প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:
 
ঐতিহাসিক প্লট জুড়ে ইতিহাস ছুঁয়ে দেখি প্রত্নতত্ত্ব জুড়ে আছে স্মৃতি বিজড়িত মুর্শিদাবাদ। হিন্দু, বৌদ্ধ, মোগল, ভেদ করে তা মুছে দেওয়া যায় না। রাজা রাজাদের কাহিনি, ভিক্ষুদের সঙ্ঘরাম, বুদ্ধমূর্তি, তান্ত্রিক দেব দেবী চিরকাল স্বাক্ষরিত করে গেছে কালের কথা৷ আজ যদি জীর্ণ অবয়বে ছুঁতে যাই, তবে নদী ছেড়ে কথা বললে, অসম্পূর্ণ অনুভূতি আসে। আচ্ছা!  মনে পড়ে যায় না কি, যে ভাগীরথীকে আমরা গঙ্গার একটা শাখা মাত্র ভাবি ; কিন্তু ভাগীরথীই গঙ্গার মূল প্রবাহ ছিলো। পরবর্তীকালে তা পূর্ব দিকে সরে যায়, পদ্মাকেই মূল প্রবাহ করে তোলে। অবশ্য কেবল নথি কেন!  দেবীভাগবত ও ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণ বলে যে, গঙ্গা ও পদ্মা সম্পূর্ণ পৃথক। পুজো পার্ব্বনে আজও এই ভাগীরথীর জলই গঙ্গাজল রূপে সমাদৃত। পদ্মার জল সমাদৃত নয়৷ 

জীর্ণ পাতা ছুঁয়ে হান্টার সায়েব বলেছিলেন - 
"There can hardly be a doubt that the present Bhagirathi represents the old channel of the Ganges by which the greater part of the waters  of the sacred river were formally brought down to the sea. The most ancient tradition, the traces of ruined cities , and the indelible record of names, all lead to this conclusion. " অতীত বলে ইংরেজরা এই ভাগীরথীকেই কাশীমবাজার নদী ও হুগলী নদী নাম দিয়েছিলো। প্রাচীন স্থান আর জনপদের চিহ্ন পশ্চিমতীরে কিছুটা পাওয়া গেলেও, পূর্বপার কেবলই পরিবর্তনশীল, কিন্তু চিহ্ন বয়ে আসে না। 

প্রাচীন যুগে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার ক্ষেত্র তিন ভাগে বিভক্ত হয়েছে৷ প্রথম ভাগ রঘুনাথগঞ্জ থেকে শুরু করে নদীয়া ও বর্ধমান সীমান্ত গ্রাম সালার পর্যন্ত ধরা যেতে পারে৷ পাঁচথুপী ও রাঙামাটি এই ভাগেরই অন্তর্গত৷ তবে এই স্থানে পাল ও সেন যুগ থেকে শুরু করে গুপ্ত যুগ ও তার পরবর্তী যুগের প্রত্নতত্ত্ব সম্বৃদ্ধ ধরা হয়। দ্বিতীয় ভাগ, রাজমহলের কাছ থেকে জঙ্গীপুর পর্যন্ত প্রাক সপ্তদশ শতকের মুসলমান রাজত্বের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়৷ তৃতীয় ভাগে লালগোলা থেকে বহরমপুর পর্যন্ত এলাকায় নবাবী আমলের স্মৃতিচিহ্ন পরিলক্ষিত হয়৷ ভাগীরথীর পশ্চিম তীরবর্তী অঞ্চল " রাঢ় " হিসাবে পরিচিত এবং পূর্ব্ব তীরবর্ত্তী অঞ্চলকে বলা হয়" বাগড়ী"। তবে এই যে রাঢ়ের টান, এ প্রাচীনত্ব দাবি করে। 

শাস্ত্র বলে, সতীদেবীর কিরিট এখানেই পড়েছিলো। তবে এখানে তন্ত্র উপাচার শঙ্করাচার্যের সময় থেকেই  দেখা যায়। পূর্বে যে ভৈরব মূর্তি, তা নেহাতই বুদ্ধ মূর্তির প্রকৃত ধ্যানী রূপ৷ তবে পীঠস্থান কিরীটেশ্বরী নামে পরিচিত। প্রাক্তন চিরুটির সন্নিকটে রাঙামাটি, মুর্শিদাবাদের অপর একটি প্রাচীন নাম। হিউয়েন সাং এর বুদ্ধ ভারত বলে যে, তিনি তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্তে ক- লো- ন - সু- ফ- ল- ন রাজ্যের কথা লেখা আছে। কর্ণসুবর্ণ রাজ্য ছিলো ৪৪৫০ লী আর পরিধি জুড়ে ২০ লী।এইসময় হিউয়েন সাং দশটি বৌদ্ধ বিহার এবং দু হাজার বৌদ্ধ শ্রমণ দেখেছিলেন। এইসময় বেশ কিছু সংখ্যক মন্দিরও ছিলো। কিন্তু কেন এই নাম?  অঙ্গরাজ্যের অধীশ্বর তখন দাতাকর্ণ। তার পুত্রের অন্নপ্রাশনে সুবর্ণ বৃষ্টি করা হয়েছিল, সেই স্থানের নাম - " কর্ণসুবর্ণ"।  

হিউয়েন সাং, তাঁর বৃত্তান্তে রাজধানীর পাশেই লো - টো- মো - চী নামে একটি স্থানের নাম উল্লেখ করেছেন। এখানে সম্রাট অশোকের সময় নির্ম্মিত কয়েকটি বৌদ্ধস্তূপ ছিল এবং বুদ্ধদেব সেখানে স্বয়ং ধর্মপ্রচার করেছিলেন৷ কেউ কেউ রাঙ্গামাটিকে বলেছে, " কান সোনা " ; শব্দকল্পদ্রুম গ্রন্থে স্থানীয় কর্ণস্বর্ণ নামে এক সমাজের উল্লেখ আছে। কর্ণসুবর্ণরাজ শশাঙ্ক ছিলেন গুপ্ত বংশীয় এবং বৌদ্ধদ্বেষী। রাজ্যের জনসাধারণ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন। মহীপাল ছিলো পালরাজাদের রাজধানী। সেখানে ছড়িয়ে ছিল অসংখ্য বৌদ্ধ দেবীমূর্তি। বলা হয় ক্যাপ্টেন লেয়ার্ড নাকি এখানেই এক বিষ্ণুমূর্তি সংগ্রহ করেন৷ অদূরে যে গিয়াসাবাদ, তা আসলে বদ্রিহাট৷ ১৮৫৩ সালে লেয়ার্ড সাহেব পালি ভাষায় হরফে লেখা মুদ্রা সংগ্রহ করেন। তিনি নিজের মত প্রতিষ্ঠা করে বলেন, যে, এই অঞ্চল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের আবাসস্থল।  Gastrel এবং sherwil সায়েবও বেশ কিছু পালি হরফের শিলাখন্ড লাভ করেন। ভরতপুরে  বেশ কিছু প্রাক গুপ্ত যুগের মাটির শিলমোহর, শিলাখন্ড, পোড়ামাটির মূর্তি মুদ্রা আবিষ্কার করা হয়েছে৷ আবার সেগুলি এশিয়াটিক সোসাইটিতে পাঠানো হয়৷ 

এই মহীপালের কিছু দূরেই এক বিরাট জলাশয় আছে৷ সেটি রাজা মহীপালের সময়তেই খনন করা হয়৷ এই সাগরদিঘী থানার অধীনে ভাঙা মিলকি গ্রামে পাল ও সেন যুগের শিলাখন্ড আবিষ্কৃত হয়৷ পাঁচথুপী এক অনন্য প্রাচীন গ্রাম৷ বুদ্ধ ভারত বলে, পাঁচটি বৌদ্ধস্তূপ থেকে এই পাঁচথুপী নামের উৎপত্তি হয়৷ কান্দীতে রুদ্র দেবের মন্দিরে অধিষ্ঠিত রুদ্রমূর্ত্তিটি বুদ্ধ মূর্ত্তি হিসাবেই মানা হয়। পাল যুগ তো বটেই, মুর্শিদাবাদের এই অঞ্চলসমূহে জৈন ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির ধারা অব্যাহত ছিলো। চুনাখালিতে আওলিয়া ফকিরের সমাধিফলকে ফেরোজ সুলতানের নাম উল্লেখ আছে। শোনা যায় হোসেন শাহ প্রথম জীবনে চাঁদপাড়ার জনৈক ব্রাহ্মণের অধীনে কাজ করতেন। এবার প্রতিভার জোরে সিংহাসন লাভ করার পর মাত্র এক আনা ধার্য্যের চাঁদ পাড়াদান করে। একারণেই চাঁদ পাড়ার নাম "একানি চাঁদপাড়া"।

মুর্শিদাবাদে বৈষ্ণব প্রভাব অপরিসীম। শ্রীনিবাস আচার্য সেখানে বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করেন। তাঁর দুই শিষ্য রামচন্দ্র ও গোবিন্দ কবিরাজ মুর্শিদাবাদের তেলিয়া বুধুরী গ্রামের অধিবাসী ছিলেন।মুর্শিদাবাদের ভরতপুর থানা এলাকাত একাধিক শ্রীপাট এই অঞ্চলে বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাব লক্ষ্য করার মতো।  এখানে কষ্টপাথরের রাধামাধব বিগ্রহ চোখে পড়ার মতো। এছাড়াও রামানুজ সম্প্রদায়ের  আখড়া ও সাধক বাগে আওলিয়া সম্প্রদায়ের আখড়া, বৈষ্ণব প্রভাবের সাক্ষ্য বহন করে৷ কিরীটেশ্বরী আর রাধামাধব ছাড়া, জগৎ শেঠের তৈরি জৈন মন্দির আজ বিলীন। বর্তমানে মন্দিরে মহাবীরের বিগ্রহ স্থাপিত হয়েছে। কাশিমবাজারের মহাজন টুলিতে নেমিনাথের মন্দির প্রাচীন জৈন মন্দির হিসাবে পরিচিত। এখানে নেমিনাথের মূর্তিটি পাথরের এবং পার্শ্বনাথের মূর্তিটি অষ্টধাতুর নির্মিত ছিলো। আর এই মন্দির আবেষ্টন করে থাকতো ব্যবসায়ী সম্প্রদায়৷ 
শ্রদ্ধেয় রাম কেশব দ্বারা ১৮১১ সালে একটি শিব মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া অদূরে বিষ্ণুপুরের কালীমন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়৷ বড় নগরে রাণী ভবানীর মন্দিরে ও চারবাংলা মন্দিরে অষ্টাদশ শতকের এক অপূর্ব শিল্প নির্দেশন চোখে পড়ে। নবগ্রাম থানার অধীনে অমরকুন্ডুতে একাধিক প্রাচীন বিষ্ণু, বুদ্ধ ও সূর্যমন্দিরের সন্ধান পাওয়া যায়। এই মন্দির গুলি ধ্বংসের পর বর্তমানে গঙ্গাদিত্যের মন্দিরটি নির্মিত হয়েছে। মুর্শিদাবাদের বিবিধ মসজিদ ও সমধি ভবনের কাছাকাছি একটি করে নির্ণীত কাল বিহীন শিবমন্দির দেখা যায়। তৎকালীন নবাব নাজিমের ধর্ম উদারতা এবং প্রচার শীল মানুষিকতা এই বহুবিধ নির্মাণের দায়ভার বহন করে। রমজানের মুহুর্তে একত্রিত হিন্দু মুসলিম সহবাস মনে করিয়ে দেয় যে, মর্তুজার দরগা হিন্দুরা আল্লাকে প্রার্থনা করে আর মুসলিমরা মা কালীকে স্মরণ করে। পথ পরিবর্তন হয়। জীবনও পরিবর্তন হয়, কিন্তু ইতিহাস সংস্কৃতির ধারা বেয়ে সময়ের আলাপ করে। এখানেই বলা যায় যে, সংস্কৃতি হলো ইতিহাসের যুক্ত ধারা।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours