প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:

শকুনির চোখে তখন মহাসংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। ফাল্গুনীর অদ্ভূত সমর, ইতিহাসের পাতা জুড়ে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে, এটাই তো প্রাপ্তি তাঁর। দ্রৌপদীকে যেদিন যুধিষ্ঠির পণ রাখলেন, সেদিন কে ছিলো তাঁদের !  কই একবারো তো প্রভুত্ব অস্বীকার করে অনুজদের মত স্বপক্ষে রাখলেন না যুধিষ্ঠির। কিন্তু ভীম এগিয়ে এসেছিলেন; প্রতিবাদের প্রতিজ্ঞা নিয়ে যুক্তির তরণীতে দাঁড় নিযুক্ত হয়েই অধর্মসাগর পার।  এই তো এসেছে এবার অবলম্বনের কাঁধ। শকুনিও অনড়। এবার শুধু বৃকস্থলীতে মাধব থেকে নিজেকে লুকাতে চান সৌবাল শকুনি। 

 শকুনির পরিচালনা, সন্দেহাবিষ্ট দৃষ্টি সবটাই তো চেনা মাধবের। মাধব বললেন এবার শকুনির হুতাশন অনির্বাণ, পিতার আঘাতের যোগ্য সময় এসেছে। তিনি ধ্বংসযজ্ঞের হোতা। আসলে ভবিষ্যতের কাছে পাণ্ডবদের দ্বাদশ বর্ষ বনবাস প্রয়োজন ছিলো৷ যুধিষ্ঠির পরিবর্তন দেখিয়েছে, "চক্রবৎ পরিবর্তন্তে সুখানি চ দুখানি চ!।  বাসুদেবের কাছে কর্ণ কৌন্তেয় নন, তিনি রাধেয়। তাই পিতৃরাজ্যে তাঁর কোনো অধিকার নেই। আসলে কর্ণ আর যাই হোক, তিনি ধর্মচ্যুত নন৷ অনায়াসের পাণ্ডব শিবিরে পৌঁছিয়ে তিনি তা আদায় করতে পারতেন। তিনি দ্রৌপদীর ষষ্ঠ স্বামী হয়ে, প্রত্যাখ্যানের ক্ষতচিহ্ন ভুলতে পারতেন, কিন্তু না, তা করেন নি। আজ তো কানীনের কাছে পাওয়া নয়, নতুনের প্রতি কর্তব্য এঁকেই জীবনধারণ।

 কৃষ্ণের কাছে শকুনি জানতে চেয়েছিলেন দ্রৌপদীকে দুঃশাসনের হাত থেকে বাঁচলেন কি করে!  মাধব বললেন, রাজসূয় যজ্ঞে দ্বারকা তাঁকে অনেক কিছু উপহার দিয়েছিল৷ তারমধ্যে এই পাঁচশত হস্ত পরিমিত পরিধান, যা সাধারণের অনুরূপ কিন্তু সেটা শকুনি জানতেন না। আসলে ধীরে ধীরে যে তিনি নিজেই ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রাণস্বরূপ হয়ে উঠছেন তা তিনি কল্পনাও করতে পারেন নি।  একদিন শকুনি ভীষ্মের সাথে অর্জুনেত যুদ্ধ দেখে নিজেই নেমে পড়েছিলেন।  আবার এই ভীষ্ম বলেছিলেন, " শকুনি তুমি ধূর্ত শিরমণি"! আজ মনে হয় রাজা সুবলের অনুরোধে কেন তোমাকে আমি প্রাণভিক্ষা দিয়েছিলাম!" 
শকুনি দেখিয়েছিলেন নারী নির্যাতনের দিক। দেখিয়েছিলেন দ্রৌপদীর উপর অত্যাচারের করাল মুখ। বিচিত্রবীর্যের বিবাহ ; অম্বা, অম্বালিকা, অম্বিকার কথা। দ্রৌপদীর মূলে উত্তেজক তো শকুনি। কিন্তু কোথাও কি যুধিষ্ঠির স্থিরতায় ভাটা পড়েছিল!  নিশ্চয়!  আনুগত্য তো ভার এখানে৷ ভীষ্ম বলেছিলেন তিনি ঈশ্বর নয়। তাঁরও তো অভিমান, মান, ক্ষোভ, দুঃখ আছে৷ জাহ্নবী তো স্বাধীনচেতা। ভীষ্ম, মাতার আদেশেই দ্বারপরিগ্রহণ করেন নি। তবু আনুগত্যের জন্য নয়,  অনেকটা অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতেই একপ্রকাশ আক্রোশপ্রসূত কাজ ; তিনি শাম্বকে ক্ষমা তো করেন নি। চেয়েছিলেন সেদিন ভরা সভায় অর্জুন গাণ্ডীব তুলে নিক, কিন্তু তা হয় নি। আজ তিনি ক্লান্ত, ক্ষমাপ্রার্থী।  শকুনিও ক্লান্ত। কারণ জীবনের অস্তাচলে দাঁড়িয়ে প্রতিকার নয়, তৃপ্তি চান। আসলে পরিবর্তন কালের দান৷ 

নারী জীবনে গান্ধারীর মতো করেই রূপান্তর ঘটে। বহু স্তরের আগমন অবলীলায় বন্ধনী ছেড়ে আত্মত্যাগে ব্রতী হয়। অন্তিমে শকুনিকে বুঝতে পারেন গান্ধারী। তবে যে পরিণত পুষ্পবটিকা উপহার দিয়েছিলেন!  তার ভিতরে এতো কীট! অনুযোগ, অভিযোগে শকুনি নত হলেন। তবে সেদিন গান্ধারী বা দূর্যোধনকে বাধা দেন নি কেন!  কেনই বা পাঞ্চালীর দিকে আঙুল তুলেছিলেন!  সেদিন নারীসত্ত্বা জাগলো না কেন!! তবে স্বপরিবার ঊলূক কিন্তু নিজে পিতা পিয়াসী।  সহদেব ও ভীমের যুগ্ম আক্রমণে ঊলূক শেষ হয়ে গেলো। শকুনি চিৎকার করে বাহ্যজ্ঞানহীন অবস্থায় শুধু নির্নিমেষে প্রত্যক্ষ করলেন বিলুপ্ত কুরুক্ষেত্র। 

এবার ঊলূক দৃষ্টিনন্দন শুভ্র পোশাকে পিতামহের সঙ্গে শকুনির সামনে উপস্থিত হলেন। সুবল বললেন " চলো!  পুত্র! তোমার প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা চরিতার্থ হয়েছে, এবারে ক্ষান্ত হও পুত্র। " অন্তিম লক্ষ্যে শকুনি ঊলূককে বললেন, " পুত্র আমায় ক্ষমা করো! " ঊলূক বললেন, "আপনি আপনার পুত্রধর্ম পালন করেছেন, আর আমি আমার। " দূর হতে স্বর ভেসে এলো... 

"যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত। অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্॥ পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশয় চ দুষ্কৃতাং। ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে॥" 

ফুটে উঠল চতুর্ভুজ বংশীধারী। এক হাতে চক্র, অন্য হাতে বরাভয়। বিচ্ছুরিত বিদ্যুৎতরঙ্গে মাধব।সহদেবের হাতে মূর্তিমতী মৃত্যু৷ মৃত্যুর দহনজ্বালাকে প্রশমিত করে এলো শীতল করস্পর্শ। চোখ বন্ধ হলো,  পরিসমাপ্ত কাল৷ (সমাপ্ত)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours