সুমনা ভট্টাচার্য বসুঠাকুর, সমাজকর্মী, কলকাতা:
 
সুশান্ত সিং রাতপুতের আত্মহত্যার পর বলিউড সরব হয়েছে নেপটিজম নিয়ে। সেই সুরে সুর মিলিয়েই, আম্ফানের ত্রাণ দুর্নীতি নিয়ে এবার রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধেও নেপটিজিমের অভিযোগ করেছেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনকর। আম্ফানে ত্রাণ বণ্টন নিয়ে রাজ্য সরকার নির্লজ্জের মতো দুর্নীতি চালাচ্ছে বলে টুইটে অভিযোগ করেছেন রাজ্যপাল। তিনি লিখেছেন, শাসকদলের নেতা ঘনিষ্ঠদের ত্রাণ পাইয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর যাঁরা সত্যিকারের ক্ষতিগ্রস্ত তাঁরা ত্রাণ পাচ্ছেন না। প্রবল নেপোটিজম বা স্বজনপোষণ চলছে রাজ্যে।

মহাসামুদ্রিক ঘূর্ণীঝড় আম্ফান প্রায় এক মাস আগে রাজ্যের একাংশের বিস্তীর্ন এলাকা জুড়ে তান্ডব চালিয়ে চলে গিয়েছিল বাংলাদেশের পথে। তার ঝাপ্টায় তছনছ হয়ে যায় দুই ২৪ পরগনা। পাশপাশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় হাওড়া, কলকাতা, পূর্ব মেদিনীপুর, হুগলি ও নদিয়া জেলার একাংশ। সেই সময় ঝড়ের তান্ডবে দেওয়াল ধ্বসে বা বাড়িতে গাছ ভেঙে পড়ে অনেকেরই বাড়ি আংশিক বা পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্থ হয় । তার জেরে রাজ্য সরকারের তরফে সেই সব বাড়ির মালিকদের ২০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা জানান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ইতিমধ্যেই সেই টাকা দেওয়ার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে আর দেখা যাচ্ছে আম্ফান প্রভাবিত জেলাগুলি থেকে এমন বেশ কিছু অভিযোগ আসছে যেখানে দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে। বিরোধীরাও এই বিষয়টি নিয়ে সরব হয়েছে। আম্ফান প্রভাবিত জেলাগুলিতে দেখা যাচ্ছে ঝড়েতে যার বাড়ি পড়ে গিয়েছে বা ভেঙে গিয়েছে তার নাম নেই ক্ষতিগ্রস্থদের তালিকায়। অথচ যের বাড়ি পাকা, ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি তাঁদের নাম উঠে গিয়েছে ক্ষতিগ্রস্থদের তালিকায়। এমনকি এরা ২০ হাজার টাকা করে পেয়েও গিয়েছে। আর এসব দেখে এখন নানা এলাকায় বিক্ষোভ দেখানো শুরু করেছেন ক্ষতিগ্রস্থ গ্রামবাসীরাই।

গত কয়েকদিনে জেলায় জেলায় আম্ফান ত্রাণ নিয়ে বিক্ষোভ মাথাচাড়া দিয়েছে। সিঙ্গুর থেকে পাণ্ডুয়া, বনগাঁ থেকে কাঁথি সর্বত্র রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে ত্রাণ দুর্নীতির অভিযোগে সরব হয়েছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। আমডাঙায় সিপিএম ত্রাণ বণ্টনে দুর্নীতির অভিযোগে বিক্ষোভ দেখিয়েছে।

গ্রামপঞ্চায়েতের আমফানের লিস্টে ৮০% ই দুনীতি হয়েছে অভিযোগে হাওড়ার জেলা শাসকের কাছে অভিযোগ জানালেন তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত , পঞ্চায়েত বোর্ডের প্রধান মুজিবুর রহমান। তার অভিযোগ, এলাকার যারা বিত্তশালী যাদের কোন ভাবে ক্ষতি হয় নি। তারাই ক্ষতিপূরণ পেয়েছে।যদিও এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে গ্রামপঞ্চায়েতের উপপ্রধান কনিকা নাগের পাল্টা দাবি, এই ক্ষতিগ্রস্থের তালিকা প্রধান নিজেই তৈরী করেছেন।
আবার নিজেই অভিযোগ করছেন। আসলে প্রধানের ওই তালিকা অনেক ভুয়ো নাম আছে নিজে দোষ ঢাকতেই ওনি অভিযোগ করছেন। মোট ১১৭ জনে লিস্ট পাঠানো হয় তার মধ্যে ২৮ জনের নাম ভুয়ো, ৪০ জনের টাকা ঢোকে নি বলে তিনি জানান।

আম্ফান নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে, যে জেলাগুলি সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেইসব জেলায়। প্রথমে মামুলি কিছু ঘটনা সামনে এসেছিল। যেমন ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকায় প্রথানের স্ত্রীর নাম যুক্ত হয়ে যাওয়ার মতো। কিন্তু যত সময় যাচ্ছে তত দুর্নীতির গভীরতা সামনে আসছে। যেখানে ধর্ম কোনও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। পুলিশ আর বিডিওর সামনে কান ধরে ওঠবস করলেন মথুরাপুরের তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত নগেন্দ্রপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য স্বপন ঘাটি।
তৃণমূল কংগ্রেসের  আজব আম্ফান দুর্নীতির আর একটি হাস্যকর উদাহরণ। জাকির হোসেনের বাবার নাম অমূল্য বিশ্বাস , শেখ সইদুলের ছেলে পলাশ কর। আবার কালীপদ দাসের ১৩ টি ছেলে মেয়ে। বিভিন্ন ধর্মের , বিভিন্ন বর্ণের। কালীপদ দাসের এক ছেলে শেখ মণিরুল , তো আরেক ছেলের নাম শ্রীকান্ত বোয়াল। এটা হাওড়ার  উলুবেড়িয়া ১ নং ব্লকের , আমফান ক্ষতিগ্রস্থদের একটি তালিকা। উলুবেড়িয়া ১ নং ব্লকের আম্ফান ক্ষতিগ্রস্থদের তালিকা দেখে চক্ষু চড়কগাছ গোটা পশ্চিমবঙ্গের ।

এইসব ঘটনা প্রকাশ্যে আসতেই রাজ্য সরকারের পাশাপাশি নড়চড়ে বসেছে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসও। দলের শীর্ষনেত্রী হিসাবে এবং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইতিমধ্যেই সাফ জানিয়ে দিয়েছেন , ত্রাণে দুর্নীতি বরদাস্ত করা হবে না। আর তাই এবার তিনি নির্দেশ দিয়েছেন এই ধরনের দুর্নীতি রুখতে রাজ্যের প্রতিটি জেলার প্রতিটি গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে একটি করে কমিটি গঠন করতে হবে। ইতিমধ্যেই এই মর্মে জেলা শাসকদের কাছে সেই নির্দেশ পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে নবান্ন থেকে।
 
সেই নির্দেশ বলা হয়েছে, প্রতিটি গ্রাম পঞ্চায়েতে নতুন এই কমিটি গঠন করতে হবে। কমিটিতে থাকবেন এজন পঞ্চায়েত সদস্য, বিডিওর প্রতিনিধি, একজন সরকারি আধিকারিক ও প্রয়োজনে বিরোধী দলের এক প্রতিনিধি। পঞ্চায়েতের ওই কমিটি এখন শুধু যে আম্ফান ত্রাণের দুর্নীতি রুখতেই কাজ করবে এমন নয়, ওই কমিটি সারা বছর থাকবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে রাজ্য সরকারের তরফে কোনও আর্থিক ত্রাণ দেওয়া হলে তা ওই এলাকার কারা কারা পাওয়ার যোগ্য সেটা তাঁরা দেখবেন। তাঁরাই তালিকা তৈরি করে তা রাজ্য সরকারকে পাঠাবেন। আগামী ৭ দিনের মধ্যে ওইসব কমিটিতে কারা কারা থাকছেন সেই তালিকা তৈরি করে নবান্নে পাঠানোর নির্দেশও দেওয়া হয়েছে জেলা শাসকদের।
অনেক বার বলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, চুরি নয়, স্বজন পোষন নয়! শুধু আজ নয় বিগত কয়েক বছর ধরেই! কিন্তু কে শোনে কার কথা? মুখ্যমন্ত্রী বা দলনেত্রী বলার কথা বলেন কিন্তু তা পালন হয় না দলে। এই পরম্পরা আম্ফানের ত্রান বন্টনেও চলছে। রাজ্যের বিভিন্ন কোন থেকে অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের ত্রান দূর্নীতির বিরুদ্ধে । মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগের সত্যতা দেখে মন্তব্য করেছেন , ত্রাণের টাকা নিয়ে দুর্নীতি হলে কাউকে ছাড়া হবে না , শাস্তি হবেই। কিন্তু কে শোনে কার কথা।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours