প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:

পূর্ব পশ্চিমে ১০০০ লি এবং উত্তর দক্ষিণে ৮০০ লি বিস্তৃত ছিলো গান্ধার রাজ্য। পূর্ব সীমানা জুড়ে ছিলো ইতিহাসের পাতায় সিন্ধু নদী। ৪০ লি পরিধি জুড়ে সেইসময়ের রাজধানী পোলুনাপুলো। রাজবংশ নির্বংশ এবং কপিশা হতে আসা প্রতিনিধিগণ রাজ্যশাসন করতেন। রাজকীয় আবাসের কাছেই সহস্র ঘর লোক বসবাস করতো। দেশে শাক, পুষ্প, ফল যথেষ্ট, এমনকি ইক্ষুদণ্ডও প্রচুর ৷ ইক্ষুদণ্ডের রস হলো চিনির মূল উপাদান।

 হিউয়েন সাঙ,লিখেছিলেন, আর্দ্র ও উষ্ণ প্রকৃতির বুকে মানুষ ছিলো নম্রপ্রকৃতির ও ভীরু৷ অতি প্রাচীনকাল থেকে এই ভূমি বহুশাস্ত্রকারের জন্মস্থল। নারায়ণ দেব, অসংখ্য বোধিসত্ত্ব, বসুবন্ধু বোধিসত্ত্ব, ধর্মত্রাতা প্রমুখ। হিউয়েন সাং এর সময়ে স্তূপগুলি অধিকাংশ ক্ষয়প্রাপ্ত, জঙ্গলাকীর্ণ এবং নির্জন। 

রাজধানীর অন্দরমহলে উত্তর পূর্ব দিকে প্রাসাদের ভগ্নাবশেষের  ভিত্তিমূল দেখা যায়। বলা হয় বুদ্ধদেবের পাত্র  মূল্যবান প্রাসাদে রক্ষা করা হয়েছিলো। এখন পাত্রটি পারস্যদেশে আছে বলেই শোনা যায়। নগরের বহির্ভাগে ৮|৯ লি দক্ষিণ পূর্বে প্রকাণ্ড এক বৃক্ষ আছে। বলা হয় চার বুদ্ধ এর তলেই বসেছিলেন। ভদ্রকল্পে আরো ৯৯৬ টি বুদ্ধ এই স্থানে আগামীতে উপবেশন করবেন৷ এই বৃক্ষমূলের দক্ষিণ মুখে উপবিষ্ট হয়ে বুদ্ধ একদিন বলেছিলেন, " আমার নির্বাণের চারিশত বৎসর পরে কনিক্ষ নামে এক নরপতি রাজত্ব করবেন। তিনি এই স্থানেই এক স্তূপ নির্মাণ করবেন এবং সেখানে আমার অস্থি ও চর্ম রক্ষা করা হবে। "

বুদ্ধের নির্বাণের ৪০০ বৎপর পরে কনিক্ষ জম্বুদ্বীপ শাসন করেছিলেন৷ তাঁর  ধর্মাধর্মজ্ঞান ছিলো না, এমনকি বৌদ্ধধর্মে তাঁর আস্থাও ছিলো না। এক দিন তিনি জলাভূমি অতিক্রম করতে গিয়ে এক খরগোশ দেখলেন।  শ্বেত খরগোশের প্রতি আকৃষ্ট হয়েই তিনি কিছুটা এগোতেই দেখলেন এক ছোট্ট বালক ;  বালকটি একটি তিনফুট উচ্চ এক স্তূপ নির্মাণ করছে; বিস্মিত হয়ে রাজা জানতে চাইলে, বালকটি বলে, শাক্যবুদ্ধ বাণী, যা অন্যথা করা অসম্ভব।  এই কথা বলে বালকটি অন্তর্ধান হয়ে যায়। কিন্তু রাজা সেই স্তূপ ঘিরে ৪০০ ফুট উচ্চতায় স্তূপ তৈরি করতে শুরু করেন৷ কিন্তু শতেকবারই সেই বালকের স্তূপ ক্রমশ মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়।তাই অবশেষে রাজা দুঃখ করে নিজের তৈরি স্তূপ ধ্বংস করে। বলা হয় আলোর ঘরে বাতি দিলে ব্যাধি দূর হয়৷ এই বৃক্ষতলে চার ফুট ও ছয় ফুট উচ্চ মূর্তি আজও সূর্যোদয়ের সাথে প্রজ্জ্বলিত হয়। 

সিঁড়ির দক্ষিণাংশে ও স্তূপের পূর্বদিকে তিন ফুট উচ্চ দুইটি খোদিত স্তূপ আছে। এছাড়া চার ফুট ও ছয় ফুট উচ্চ দুইটি বুদ্ধদেবের মূর্তি আছে৷ ইতিহাসের কথকতা বলে, কয়েক শতাব্দী  পূর্বে ভিত্তিমূলের ছিদ্রে বৃহৎ সুবর্ণ পিপীলিকা বাস করতে। প্রস্তর নির্মিত সিঁড়িতে দংশনের চিহ্ন আজও আছে৷ বলা হয়,  তাদেরই বহনে সুবর্ণ বালুকা দিয়েই নাকি সুবর্ণমূর্তি তৈরি হয়েছে। বৃহৎ স্তূপের সিঁড়ির দক্ষিণ পার্শ্বে ষোড়শ ফুট উচ্চ বুদ্ধদেবের চিত্রিত মূর্তি বিদ্যমান৷ 
কিংবদন্তি বলে,  দুই দরিদ্র ব্যক্তি একই চিত্রকরকে তাদের স্বল্প মূল্যে বুদ্ধমূর্তি গড়তে বললে, চিত্রকর একই মূর্তি দেখালে, দুই দারিদ্র ব্যক্তি বিরক্ত প্রকাশ করেন৷ তখন কলঙ্ক মুছতে চিত্রকর বুদ্ধকে প্রার্থনা করলে, মূর্তির উপরার্দ্ধ দ্বিখন্ডিত হয়ে যায়৷ উভয় খন্ডের তুল্যজ্যোতি বিকশিত হয়৷ বৃহৎ স্তূপের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে শ্বেতপ্রস্তর নির্মিত অষ্টাদশ ফুট উচ্চ বুদ্ধমূর্তি বিদ্যমান৷ কিংবদন্তি বলে, দস্যুগণ চৌর্যাভিলাষে স্তূপের নিকট উপস্থিত হলে বহুবার বুদ্ধমূর্তির চলন্ত ক্ষুব্ধ রূপ পরিলক্ষিত হয়৷ দস্যুরা ভয় পায় এবং পালিয়ে যায়৷ বৃহৎ স্তূপের বামে ও দক্ষিণে একশত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্তূপ আছে৷ এই স্তূপ গুলিতে আজও বাদ্যধ্বনি শ্রুত হয়৷ শোনা যায় স্বয়ং বুদ্ধ বলেছিলেন, এই স্তূপ সাত বার পুনর্নিমিত হলে বুদ্ধধর্ম পৃথিবী হতে বিলুপ্ত হবে৷ তাঁর সময় পর্যন্ত তিনবার ভস্মীভূত হয়। 

স্তূপের পশ্চিম অংশ জুড়ে কনিক্ষ নির্মিত সঙ্ঘরাম বিদ্যমান৷ সময়ের আঘাত অনেক কিছুই নিয়ে গেছে, কিন্তু নিয়ে যেতে পারে নি, কনিক্ষ সঙ্ঘরামের মাহাত্ত্ব। বহু সাধক এখানে অরাহত হয়েছিলেন। এখানে তিনতিলাতে মাননীয় পার্শ্বিক কক্ষ বিদ্যমান। 
তার পাশেই  বসুবন্ধু বোধিসত্ত্ব,অভিধর্মকোষ শাস্ত্র প্রণয়ন করেন৷ উল্লেখ্য বসুন্দরা গৃহের পঞ্চাদশ দূরে মনোহৃত বাস করতেন। শাস্ত্রজ্ঞ, ন্যায়বান, প্রজাবৎসল রাজা হিসাবে তাঁর সুখ্যাতি শীর্ষে উঠে। কিন্তু তিনি বিক্রমাদিত্যের নিকট শাস্তি পান। আর শাস্তি স্বরূপ তাঁকে নিজের জ্বিহা কেটে তাতে পত্রলিখে প্রাণ দিতে হয়। 

রাজা কনিক্ষ নির্মিত সঙ্ঘরাম হতে ৫০ লি উত্তর পূর্বে এক বৃহৎ নদী উত্তীর্ণ হয়ে পুষ্কলাবতী নগরী আছে৷ নগরীর পরিধি ১৪ কি ১৫ লি এবং মানুষের বসবাস যোগ্য। নগরের পশ্চিমদ্বারের বর্হিভাগে একটি দেব মন্দির অবস্থিত৷ নগরের পূর্বদিকে রাজা অশোকনির্মিত স্তূপ আছে। এই স্থানেও ভূতপূর্ব চারিজন বুদ্ধ ধর্মপ্রচার করেছিলেন। নগরের ৪|৫ লি উত্তরে প্রাচী সঙ্ঘরাম আছে৷ সঙ্ঘরামের নিকট কয়েকশত ফুট উচ্চ রাজা অশোক নির্মিত  স্তূপ আছে৷ এই স্তূপ কাষ্ঠ ও প্রস্তর নির্মিত৷ হিউয়েন সাং লিখেছিলেন বুদ্ধ, বহুবার এই স্থানে রাজা হয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং নিজের শরীর দান করতে পরাঙ্মুখ হন নি।  

ভ্রমণ বৃত্তান্তে পোলুসা নগরের কথার উল্লেখ আছে৷ এই নগরের উত্তরে একটি স্তূপ আছে৷ এই স্থানেই হীনযান মতাবলম্বী ৫০ জন পুরোহিত বাস করতেন৷ রাজা অশোক এই স্থলেই তাঁর স্তূপ নির্মাণ করেছিলেন৷ দণ্ডলোক পর্বতে অশোক বুদ্ধ স্তূপ নির্মাণ করেন। এই স্থলেই পর্বতের দক্ষিণে একশৃঙ্গ ঋষির কথা শোনা যায়৷ তিনি নারী আসক্তির জন্য স্বধর্ম নষ্ট করেছিলেন। পোলুসানগরের ৫০ লি উত্তর পূর্বে উচ্চ পর্বতোপরি পীতবর্ণের প্রস্তর নির্মিত ভীমা দেবীর মূর্তির উল্লেখ আছে৷ ভীমের মন্দির হতে ১৫০ লি দক্ষিণ পূর্বে ও হিন্দদেশে হিউয়েং সাং উপস্থিত হয়ে দেখেন যে, এই নগর  প্রায় ২০ লি বিস্তৃত এবং তার দক্ষিণে সিন্ধু নদী। 

প্রাচীনকালে অনেকগুলি অক্ষর ছিলো। এই ব্যাখ্যার্থে তিনি পাণিনির জন্মগ্রহণের কথা উল্লেখ করেছেন। পার্থিব শাস্ত্রেই পাণিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। দক্ষিণ সমুদ্রের উপকূলে প্রাচীন বৃক্ষের কোটরে পাঁচশতেক বাদুড় বাস করতো৷সেখানে একদল বণিক বৃক্ষতলে আশ্রয় গ্রহণ করলে, শীত থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে আগুন জ্বালায়। অগ্নিসত্ত্বে বাদুড়গণ ঐ আবৃত্তে মোহিত হয়ে বৃক্ষ পরিত্যাগ না করায়, প্রাণ ত্যাগ করে৷ আর সেই সময় তারা অভিধর্মপিটক আবৃত্তি করতে থাকে৷ পূর্ব অর্জিত ফলানুসারে বাদুরেরা মনুষ্যজন্ম লাভ করে। পরে তারা সন্ন্যাস জীবন পালন করে এবং  অর্হত্ব প্রাপ্ত হয়৷  বুদ্ধের শিষ্যত্ব গ্রহণ এবং ফল এতটাই  প্রভাবশালী যে ঐ বাদুড় শতেক সাধুতে পরিণত হয়। এইভাবেই মানুষের যাওয়া আসা এবং ক্রমান্বয়ে যাপনে স্তর ভেদ। বলা হয়ে থাকে পাণিনি এই  পাঁচশতেকের একজন। নিত্য আসা যাওয়ার মধ্য দিয়েই জীবন, তবু পথচলা.. আলোর পথে যাত্রা আবার।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

1 comments so far,Add yours

  1. That's great! This is a beautiful writing rich in information. It was great to read, I found a complete information in this article. I respect your pen, mom.

    ReplyDelete