শাহনাজ পলি, সাংবাদিক, বাংলাদেশ:

আষাঢ়ের দুপুরে এক ঝলক হালকা বৃষ্টির ফোঁটা, তারপরই ঝকঝকে আকাশ। প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক সময়ের এই তরুণ প্রজন্ম মোবাইলে বুদ হয়ে থাকা ছাড়া এসব ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলার প্রতি কোনও আকর্ষনই ছিল না। শুধু তরুন প্রজন্মই না প্রবীনরাও প্রায় ভুলতে বসেছিল ঘুড়ি উড়ানোর সুখ স্মৃতি। কারন রাজধানী ঢাকার যান্ত্রিক জীবনের শৈশব থেকে ঘুড়ি উড়ানোর চল প্রায় বিলীন হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু এই করোনাকালীন ঘরবন্দি সময়ে কিশোর তরুনদের অন্যরকম এক বিনোদনে পরিণত হয়েছে ঘুড়ি ওড়ানো। তাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে ফিরে এসেছে বাঙালির পুরনো সংস্কৃতি। বিকেল হলেই বিভিন্ন পাড়া মহল্লায় এখন কেবলই ঘুড়ি ওড়ানোর দৃশ্য। ঘন নীল আকাশের নিচে লাল, নীল, বেগুনি, হলুদ বাহারি রংয়ের, ঢংয়ের ঘুড়ির ওড়াওড়ি।
দেখতে কোনটা চারকোনা, কোনটা বা ত্রিভুজাকৃতির। বিশাল আকাশে মুক্ত বিহঙ্গের মত হেলেদুলে কখনও অনেক উপরে আবার এক ছুটে নিচের দিকে। দুর থেকে মনে হতে পারে একটা অচেনা পাখির মত আকাশের বিশালতা ছুয়ে শুধুই উড়ছে। এ বাড়ির ছাদ থেকে ও বাড়ির ছাদে পাল্লা দিয়ে সূতা কাটাকাটির এ খেলায় মেতে উঠে নাটাই-সুতা হাতে নানা বয়সী মানুষ।
কোন ছাদের ঘুড়ি মেঘের সাথে খেলে আবার কোন ছাদের ঘুড়ি ছুটে চলে নীল আকাশটা ছুঁতে। আবার কোনটা সূতা ছিড়ে ছিটকে পড়ে এক ছাদ থেকে অন্য ছাদে, অঙিনায়।
বাড়ির ছাদে ছাদে বিকেল হলেই ছেলেমেয়েদের ঘুড়ি নিয়ে নাচানাচির দৃশ্য দেখে আনন্দ উপভোগ করেন পাড়া প্রতিবেশীরাও। কেউ দেখে ঘরের জানালা দিয়ে কেউবা বারান্দা দিয়ে উকিঝুঁকি মেরে। ঘুড়ির কাটাকুটিতো খুবই জনপ্রিয়, আবার বানানোর আনন্দও মন্দ না। সুতা-নাটাই, কাগজ আঠা, চিকন কাঠি কত কি? ছাদে ওড়ানো এসব রঙিন ঘুড়িগুলো বেশিরভাগই ঘরে তৈরি। এক একজনের শিল্পের বৈচিত্র ফুটে উঠে তার নকশায়।
দুই তিন দশক আগেও গ্রামেগঞ্জের মাঠে বা খোলা রাস্তার ধার বেয়ে পাল্লা দিয়ে ঘুড়ি ওড়ানোর দৃশ্য হরহামেশাই দেখা যেত। ঘুড়ি কাটাকাটির লড়াইয়ে মেতে উঠত কিশোর-যুবক-বৃদ্ধ। বিজয়ী ঘুড়ি আকাশে উড়তে থাকে আর হেরে যাওয়া অর্থাৎ কেটে যাওয়া ঘুড়ি বাতাসে দুলতে দুলতে ভুপাতিত হয়। পড়ে যাওয়া সেই ঘুড়িটি কুড়িয়ে নেয়ার জন্য সকলের প্রাণপন চেষ্টা করার মধ্যেও ছিল প্রতিযোগীতার আনন্দ।
কিন্ত এখন সেখানেও এর পরিবর্তন এসেছে। প্রাচীন উৎসব আয়োজনের সেই ঘুড়ির জায়গা দখল করেছে ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন।
ঘুড়ি সাধারণত দুই ধরনের সুতাওয়ালা এবং সুতাবিহীন। সুতাওয়ালা ঘুড়ির মধ্যে আছে ঘুড্ডি, ঢাউস, চং, চোঙা। আর সুতাবিহীন ঘুড়ি হলো ফানুস, বেলুন, হাউই ইত্যাদি। ঢাউস শব্দ থেকে বোঝা যায় এটা বিশাল আকৃতির উপবৃত্তাকারের ঘুড়ি। আকাশে ওড়ার সময় দেখতে অনেকটা উড়ন্ত চিলের মতো লাগে বলে একে অনেকসময় চিলি বলা হয়। মাছ বা প্রজাপতির আকারেও ঘুড়ি বানানো হয়। বড় আকৃতির অন্য একটি ঘুড়ির নাম উড়োজাহাজ ঘুড়ি। এটি শুণ্যের অনেক উপরে ওড়ে। এই ঘুড়ি ওড়ানোর জন্য শক্ত সুতার প্রয়োজন হয়।
ঘুড়ি এক প্রকারের হাল্কা খেলনা, যা সুতা টেনে আকাশে ওড়ানো হয়। পাতলা কাগজের সঙ্গে চিকন কঞ্চি লাগিয়ে সাধারণত ঘুড়ি তৈরি করা হয়। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের এবং বিভিন্ন উপাদান ও নকশার ঘুড়ি রয়েছে। বিশ্বজুড়েই ঘুড়ি ওড়ানো একটি মজার খেলা। এছাড়াও বহু দেশে ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব ও প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান প্রভৃতি দেশে ঘুড়ি ওড়ানো একটি বিনোদনমূলক আয়োজন। বাংলাদেশে, বিশেষ করে পুরনো ঢাকায় পৌষ সংক্রান্তিতে ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব বরাবরই পালন করা হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বিশ্বকর্মা পূজার দিন ঘুড়ি ওড়ানোর প্রথা রয়েছে।
প্রায় ২৮শ’ বছর পূর্বে চীন দেশে ঘুড়ির সর্বপ্রথম ঘুড়ির উৎপত্তি ঘটেছে। পরবর্তীকালে এটি এশিয়ার অন্যান্য দেশ - বাংলাদেশ, ভারত, জাপান এবং কোরিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। ঘুড়ি নিয়ে বিশেষ উৎসবও অনুষ্ঠিত হয়।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours