প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:
বর্ধমানের উপর বর্গির করাল গ্রাস তো ছক কষা মহাভারত। অর্থের জটিল রাজনীতি জুড়ে তখন নবাব বাহিনী বিস্তৃতি ছেড়ে প্রাণে বাঁচতেই তৎপর। এঁটে সেদ্ধ খেয়ে কয়দিনই বা অস্তিত্বের লড়াই লড়া যায়! তাই ১৭ ক্রোশ দূরত্বে কাটোয়ায় নবাব যাত্রা করলেন। বড়ো সন্তর্পণে তৎপরতা সেই পথে ; শ্লথ গতিতে সৈন্যেরা সড়কপথে এগিয়ে চলল৷ আসলে বিপদের মুখে পড়লে, প্রতি বর্গে যেন ভয় ব্যক্তিসত্ত্বা হয়ে যুদ্ধ করে৷ সূর্য পূর্ব পশ্চিমের পটে এমনটাই অকাল যুদ্ধ নিয়ে অপেক্ষা করছে। রাস্তাটা ক্ষীণ আলোয় প্রতিকূলের চেহারায় বর্গি নামক দস্যুর ভীতি ছাড়িয়ে এগোতেই তো চাইছে - বলছে আর মনে হয় ভয় নেই, এবার "মাভৈ" সাথ;
কাটোয়া মহকুমার নিজস্ব নদী ব্রহ্মাণী। মঙ্গলকোটের কালিপাহাড়ি গ্রাম হলো উৎসভূমি এবং গঙ্গা হলো মিলিত স্থল। কথিত আছে কাটোয়ার চাণ্ডুলী গ্রামে তিন বোনের পুজো হয়৷ ভাদ্রমাসের শুক্লপক্ষের শনিবারে ",বাঁইচিলি " অনুষ্ঠান হয়। বাঁইচিলি" কথার অর্থ " দেবদেবীর নৌকাভ্রমণ '।এই গ্রামের মজুমদার বংশের ব্রাহ্মণরা দুইবোনকে মালা দিয়ে সাজিয়ে ভট্টাচার্য্য বাড়ির এক বোনের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। এই অনুষ্ঠানে বৃত্তাকার ৬ পাক বেষ্টন এবং সান্ধ্যপ্রদীপ প্রজ্জ্বলন উৎসবের অংশ।
তথ্যসূত্র বলে, এই নদীর কাছে পৌঁছাতে নবাবের সৈন্যবাহিনীর উপর বর্গিরা ঝাঁপিয়ে পড়ে৷
বর্গির ধ্বংসাত্মক লুঠ গ্রাস করলো নবাব সৈন্য সহ সাধারণ মানুষকে। আত্মসম্ভ্রম সহ মান ও ব্যস্ত জীবনের মর্যাদা রক্ষা দায় হয়ে উঠল। কিন্তু যাদের উপর নবাবের অগাধ বিশ্বাস, সেই আফগানেরা কি সাহায্য করেছিলো! নাকি মীরজাফরের মতো তারাও স্থির হয়ে ছিলো। এ যেন সেই জগৎ শেঠের ক্ষোভ, যেন ঘসেটির প্রত্যাশার বুকে জল ঢেলে তুষানল প্রজ্জ্বলন।। স্থবির আজ তারা; তথ্যসূত্র " মহারাষ্ট্রপুরাণ " বলে এই স্থানটির নাম ' নিগনসরাই "। কিন্তু কেমন ছিলো নিগনসরাইয়ের যুদ্ধ!
" ভালো ভালো স্ত্রীলোক যত ধইরা লইয়া জাত্র।
আঙ্গুষ্ঠে দড়ি বাঁধি দেয় তার গলাত্র।
একজন ছাড়ে তারে আর জনা ধরে।
রমণের ভরে ত্রাহি শব্দ করে।"
এই নিগন সরাই আসলে শিমুলিয়া মৌজার অন্তর্গত। এইখানেই ছিলো মোগলদের সরাইখানা। ঘটনার সাথে হাতে হাত রেখে নতুন ইতিহাস নেবে এটাই তো প্রাপ্তি। নবাব চাইলেন ভাস্করের আক্রমণের প্রস্তুতি। কিন্তু নিগম সরাইয়ের মাঠে ভাস্করের সন্ধি আলিবর্দির অপমানে লাগে। আসে মুর্শিদাবাদ থেকে প্রচুর সৈন্যদল আর খাদ্যেরসদের ভিড়।ভাস্কর দাঁইহাট থেকে পিছনে হঠতে থাকে। একটা সময়ে তো ভাস্কর চেয়েছিলেন, তিনি ফিরে যাবেন, কিন্তু বাদ সাধলেন মিরহাবিব। তাঁর সাহায্যেই জগৎশেঠের বাড়ি থেকে লুঠ হয় বহু মূল্যবান দ্রব্য ও দুকোটি টাকা। একসময় বর্ধমান রাজাদের গঙ্গা নিবাস, মানিক চাঁদের বাড়ি সবটুকু বর্গিদের কবলে চলে যায়। ইন্দ্রাণীর জমিদার ভয়ে কম্পমান। এবার একদিকে হুগলী আর আরো একদিকে নদিয়া মুর্শিদাবাদের গ্রাম গঞ্জ লুঠ হলো। উল্লেখ্য বর্ধমানের চিত্রসেন ভয়ে লুকিয়ে গেলেন। অভিশাপ ও শয়তানের রাজত্বে তখন কেবল ধর্ষণ, আর একাধিপত্যের অগ্রাধিকার। তবে নিগন সরাইয়ে মির হাবিব এক খল চরিত্রের নাম।
১৭৪২ সালে একবারে গোড়ার দিক তখন। প্রবল বৃষ্টিপাত এবং প্রকৃতির আক্রমণে ভাস্কর পণ্ডিত ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন। কারণ লাভে চৌথ তো শূন্য, তাই কিই বা পাওয়া যাবে। কিন্তু মুর্শিদাবাদ থেকে প্রচুর বাহিনী আসছে নিত্য, তাই অসংরক্ষিত তখন টাকার খনি মুর্শিদাবাদ। মির হাবিব বললেন এইটাই তো সুযোগ; অকর্মণ্যতা আর ভীরুতাকে কাজে লাগিয়ে মির হাবিব ৭০০ অশ্বারোহী বর্গি সেনা কে গোপনে মুর্শিদাবাদে পাঠায়। শুরু হলো লুঠপাঠ। দাহাপাড়া তখন বিখ্যাত জনপদ। আক্রান্ত হলো হাজিগঙ্গা, ইচ্ছাগঞ্জ। কারণ মির হাবিবের ভাই ছিলেন খোদ মুর্শিদাবাদে ;বাধা দেবার তো কেউ নেই সেখানে ; তাই লুঠ হলো সরফরাজ খাঁর জামাতা মুরাদ আলি খাঁ, দুর্লভ রায়, মির সুজাউদ্দিনের বাড়ি; তথ্যসূত্র অনুসারে বর্গিরা সারাদিন লুঠ করার পর দাহাপাড়ার কীরেটেশ্বরের মন্দিরে আশ্রয় নিতো।
এবার নবাবের কানে গেলো সে কথা ; তিনি ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন। ততদিন গোপন লুঠে ভাস্কর যা পাবার তা ভরে নিয়েছেন দুই হাতে । তিনি নবাবের আসার খবর শুনেই দাঁইহাটা ছাড়বেন মনস্থির করলেন। এদিকে মির হাবির জানলেন, ভাস্কর মহারাষ্ট্রের পথে যাচ্ছেন। কিন্তু লুঠপাটের জিনিস! একক আধিপত্য! প্রাথমিকে ভাস্করকে আঘাত করে বীরভূম শিবিরে সব লুণ্ঠিত সম্পদ হাতে নিলেন। মির হাবিব তো চান নি যে, ভাস্কর পন্ডিত ফিরে যান; তাই ভাস্কর পণ্ডিতকে আটকে দিলেন। আবার ফিরে এলেন দাঁইহাটায়। খল চরিত্র মির হাবিব এবার সার্থক হলেন৷ (ক্রমশঃ)
তথ্যসূত্রঃ
১) বঙ্গে বর্গিহাঙ্গামা ইতিহাস ও কিংবদন্তি..
স্বপনকুমার ঠাকুর
২) "গিরিয়ার প্রথমযুদ্ধের গ্রাম্যকবিতা " মুর্শিদাবাদ কাহিনি, নিখিলনাথ রায়
৩) ইন্টারনেট উইকিপিডিয়া
৪) বর্ধমান সহায়িকা
৫) অন্নদামঙ্গল কাব্য
৬) প্রচলিত লোকগাথা
৭) বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস
৮) "মহারাষ্ট্র পুরাণ"
৯) "বণিক বার্তা " ( ইন্টারনেট)
১০) "বঙ্গদর্শন " ( ইন্টারনেট)
১১) ইতিহাস অভিধান
১২) পলাশির অজানা কাহিনি, সুশীল চৌধুরি
১৩) " বঙ্গদর্শন ইতিবাচক বাংলা "
১৪) bengali.koulal.com
Post A Comment:
0 comments so far,add yours