সজল বোস, সমাজকর্মী, দুর্গাপুর:

কথায় আছে অন্ধকার না থাকলে আলোর গুরুত্ব বোঝা সম্ভব নয়, আবার গ্রামবাংলার প্রবাদ কালো জগতের আলো। কালো রঙের উপরে সব রঙ কেই যেন উজ্জ্বল মনে হয়। আসলে কালো রঙটা অসীম আর শূন্যের প্রতীক হয়ে আলোর গুরুত্ব কে চকচকে করেছে। তবুও সকলেই কালোকে অশুভ শুনতেই অভ্যস্থ। কিন্তু কালো ড্রেস আজও সাড়া পৃথিবীর হট ফেবারিট রঙ, কারন বিশ্বের তাবড় তাবড় ব্যক্তিত্ব নিজের ইমেজ গড়তে এই রঙের পোশাক পড়তে সাচ্ছন্দ বোধ করেন, সে তিনি রাষ্ট্র নায়ক থেকে নায়ক নায়িকা হোন না কেন। কালো ঘন চুল আজও কবিদের, গীতিকারের কলমে জোয়ার আনে। কালো ঘন মেঘ চাষীর মনে আনন্দ আনে। চাতকের পিপষা মোচনের স্বপ্ন বোনে। কিন্তু ঘৃণা, তাচ্ছিল্য তখনই হয় যখন গায়ের রঙ টা কালো হয়। 
আজ এমনই একটি বলতে যাচ্ছি যেখানে এই সাদা কালোর পৃথক করে চলেছে সাড়া বিশ্বময়। আজও মানুষ প্রতিদিন স্বীকার হচ্ছে বর্ণবিদ্বেষের।

এমনই এক ঘটনার কথা উল্লেখ্য যে দেশের রানী মহিলা সেখানেও কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা চেভি ওকলির বর্ণবৈষম্যের কথা, জন্ম লন্ডনে, কিন্তু বেড়ে উঠেছেন কর্ণওয়ালে। নিজেকে একজন ব্রিটিশ মনে করেন।মাত্র বছর ছয় বয়সে বাবা-মার সঙ্গে প্রায় ১০০% শ্বেতাঙ্গ অধ্যূষিত এক শহরে আসার আগে পর্যন্ত কখনো বর্ণবৈষম্যর শিকার হননি চেভি। ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিমের কর্ণওয়ালের জনসংখ্যার ৯৮.২% ভাগই হচ্ছে জাতিগত শ্বেতাঙ্গ, জনসংখ্যার দিক থেকে এটি ইংল্যান্ডের সবচেয়ে কম বৈচিত্র্যময় কাউন্টি।

 সেখানে আসার পর থেকেই চেভি ওকলিকে এমন সব পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হলো, যা আগে কখনো হয়নি। পথের মাঝে পাশ দিয়ে যাওয়া মানুষের থেকে আসতো বর্ণবাদী ইঙ্গিতপূর্ণ টিপ্পনী।  শিক্ষার আঙ্গিনায় কখনও দাস প্রথা ইতিহাস পড়ানো, তখন পুরো ক্লাসের মধ্যে চেভিকে যেন হঠাৎ আলাদা করে দাঁড় করানো হচ্ছে সবার সামনে। চেভী এমনই দাবী করেন একটি পাশ্চাত্য সংবাদ মাধ্যমের কাছে। ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বেশি শ্বেতাঙ্গ বসবাসকৃত শহরে কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে তার বেড়ে উঠার এমনই এক গল্প।

চেভীর মা শ্বেতাঙ্গ আর বাবা জ্যামাইকান কৃষ্ণাঙ্গ। কিন্তু ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত কোনদিন বর্ণবাদের শিকার হননি। 
স্কুলে একেবারে শিশু বয়সেই প্রথম বর্ণবাদী আচরণের শিকার হন চেভি ওকলি তখন আমি স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়েন। বয়স হয়তো সাত বা আট বছর। কর্নওয়ালে যাওয়ার এক বছর পরের ঘটনা।

স্কুলে একটা ছেলে তাকে  ব্রাউনি (বাদামী মেয়ে) বলে ডাকা শুরু করলো। ডাকটা শুনলে বিভ্রান্ত বোধ করতেন, আর তখন ছেলেটি আরও বেশি করে ঐ নামে ডেকে খেপাতো। এটা আসলে তার জীবনেরও প্রথম স্মৃতি। তার  মা স্কুলে এসে এই ছেলেটির মায়ের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। 

কিন্তু যখন কর্নওয়ালে গেলেন  তখন দেখা গেল সেখানে তিনিই একমাত্র কালো মেয়ে যা আগে ভাবতেই হয়নি। কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগতে শুরু করলো, তার মধ্যে সমস্যাটা কোথায়? তখন হঠাৎ করেই যেন তার এই উপলব্ধিটা হলো যে, পুরো এলাকায় তিনিই আসলে সবার চেয়ে আলাদা, ভিন্ন বর্ণের মানুষ। সেই ছোট্টো বয়সে এই নেতিবাচক ভাবনা কচি মনের উপর কি ভয়ংকর চাপ তৈরী করছে। নিজেকে নিয়ে বিব্রত মনে হয়েছেন।
তার মা তখন বেশ সমস্যায় পড়ে গেলেন, কীভাবে তিনি এই বিষয়গুলো তার কাছে ব্যাখ্যা করবেন। শেষ পর্যন্ত তিনি বাধ্য হয়ে চেভীকে বুঝিয়ে ছিলেন,তাকে এটাই মেনে নিতে হবে হয়তো সারাটা জীবন এধরণের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। লোকজন তাকে নিয়ে যা বলছে, তার  সম্পর্কে যা ধারণা করছে, তার সবকিছুই তারা করছে কেবল গায়ের রঙ জন্য।

বড় হবার সাথে সাথেই  অসুবিধা হচ্ছিল বিশেষ কোন গ্রুপের সঙ্গে মিশতে। কালো হওয়ার কারণেই এটা ঘটছিল কীনা আমি জানি না বুঝতে অসুবিধা হয়নি। আর মানুষ হিসেবেও যেন অনেকটা একাকী হয়ে গিয়েছিলেন। বেশিদিন এক অবস্থানে থাকার মানসিকতা থাকছিলো না।  ফলে বারবার বন্ধুদের সঙ্গ বদল করতে হয়েছিলো। আর স্কুল যাওয়ার প্রতি তীব্র অনীহা তৈরী হতে থাকলো।যখন আমার বয়স ১৪ বা ১৫, তখন একবার শুধু দাস ব্যবসা নিয়ে কিছু পড়ানো হয়েছিল স্কুলে। এটা পড়ানোর সময় শিক্ষক হঠাৎ  ক্লাসের সকলের সামনে আলাদা করে জিজ্ঞেস করলেন, যে তিনিই একমাত্র কালো ছাত্রী, সেটা তার কেমন লাগে? অদ্ভূত এক তাচ্ছিল্য যা ছাত্রাবস্থায় নিজের আত্মবিশ্বাস কে ভেঙ্গে চুরমার করে দিতে থাকলো। এ কোন সমাজ যেখানে বর্ণের বিদ্বেষে মানুষে মানুষে ভেদ তৈরী করে? আর মাটির ভেতরে ঢুকে যেতে ইচ্ছা হচ্ছিলো, মনে হচ্ছিল তাকে যেন উলঙ্গ করে ফেলা হয়েছে।
মা অ্যালির সঙ্গে চেভি ওকলি যাচ্ছিলো, মনে আছে পাশ দিয়ে ছুটে চলা গাড়ি থেকে তাকে ‘নিগার’ বলে গালি দেয়া হয়েছে। এটা বহুবার ঘটেছে।নিজেকে যে কী ভীষণ অপমানিত লাগতো। কেউ কেউ আবার নানা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতো। তিনি তার বন্ধুদের বাবা-মার মুখোমুখি হতে ভয় পেতেন, মনে এমন আশংকা কাজ করতো যে তারা হয়তো তাকে পছন্দ করবে না, বা ভিন্ন চোখে দেখবে। কতটা বঞ্চনার চোখে দেখলে এই হতাশার জন্ম নেই সেটা বুঝতে অসুবিধা নেই। যাদের মনে কারো প্রতি কোন ঘৃণা-বিদ্বেষ নেই, সব মানুষকে যারা সাদরে গ্রহণ করে। কিন্তু তারপরও মন-মানসিকতায় সেদিক থেকে  কর্নওয়াল এখনো বেশ পিছনে, এখনো সেই আগের যুগেই পড়ে আছে। মিশ্রবর্ণের মানুষ, সেটাও বিরাট যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

এই সমাজের ভিন্নতর মানসিকতা আর বর্ণবিদ্বেষী চরিত্র মানবতার দিকগুলোর প্রতি বেড়ে ওঠা অবিচার গুলো শিশু মনকে পৃথক করছে মূল মনুষত্ব থেকে। কবে এই অবমাননার গ্রহণ থেকে মুক্ত হয়ে বিকশিত হবে ভাবনা আর সাদা কালোর একাত্মতা? 

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours