প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:

আমরা আজ যন্ত্রমানব হয়ে গেছি। ভুলে যাচ্ছি আমাদের অনুভবের সময়গুলো। আলাপে আসে - 

মেঘলা চাদরে কাজল কালি আঁশ বুনেছে যখন আকাশ, তখন হৃদয় ছুঁয়ে গেলো কিছু অতীত। নাকে এলো গুরাপে নেমে সেদিনের সেই মাটির বাড়ির গন্ধ ,  জেঠুন দাদুর নস্যির ডিপে, আর আদর মাখানো দুটো মেরি বিস্কুট। আধিপত্য জুড়ে জনমানবের পরিচিতি, বড়ো আপন ছিলো তখন।  বাগদি পাড়ার মাটির ঘরের নীচে বিছিয়ে থাকতো ভাঙা বকুল ; আর নয়নতারার দোরগোড়ায় তুলসীগাছ।  ডানদিক ছুঁয়ে আটচালার আটবাড়ি, আর বাম দিকের পাঁচবাড়ি, খড়ের গন্ধ আর তাঁতি বৌ এর স্নান। পৃথিবীর সব গল্প সেরে নিতেই হবে যেন,  সন্ধ্যা ছুঁয়ে দেবে যে... । দোলতলাটা বড়ো প্রাচীন মনে পড়ে। বকুল, কাঞ্চন, আর হাঁসনুহানা.. বটের গুড়িতে খেলা করে নিত্য। সব ঝরে আছে, বিছিয়ে আছে কামিনী সুর,  প্রেম বিলিয়ে রাধা কৃষ্ণ।  আজ ছুঁয়ে গেলো আনমনে, কেন!  প্রশ্ন  করো না, আমি তো এই সাগরে নাইতেই জানি না বহুজন্ম।

মাটির তলায় যদি পরিপাটি করে শ্বাস নিতে পারো, বুঝবে পাতায় পাতায় প্রাণ লুকিয়ে আছে। সবুজের স্তুতি বেয়ে তো অবুঝ প্রাণ তার মূল্য বুঝল না, তাই কি! এমন শোক বলে যন্ত্রটাকে খোদাই করে নিয়েছি আমরা!! ...  এমন অবেলার কথাগুলো হারিয়ে গেছে। 

বলি হয়ে গেছে শৈশব। একা হতে হয় না তো আর...  ; বেলা বয়ে আজ আর চোখটা পাখি খুঁজে বেড়ায় না, সবুজের আঁচলে বলে না, উফফ!  মিষ্টি হাওয়াটা আসল রে.. ; সীমান্তের বেড়ার মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে বিকালগুলো আর আমরা বই নিয়ে পড়ি... ; বিকালে দিদিমণিকে বলেছি, "ছেলেটাকে অন্যদের সাথে মিশতে দেবো না গো,  তাই ঐ দুঘন্টা আটকে রাখো ওকে "; বসন্তের কোকিলের সাথে গলা মিলিয়ে বলতেই দি না, " এই দেখ তোকে কেমন ভেংচি কাটছি "; ওগুলি তো অতীত। আজকাল ছেলে কবিতা লিখলে মা বলেন, " বাবুরে ও করে কবে কেউ বড়োলোক হয়েছে বল দেখি!! " আজ বড়ো কষ্ট হয় এদের দেখে জানেন!!হাতের একটি মোবাইল আজ তাদের ঘর। সোনা আমার মোবাইল না দেখলে খাবে না।  সোনা আমার মোবাইলে গান না শুনলে ঘুমাবে না। আর আমরা যন্ত্রটা হাতে তুলে দিয়েই বাড়ির কাজ করি,  ঝক্কি কম, ঝামেলা তো কমে গেছে,  মোবাইলটাই মা, বাবা, নেশা আর উদ্দিষ্টের লক্ষ্য মূল্যায়ণের অস্ত্র আজ। 
আজ আর আমাদের বাচ্চারা স্বচ্ছ আকাশের ক্ষমাপূর্ণ ভূমি দেখে না৷ যদি বলি হলুদ পাতার
 গন্ধ - বলে, ইউটিউবে পড়েছি তো। যদি বলি দক্ষিণারঞ্জন পড়েছ!  বলবে ও সেতো অভিনয়ের মধ্য দিয়ে কার্টুনও আছে। বাচ্চারা নিজের নামের মানে জানে না কিন্তু কার্টুনের চরিত্রগুলি ঠিক আত্তীকরণ করে নেয়।আমরা তো আজ গল্প বলতেই ভুলে গেছি। কবে কতোজন সময় দি আমরা তাদের!!  আমাদের কাছে সময় এখন স্মৃতির দরজা। জমিয়ে বাঁধাই করি সম্ভাবনাময় জীবনের আমি টুকু। কম্পিউটারে হাত সেট হলো কি বা হলো না,  আমরা তাদের ইন্টারনেট দিয়ে দি, বলুন না কতোজন নিজে একটা " vehicle "এর ছবি আঁকে!! পৃথিবীর সকলের বর্ণপরিচয়টাই আঁকতে ভুলে যায়৷ 

আসলে পাখিরাও সূর্যাস্তের পাহাড়ে ডানা ভাসায়। কিন্তু ও তো উপাদান, আর আমরা তো সামগ্রিক৷ সর্বনাশের আনন্দগুলো যে হাতের আঙুলগুলোকে অচল আধুলিতে পরিণত করে।  মনের চেতনা যেন ঘাসফড়িং - এর মতো আজ খসে পড়ে অনায়াসে,ভিত্তি নেই যে...  সভ্যতার অসুখ। 

তাই আর দেরিতেই নয়, বাঁচতে দিন  নরম মটির গন্ধটা না হয় আমাদের হাত দিয়েই আসুক ;পুস্তকের গন্ধ একটু আদুরে দুপুরে গা ভাসিয়ে দিক না হয়, বিরত হোক যন্ত্র। আমরা যে যন্ত্রমানব নই, রক্ত মাংসে প্রকৃতির অবয়ব।।আলতা মেঘ সরিয়ে যদি চালের উপর মানচিত্র না আঁকি, যদি শৈশব বইয়ের গন্ধ ছুঁতে না পারে, তবে যে বয়সের মাধূর্য নষ্ট হয়। তাই আসুন প্রকৃতির বুকে আঁকি চেনা সংসার।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours