প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:

জীবন জুড়ে অতীত কথক হয়ে আছি নিত্য। লাল ইঁটের খোপে কতোবার ঘ্রাণ নিয়ে দেখেছি পূর্বপুরুষের গায়ের অতীতের গায়ে প্রলেপ। 

মান অভিমানের পারে যতোবার হেঁটেছি, কে যেন আগলে নিয়েছে শতেকবার। ঝড় উঠলে মনে, আমকে আগলে নিয়েছে প্রকৃতি। কুঁড়ি ঝরা পাতায় এক লাইনের চিরকুটে একবার গ্রামের মাটি সোঁদা ঘ্রাণ নিতে চেয়েছিলাম, পেয়েছি আকন্ঠ পাঠ... হুগলীর ইছাপুর আর গুপি সিংহের গোপিনগর। 

আজও পরিত্যক্তের তেঁতুল গাছে কঙ্কাল সার ইচ্ছাময়ীর  শাসনে স্ত্রীরা ওই বিশাল দগ্ধ পাঁচিল পেরোতে পারে না। কিন্তু আজ আধুনিকিতার দাঁতাল গ্রাসে পিষে যাচ্ছে মানুষ, আতস কাচের মতো আঙুল দিয়ে দেখতে হয় সবুজ মাঠ আর ফুলগুলি। পুরানো খবরের কাগজে মন মুখ এক করা বর্ষার গন্ধ পাই না, তবু বনেদিয়ানা কি ভুলতে পারি!! 

ইছাপুরের বংশপরিচিতি বললেই রাণী ইচ্ছাময়ীর  কথা মনে করে, সাধ্বী নারী। বলিষ্ঠের সংগ্রামে মুখে হাতে জল দিতেই যেমন সলতে জ্বলে পরিবার পরিচিতি। গুপী সিং বর্ধমান রাজার জমি আধিকারিক। জমি থেকে হিসাবের ব্যবসা দেখতে দেখতে তার আধপোড়া অচেতন মনটা নিঃসন্তান হয়েও প্রলুব্ধ হয়ে পড়ে। তার নাম অনুসারে গোপিনগর,  আর রাণী ইচ্ছাময়ীর  নাম অনুসারে ইছাপুর। গুপি সিং এর বংশধরের মধ্যে পুরুষ আধিক্য থাকায় ওই গ্রামে পুরুষেরা বাস করে। আর ইছামতী রাণী হলেও কন্যা অনুরাগী। আর ইছাপুরের গোবিন্দ ঘর নিয়েই মেয়ের বংশ। এই বংশের ৭ পুরুষ আজ জীবিত। কালের করাল গ্রাস আজও ভাঙা ঘরে পোড়া পোড়া গন্ধ ছড়ায়...নিয়তি। 

গ্রামের একটু ভিতরেই রাণীর নামেই বাড়ী। ভাঙা স্তুপে এখন বাদুড়ের বাস। আর সাধ্বী নারী বলেই সে এক অনন্যা, করুণাময়ী। শোনা যায় নাকি সে একবার ডাকাতের দলকে রান্না করে খাওয়ায়। আর যৌতুক হিসাবে বসিয়ে দেয় বাড়ির চাবি।ডাকাতেরা তাঁকে প্রণাম করে মা বলে চলে যায়।তাঁর নামের দেবদেউল, তাঁর নামেই দোল, তাঁর নামেই নিত্য রাধা গোবিন্দ পুজো। প্রত্যেকে জমি প্রাপ্ত। এক সড়া চাল বামুনের প্রাপ্য আর বাতাসা, নাড়ু। 
অন্যদিকে গুপিসিং, ইচ্ছাময়ীর স্বামী। সে বর্ধমানের রাজার এক মাত্র শুভাকাঙ্ক্ষী। কিন্তু ভালোবাসার ধানে পোকা ধরলে তা সব ভেঙে যায়। সেইরকমই প্রলুব্ধতায় পড়ে সেই গুপি। একবার রাজা তাঁর সহচরদের কাছে জানতে পারে, যে গুপি নাকি তার অর্ধেক হিসাব না দেখিয়েই সব লুটে নিচ্ছে। রাজা বলেন, "আমি তোমার কাজে  কৃতজ্ঞ। কাল তোমার বাড়ি দেখতে যাবো "গুপি বুঝেছিলেন যে, সে তাঁকেই ধরতে আসছে৷ এবার ওকে ধরতে আসার আগের রাত্রে গুপি সিং হীরের আংটি চুষে মারা যায়। 

ইচ্ছাময়ী সে খবর পাওয়া মাত্র বলে ওঠে "ও গো আমার কি হলো গো!!"  দিয়েই দেহত্যাগ করেন..  অর্থাৎ সহমরণ হয়। ওই পরিবারের পর্ব ঘেঁষে বাম পাশে আছে বুনো নদী। শোনা যায় ওই বুনোতেই নাকি যক্ষের ধন পোতা থাকে। যার নামে রাখা একমাত্র সেই পাবে..  অন্যেরা নয়। বুনোর পার বরাবর বিস্তৃতি জুড়ে বাঁশের ঝাড়ি।  বড়ো বড়ো পুকুর। আছে দেবভূমির উপর ঠাকুর পুকুর। গুপির বংশের ছেলেরা পুঁজিপতি সম্পন্ন, আর মেয়েরা অনুশাসনের দাস। এই রাজবাড়ির কাছাকাছি আছে দুটি দুর্গা দালান। ব্রাহ্মণ ছাড়া কেউ এই মন্দিরে আসতে পারে না, নাম! পাঁচ বাড়ি আর আট বাড়ি। 

গ্রামে আজও বর্ণভেদ, পশুবলি চলে। তবে শিশিরে ভেজা ঘাস, ফল ফুলের ঐশ্বর্য,  সোঁদা মাটি, ভাঙা ইঁটের সমাহার দেখা যায়। গ্রামের এক প্রান্তে আছে শ্মশান। উৎসব বলতে শ্মশান কালি, শীতলা দেবী, ডাকাতে কালী পুজো হয়। আবার কখনও কখনও অন্যপুজো। কিন্তু সবটুকুর ঊর্ধ্বে  আছে গোবিন্দ। গ্রামের মেয়েরা, তাঁতিদের মেয়েরা সোঁদা জলে, ভিজে গামছায় তাদের গোবিন্দকে প্রণাম করে পুকুর থেকে ওঠে৷ গ্রামের গোবিন্দ বাড়িতে কেউ দোতলা করতে পারে না। কারণ তাহলেই সেই বাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়। এখানে ঐতিহ্য হলো তাতের চরকা। প্রচুর তাঁতের ব্যবসা করেই গ্রাম রমরমা। 

ইতিহাসের পট ছুঁলে মাটির ওলিতে গলিতে ইতিহাস। আছে অপমৃত্যু, অঘটন - তবু গ্রাম সেই ছাড়া সুনিবিড শান্তির নীড় হয়েই উপস্থিত। বনেদিয়ানার ইতিহাস..  আমি নস্টালজিক... তোমাকে বড্ড ভালোবাসি।ভালোবাসি হৃদয়ের গভীরে ছুঁয়ে থাকা পরম্পরার আলো৷ ভালোবাসি সোঁদা গন্ধে  তোমার আলাপন৷ অতীত মানেই মন কাড়া সুর...বংশ তোমার আমার।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours