবার বললে তাদের মাথায় ঢোকে না,তাদের দশবার বলতে হয়।আমরা শিক্ষকরা শিক্ষক রুমে বসে অনেকে তাদের সঙ্গে নিজের সন্তানের তুলনা করে ফেলি,ব্যঙ্গ  বিদ্রুপ করি,গাধা,গরু বলি,আমরা ভুলে যাই তাদের সার্বিক পটভূমি।আমরা ভুলে যাই তাদের একটু অতি যত্ন  ও সহায়তা দরকার। দুবার জিজ্ঞেস করলে মাস্টারমশাই রেগে যান, পয়সার অভাবে দুদিন খাতা না কিনতে পারলে আমরা শাস্তি প্রদান করি কিন্তু একটি খাতা তাকে কিনে দিই না।তবু প্রত্যক্ষ শিক্ষাদানের অনেক সুবিধে।যেসব শিক্ষক শিক্ষকতাকে ভালোবেসে চাকরি করেন তাঁরা শাসন যেমন করেন এমনকি অফ পিরিয়ড বা ছুটির পর তাকে আবার করে বুঝিয়ে দেবার প্রয়াস করেন।
দুটি জরুরি ব্যাপার মেনে চলা উচিত  দেশের ভবিষ্যত গড়তে গেলে।
এক,নিজের কাজের প্রতি দায়বদ্ধতা স্বার্থ হীন ভাবে, 
দুই, শাসন করার আগে দেখতে হবে কতটা ভালোবাসতে পারা গেল তাকে।
মা বাবার পরেই গুরুর স্হান একথা আজ শিক্ষক সম্প্রদায় বিস্মৃত।তাঁরা ক্লাসে বসে মোবাইলে ব্যস্ত থাকেন, নিয়মিত খাতা সংশোধনের কষ্ট স্বীকার করেন না।সর্ব সময়  মহার্ঘভাতার হিসেব ও ছাত্রদের বংশ উদ্ধার করছেন।
অবশ্যই এই ঘটনার ব্যতিক্রম প্রচুর আছে কিন্তু অধিকাংশ সময় আমরা ভুলে যাই আর পাঁচটা চাকরি র সঙ্গে  শিক্ষকতার তফাত আছে।
তাই আমরা আশাবাদী, একদিন  পৃথিবীর অসুখ সেরে যাবে।আমরা স্বাধীন হয়ে আত্মীয়তা করব দূরত্বের নিষেধ সরিয়ে।আমাদের সন্তানতুল্য ছাত্র ছাত্রীদের সঙ্গে দেখা হবে,ক্লাসরুম, চক,ডাস্টার ,স্মার্ট বোর্ডের লেখা আর শূন্য দশকের সঙ্গে  পা মিলিয়ে পরিকাঠামোর উন্নতি হবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন এর সঙ্গে যাতে আমাদের গাঁ গঞ্জের  ছেলে মেয়েরাও প্রযুক্তির সুযোগ প্রাপ্ত হয়।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours