প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:

রাঢ় - এর মধ্যমণি বর্ধমান, তৎকালীনে এক উজ্জ্বল
অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সাহিত্যকে সেই মুহুর্তে বিচার করলে, বলতে হয় "কালানৌচিত্য দোষ"। সৃজনে কেবল শূন্যতা, তাই লুন্ঠনের শরীরে কালি কলম মন রিক্ত এটাই বলা যায় ; সময়টা ১৭৪০- ৪৪ ; তখন বর্ধমানের রাজা কীর্তিচন্দ্রের পুত্র চিত্রসেন মসনদে ; এই সময়েই বর্ধমান রাজ্যের আয়তন নাকি সর্বাধিক।

 তিনি মোঘল সম্রাট বাহাদুর শাহের কাছ থেকে রাজা উপাধি পান; চিত্রসেন নিঃসন্তান ছিলেন; তিনি মারা গেলে, তাঁরই খুল্লতাতের পুত্র তিলকচাঁদ জমিদারি প্রাপ্ত হন। তাঁর পুত্র তেজচাঁদ  ছিলো উৎশৃঙখল এবং বিতর্কিত উত্তরাধিকারী। উল্লেখ্য যে, চিত্রসেনের আমলে বর্ধমানে পর পর তিনবার বর্গি হাঙ্গামা হয়। তথ্যসূত্র বলে, ১৭৪২ সালের ১৫ ই এপ্রিল পর পর দশ থেকে বারোদিন বর্ধমান লুঠ হয়। নগরবাসী ভয়ে পলায়ন করে ; চিত্রসেন নিজে অধুনা বাংলাদেশের যশোরের পশ্চিমে নলডাঙার গড়বাড়িতে আশ্রয় নেন। পরে অবশ্য তিনি ব্যারাকপুর মহকুমায় কাউগাছি মূলাজোড়ে তিনি বসবাস শুরু করেন।  

দীনেশচন্দ্র সেনের " বৃহৎ বঙ্গ" বলে যে কাউগাছি মূলাজোড়ে বর্ধমান রাজাদের তৈরি একটি মাটির দূর্গ ছিলো। কাউগাছির পরিচিতি ছিলো সামনে গড়। এই শব্দের বিকৃত উচ্চারণে নাম হয় শ্যামনগর।  এর আয়তন ছিলো প্রায়  চার মাইল। বলা হয় বর্ধমান রাজা নিজেই নলডাঙায় এসে গড়বেষ্টিত বাড়িতে বহুদিন বসবাস করেন।  বর্গিহাঙ্গামায় চিত্রসেনের অস্থায়ী রাজধানী ছিলো কাউগাছি। 

চিত্রসেনের সভাকবি ছিলেন বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার।  তাঁর "চিত্রচম্পূ", রাজা চিত্রসেনের চরিতকাব্য।  তবে শুধুই চরিতগাথা নয়,  বর্গি অত্যাচারের অমানুষিক ছবি,  নারীধর্ষণ উঠে এসেছে ; শোনা যায়, প্রজাদের   নিদারুণ কষ্টের মুখগুলি দেখে, কবি বাণেশ্বর, চিত্রসেনের বিপুল বাহিনী দিয়ে ভূমন্ডলকে আচ্ছাদিত করে ফেলেছিলেন৷ শুধু তাই নয়,  প্রজাগণকে দক্ষিণ প্রয়াগ ও গঙ্গাসাগরের বিশালা নাম্নী নগরীতে উপস্থিত হন ; এই আক্রমণের সময় চিত্রসেন সহজ জীবন যাপন করতেন ; তাঁর এক গঙ্গা নামে গাভী ছিলো। তিনি এতটাই গো বৎসল  ছিলেন যে, নিজের হাতে গঙ্গার পরিচর্যা করতেন। 
অতীত বলে, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি ছিলেন ভারতচন্দ্র ; রাজা কৃষ্ণচন্দ্র এই উপাধি লাভের পর ১০০ থেকে ৬০০ টাকার রজস্ব দেওয়ার শর্তে মূলাজোড়ে ভূ সম্পত্তি পান ; এই গ্রামেই হস্তীশালা করার জন্য তিনি পত্তনী পান ; তবে তিনি তা অমাত্য রামদেবের নামেই দিয়েছিলেন৷ অম্বিকা কালনায় যিনি সিদ্ধেশ্বরী বাটিতে যে শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেন, সেই তিনিই রামদেব নাগ ; অবশ্য নাগ মশাই ভীষণ ক্রুর ছিলেন ; আর এই ক্রুরতার কথা তিনি " নাগাষ্টক " কাব্যে লিখে যান ; বসতবাড়ির তেমন চিহ্ন না থাকলেও, তাঁর নামাঙ্কিত গ্রন্থাগার আজও দ্রষ্টব্য।  
মূলাজড় আসলে এইসময় কুখ্যাত জয়চন্ডীর জঙ্গলের অংশ ছিলো ; নৈহাটি থেকে আজকের শ্যামনগর পর্যন্ত ভয়াবহ জঙ্গল গড়ে ওঠে। জয়চন্ডী মানেই অঘোর কাপালিকদের অবাধ চলাচল। এই জঙ্গলের জয়চন্ডী দেবীর কাছে ডাকতেরা প্রতিদিন নরবলি দিতো। বৃটিশ রা এদেশে শাসনভার গ্রহণ থেকে এই জয়চন্ডীর রূপ বদলে যায়। তাছাড়া জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বন কাটা শুরু হয়। এই জঙ্গলেই ঠাকুর গোপীমোহনের হাতেই প্রতিষ্ঠা পান ব্রহ্মময়ী কালীকামূর্তি। বলা বাহুল্য বিখ্যাত উপন্যাস "পরকীয়া" এই পটভূমিকাতেই তৈরি হয়।

ঠাকুর পরিবারের জ্যেষ্ঠ আনন্দীরামের পুত্র ইতিহাসে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর।  অপরদিকে দর্পনারায়ণের পুত্র গোপীমোহন  ছিলেন কালিভক্ত। তাঁর এক আদরের দুহিতার নাম ছিলো ব্রহ্মময়ী ; একবার ব্রহ্ময়ীকে নিয়ে মেয়েরা কলকাতার গঙ্গার স্নানে গেলে এই ব্রহ্মময়ী জলে ভেসে যায়। আর এই ভাসা দেহ ফুলে ফেঁপে গঙ্গায় পুনর্বার দেখা যায়। পিতা গোপীমোহন মায়ের কাছে আছড়ে পড়েন। হঠাৎ এক দৈব বাণী আসে যে, "বাবা আমি মূলাজোড়ের  গঙ্গার ধারে আছি, আমাকে নিয়ে যাও।" বাবা, পাগলের মতো ছুটে গিয়ে মেয়েকে আঁকড়ে ধরেন৷ কিন্তু,  দেখে যে, মেয়ের নিথর দেহের পাশে অপূর্ব এক কালী মূর্তি। ঐ বিগ্রহটিকে সন্তান স্নেহে আঁকড়ে নিয়ে তিনি ব্রহ্মময়ী নাম দেন। তারপর ধীরে ধীরে দুপাশে ছয়টি শিবমন্দির ও নাটমন্দির গড়ে ওঠে৷ এই দেবীপুজো চালানোর জন্য তৈরি হয় সংস্কৃত কলেজ৷ আর এই কলেজেই অধ্যায়ন করেন রামকুমার চট্টপাধ্যায়। এই দেবীকে জোড়া মুলো দিয়্র পুজো দেওয়ার রীতি পরিলক্ষিত হয়। 

সময়টা ১৭৪৪; চিত্রসেনের আকস্মিক মৃত্যু হয়। কিন্তু তাঁর কোনো উত্তরাধিকার না থাকায়, মিত্রসেনের পুত্র তিলকচাঁদ মাত্র এগারো বছর বয়সেই অভিসিক্ত হয়। শোনা যায় বর্গিদের হাত থেকে তিলকচাঁদের মা ও রক্ষা পান নি। পরে বহু বছর তিনি  ছেলের সাথে দুর্গে থেকে যান। ইতিহাস পরবর্তী আরো কথক হবে তিলকচাঁদ রায়। তিলোকচন্দ্রপুর তাঁর নামেই অষ্টাদশ শতকে প্রতিষ্টিত। দেবশালা, রাজগড় সব নিয়েই আগামী আলোচনার কেন্দ্রীয় চরিত্র রাজগড় কথা। (ক্রমশঃ)

ঋণস্বীকার - 
১) বঙ্গে বর্গিহাঙ্গামা ইতিহাস ও কিংবদন্তি.. 
 স্বপনকুমার ঠাকুর 
২) কৃতজ্ঞতা স্বীকার " ব্লগ " অদিতি ভট্টাচার্য
https://blogs.eisamay.indiatimes.com/aditibhattacharya/a-story-of-forgotten-history/
৩) ভক্তিরত্নাকর " শ্রী নরহরি চক্রবর্তী "
৪) "গিরিয়ার প্রথমযুদ্ধের গ্রাম্যকবিতা " মুর্শিদাবাদ কাহিনি, নিখিলনাথ রায়
৫)  ইন্টারনেট  উইকিপিডিয়া 
৬) বর্ধমান সহায়িকা 
৭) অন্নদামঙ্গল কাব্য 
৮)  প্রচলিত লোকগাথা 
৯) বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস 
১০) "মহারাষ্ট্র পুরাণ" 
১১) "বণিক বার্তা " ( ইন্টারনেট)  
১২) "বঙ্গদর্শন " ( ইন্টারনেট)  
১৩) ইতিহাস অভিধান 
১৪) পলাশির অজানা কাহিনি,  সুশীল চৌধুরি
১৫) "বঙ্গদর্শন ইতিবাচক বাংলা" 
১৬)  bengali koulal.com
১৭) অন্যান্য 
১৮) আইন-ই- আকবরী 
১৯) গড়পঞ্চকোট ( ajanapathe.com) 
২০) ebela.in  ও  sobBanglay.com

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours