রমা চক্রবর্তী, শিক্ষিকা, আবৃত্তিকার ও ফিচার রাইটার, দুর্গাপুর:

 (ছবিটি এঁকেছেন প্রতিবেদক স্বয়ং)   

আমাদের ছোটোবেলায় এখনকার মত এত বিনোদনের Channel ছিল না TV তে ,শুধু ২ টো Channel ছিল--DD National আর দুরদর্শন বাংলা|তাতে একদিন বাংলা সিনেমা আর একদিন হিন্দী সিনেমা দেখতে পেতাম| আমি যখন Class iv (চতুর্থ শ্রেনী) তখন আমাদের বাড়ীতে TV এল| এর আগে পাশের বাড়ীতে যেতাম| আমি প্রথম যখন "পথের পাঁচালী" সিনেমাটা দেখি তখন আমি Class ii( দ্বিতীয় শ্রেনী)| সিনেমাটা কিছুই বুঝতে পারিনি শুধু এইটুকুই স্মৃতিতে আছে বৃষ্টি পড়ছে,দুটো ছেলেমেয়ে মাঠের মধ্যে ছুটছে, ধোঁয়া উড়িয়ে ট্রেন যাচ্ছে। আমি যখন Class ix ( নবম শ্রেনী) তখন "পথের পাঁচালী" গল্পটা পড়ি,আর তার মধ্যে বার দশেক সিনেমাটা দেখেছি| এই গল্পটার সাথে আমার জীবনের বেশ কিছু মিশে আছে। 
    আমাদের গ্রামের বাড়ী উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বনগাঁতে, বাবার চাকরী সূত্রে আমরা দুর্গাপুরে থাকি| গ্রীষ্মের ছুটি বা পূজোর ছুটিতে আমরা দেশের বাড়ী যেতাম|মামা বাড়ী, পিসির বাড়ী, মাসির বাড়ী সবই প্রায় কাছাকাছি, তাই ছুটিতে বাড়ী গেলে সব জায়গাতেই বুড়ি ছোঁওয়া দিতে হত|বাড়ী যাওয়ার দিন মা আমাদের দুই বোনকে নিয়ে দুর্গাপুর স্টেশন যেত আর বাবা Depertment থেকে বেরিয়ে station পৗঁছত, তারপর ধোঁয়া উড়িয়ে আসা ট্রেনে চেপে পরা, তখন তো EMU ছিল না|
        গ্রামের বাড়ীতে তখনও সেরকমভাবে Electricity পৌঁছায়নি, সন্ধ্যা হলে বেশীরভাগ সময় হ্যারিকেনের আলোই ভরসা| তাই বিকেল হলেই বাড়ীর বড়রা বসে পড়ত হ্যারিকেন Ready করতে,সন্ধ্যেবেলায় জ্বালাতে হবে|আর আমি, দিদি দুজনেই হ্যারিকেনের আলোর অংশের বাইরে যেতাম না ভূতের ভয়ে ,মায়ের পিছু পিছু ঘুরতাম|সবথেকে সুন্দর জিনিস ছিল সন্ধ্যেবেলায় হ্যারিকেনের আলোয় মাদুর পেতে বড়দের আড্ডা আর ছোটোদের পড়াশোনা, সারি দিয় হ্যারিকেন জ্বলছে তার মধ্যে হ্যারিকেনকে এদিক ওদিক করে বেশী কম টানাটানি|
এছাড়া উঠোনের রোদে দেওয়া আচার দুপুর বেলা সব ভাইবোনেরা চুরি করে খাওয়া এ ছিল এক আনন্দের ব্যাপার| আবার হাটবারের দিন নানারকমের আচার 
বিক্রি করতে আসত| আমরা ৫ পয়সা, ১০ পয়সা, ২০ পয়সা  দিয়ে নানা স্বাদের আচার Test করতাম সারা বিকেল জুরে। 
       তখনও পাকা রাস্তা হয়নি, ফলে বৃষ্টি হলে কাঁচা মাটির রাস্তায় পায়ের গোড়ালি ডুবে যেত| গরু-মোষ প্যাঁচ প্যাঁচ করতে করতে হেঁটে যেত, আমাদেরও চলত কাদার মধ্যে ছোটাছুটি,কেউ কেউ আবার চিৎপাত|
বাড়ীর বড়দের সাথে পুকুরে স্নান করতে যাওয়া এও ছিল এক মজার ব্যাপার| বাড়ীতে স্নানের ব্যবস্থা ছিল তা সত্বেও পুকুরে গিয়ে দাপাদাপি চলত সব ভাইবোনেরা মিলে| তখন টিউবয়েল এর জলই ছিল একমাত্র ভরসা| আমরা ছোটো ছিলাম বলে একার পক্ষে কল টিপে জল ভরতে পারতাম না, তাই একজন কল টিপত আর একজন জল ভরত| এভাবেই ছোটোবেলার স্মৃতিগুলো আজও স্পষ্ট|
             আর এখনও আমি সেই পথের পাঁচালী, আমার ছোটোবেলার স্মৃতির গন্ধ খুঁজে পাই আমার School এর ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের মধ্যে| আমার School এর ছেলেমেয়েরা 1st Generation Learner তাই তাদের পরিবেশের পরিকাঠামো খুব বেশী উন্নত নয়| ওখানে পাড়ায় পাড়ায় ফেরিওয়ালা চুড়ি, ফিতে, টিপ, ক্লীপ বিক্রি করতে আসে| আচার-পাপড় ও বিক্রি করতে আসে| ওদের কাছেই গল্প শুনি আমাদের সেই ৫ পয়সার আচার এখন ৫ টাকা| মাঝে মাঝে ওদের সাথে সেই আচার খেতে ইচ্ছে করে| 
একদিন তো School এর সামনে দিয়ে আচারওয়ালা যাচ্ছিল সাইকেল করে, তাকে দাঁড় করিয়ে খেয়েই নিলাম ৫ টাকার আচার| 
মনে হল মূহুর্তেই যেন পৌঁছে গেলাম ছোটোবেলার স্মৃতির গভীরে|
বাস্তবে এখন আর অপু-দূর্গাকে খুঁজে না পাওয়া গেলেও আমাদের স্মৃতির গভীরে আজও তারা আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে|

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours