ভবানীপ্রসাদ ভট্টাচার্য, ফিচার রাইটার, দুর্গাপুর:
পুর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে আজ দুর্গাপর শিল্পাঞ্চলের পরিচিতি ' ভারতের রুঢ়' নামে। ভারতের মধ্যে একই এলাকায় বৃহৎ ,মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্প কারখানা কোথাও গড়ে ওঠেনি। তাই একদা শাল, মহুয়া, পলাশ,পিয়ালের জঙ্গল সাফ হয়ে সেখানে বিভিন্ন কল-কারখানা মাথা তুলেছিল সেই পঞ্চাশের দশক থেকে সত্তরের দশক পর্যন্ত। সবুজ বনানী হারিয়ে গেল ইট , কাঠ,কংরিটের মাঝে। 'ছায়া সুনিবিড়, শান্তির নীড়.... ' গ্রামগুলি তার নিজস্বতা হারালো।
কিন্তু দুর্গাপর জনপদে 'দুর্গাপর' নামে কোন গ্রাম বা মৌজার অস্তিত্ব না থাকলেও এখানকার অতীত ইতিহাস শুধু ঐতিহ্য বাহি নয় অতীব গর্বের।
আজ একটি ছোট্ট গ্রামের অসাধারণ বড় মানুষের কথা বলবো। বর্তমান পশ্চিম বর্ধমান জেলার অন্ডাল ব্লকের একটি ছোট্ট গ্রাম তামলা। ২ নং জাতীয় সড়কের ধারে এই গ্রামের আলাদা কোন বৈশিষ্ট্য নেই। তামলা নামে একটি ছোট নদী এই গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে। যদিও নদীটির উৎপত্তি উখরার নিকটস্হ ছোড়া গ্রামে। দৈর্ঘ্য মাত্র ২৫ কিঃমিঃ। এটি বীরভানপুর গ্রামের পশ্চিমে দামোদরে মিশেছে।
এই গ্রামের অতি সাধারণ পরিবারের সন্তান বৈদ্যনাথ হাজরা।হাজরা পদবী হলেও ব্রাক্ষন। বৈদ্যনাথ এর জন্যই এই গ্রামের পরিচিতি। স্কুল জীবন কাটে উখরা কুঞ্জবিহারী ইনষ্টিটিউশন এ। অসাধারণ মেধাবী ছাত্রটি আইন পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম হ'ন।
এরপর আসানসোল আদালতে ওকালতি শুরু করেই অল্প দিনেই প্রভুত অর্থ ও খ্যাতি অর্জন করলেন।তাঁর সহকারী ছিলেন আন্তর্জাতিক শ্রমিক নেতা, প্রাক্তন লোকসভা ও পঃবঃ বিধানসভার সদস্য আনন্দ গোপাল মুখোপাধ্যায় এর দাদা সত্য গোপাল মুখোপাধ্যায়। বৈদ্যনাথ হাজরা আইনজীবী হিসাবে বর্ধমান সহ পার্শবর্তী জেলায় প্রভূত সুনাম অর্জন যেমন করেন তেমনিই দুহাতে উপার্জনও করেন। হঠাৎ ছন্দপতন ঘটল। হঠাৎ স্ত্রী বিয়োগে জীবনের গতি পাল্টে গেল। স্ত্রীর প্রতি ভালবাসা তাঁকে মানসিক ভাবে অস্হির করে তুলল। মনের গহনে বেজে উঠলো বৈরাগ্যর সুর। যশ, খ্যাতি পতিপত্তি, মান, অর্থ, ও পুত্র কন্যাদের ত্যাগ করে সন্ন্যাস নিতে চলে গেলেন কালনায় গৌরীমাতার আশ্রমে। ইতিপুর্বেই তাঁর স্কুলের সংস্কৃত শিক্ষক সত্য কিংকর গোস্বামী সন্ন্যাস নিয়ে ওই আশ্রমে আছেন তাঁর আশ্রমিক নাম স্বামী ভাষ্করানন্দ সরস্বতী ।তাঁর কাছেই দীক্ষা নিয়ে সন্ন্যাসী হলেন। দুজনের কেউই ভাবেন নি ভবিষ্যত তাঁদের সূত্রে বাঁধা পড়বে।
সন্ন্যাস নেওয়ার পর বৈদ্যনাথ এর নতুন নামকরণ হ'ল অচ্যুতা নন্দ সরস্বতী।
শুরু হল পরিব্রাজক এর জীবন। ভারতের তীর্থে তীর্থে ঘুরলেন। সাধনার উচ্চস্তরে প্রবেশ করে উপলব্ধি করলেন এক ও অনন্ত শক্তির আধার সেই মহাশক্তিকে। অনুভব করলেন ব্রম্ক্ষান্ড পুরুষকে।
গুরুদেব ভাষ্করানন্দ সরস্বতী, অচ্যুতানন্দ সরস্বতী ও কেশবানন্দ সরস্বতী ভিরিঙ্গী কালী মন্দিরে আসেন ও রবীন্দ্রনাথ রায়ের আতিথেয়তা গ্রহন করেন। রবীন্দ্রনাথ এর স্ত্রী জয়াবতীকে দীক্ষা দেন স্বমী ভাষ্করানন্দ সরস্বতী।
বেনাচিতির অনাথবন্ধু বোস মহাশয় স্বামী অচ্যুতানন্দ স্বরসতীর কৃপালভে ধন্য হয়েছিল।তাঁর পরিবার এক সাথে লক্ষী ও সরস্বতীর আর্শীবাদও পেয়েছিল। তিনি বেনাচিতিতে পাঁচ কাঠা জমি কিনে সেখানে স্বামীজীর সাধনা ক্ষেত্র ' আনন্দ ধাম আশ্রম নির্মাণ করেন। সেখানে দীর্ঘ কুড়ি বছর ছিলেন স্বামিজী। তিনি থাকতেন উলঙ্গ, সদাশিব মৌনব্রতী, উদাসীন। তিনি এআত্মজ্ঞান লাভ করে এক অনন্ত অনির্বচনীয় আনন্দানুভুতি অনুভব করতেন। তিনি আত্মজ্ঞানী এক পুরুষ, যিনি পরম ব্রক্ষ কে উপলব্ধি করে জেনেছেন।ব্রক্ষ এক ও অদ্বিতীয়।
১৯৮২ সালে এই মহাপুরুষের মহাপ্রয়াণ ঘটে। তিনি ভক্তিমার্গ ও আধ্যাত্মিক চেতনায় সমৃদ্ধ করেছেন দুর্গাপুরবাসীদের। (চলবে)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours