মহুয়া বন্দ্যোপাধ্যায়, লেখিকা, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর:

আট বছরের ছোট্ট মেয়েটি আজকাল সব সময় মনমরা থাকে। ছটফটে শিশুটি স্কুলে যেতে চায় না বেশ কিছুদিন ধরে। আত্মীয় পরিজন কোন  কারন খুঁজে পায়না। মা বাবার আদরের মেয়েটি ধীরে ধীরে কেমন নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিতে থাকে বাইরের মানুষদের থেকে। তারপর একদিন দেখা যায় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে প্রাণপণে নিজের মুখে পাউডার লাগিয়ে মুখ প্রায় সাদা করে ফেলেছে। মায়ের প্রশ্নের উত্তরে সে জানায় তাঁকে ফরসা হতে হবে। নাহলে তাকে সবাই মা কালি বলে ক্ষেপায়। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেল মেয়েটি দীর্ঘদিন ধরে তাঁর স্কুলে, প্রতিবেশীদের কাছে তার গায়ের কালো রঙ নিয়ে সামাজিক নিপীড়নের শিকার। শুধু সেই মেয়েটিই নয়, আমাদের দেশের এরকম হাজার হাজার মেয়ে রয়েছে যারা গায়ের কালো রঙের জন্য প্রতিদিন সমাজ স্বজনদের কাছ থেকে ব্যঙ্গ, হাসি, তামাসা পেতে পেতে মানসিক অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। শুধু গায়ের রঙ নয়। কারো কারো ভোঁতা নাক, মোটা শরীর এমনকি চোখের ক্ষুদ্রতাও অন্যের কাছে হাসি তামাশার বিষয় হয়ে ওঠে। পাড়ার নিজের মেয়ের বয়সী মেয়েটিকে কেলে কুশটি বিশেষণে ভূষিত করা বা নিরীহ একটু মেয়েলি ছেলেটিকে হিজড়ে বলে হেসে গড়িয়ে পড়া মানুষগুলো এক চরম পরিতৃপ্তি লাভ করে অন্যকে  সোশ্যাল বুলি করে।  

পাড়ায় পাড়ায় কেলে বাপী, কানা বাপী, ল্যংড়া বাপী ইত্যাদি বলে ডাকা বা মোটি, হাতি, টেকো নাটি, এসব ডাক সেই মানুষগুলোর শারীরিক  ত্রুটিকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।  

অপরের কাছে প্রতিনিয়ত হাস্যাস্পদ হতে হতে সেই মানুষগুলো যন্ত্রনায় কুঁকড়ে যায়। অনেকে মানিয়ে নেয়। আর যারা মানাতে পারে না, তারা ধীরে ধীরে অবসাদের অন্ধকারে তলিয়ে যায়। তখন আবার এই সমাজ তাদের পাগল আখ্যা দেয়। কি বিচিত্র না?   

সামাজিক নিপীড়ন আগেও ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর গিন্নী গল্পে নিপীড়নের শিকার এক মেয়েলি কিশোরের অসহায়ত্ব, তাঁর পারিপার্শ্বিক সমাজের চিত্র ফুটিয়ে তুলেছিলেন। তবে বর্তমানে সোশ্যাল বুলিইং এক ভয়ঙ্কর আকার ধারন করেছে। প্রতি পদে একজন মানুষ অপরজনকে নানা ভাবে হেনস্থা করে চরম মানসিক অবসাদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এর সাথে যোগ হয়েছে সাইবার বুলি করা। সোশ্যাল মিডিয়ায় যে কোন ইস্যুতে দুর্বল প্রতিপক্ষকে ভয়ানক ভাবে নিপীড়ন করা আজকাল নিজেকে জাহির করার এক পন্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটু মতের অমিল হলেই জনসমক্ষে পরস্পরের প্রতি ব্যক্তিগত কুৎসা করা হচ্ছে। মানসিক ভাবে দুর্বল মানুষটি এই অপমান সহ্য করতে না পেরে নিজেকে শেষ করে দিচ্ছে। শুধু বডী শেমিং বা সাইবার বুলিইং নয়, পেশাগত ভাবে, জাতপাতের নিরিখেও সারা পৃথিবী জুড়ে মানুষ সামাজিক নিপীড়নের শিকার হচ্ছে।
কর্মক্ষেত্রে সমান মেধার হওয়া সত্ত্বেও নিম্নবিত্ত আর উচ্চবিত্তের মধ্যে একটা গণ্ডী টানা হয়ে যায়। গরীব পরিবার থেকে আসা ছেলেটি বা মেয়েটি নানা হেনস্থার শিকার হয়। আবার মা বাবার উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্যে মেধাবী ছাত্র বা ছাত্রীটি  নিজের ইচ্ছেকে অবদমিত করে বড় হয়। কিন্তু যখন সে আর চাপ নিতে পারে না, তখনই হয় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে অথবা নিঃশব্দে নিজেকে শেষ করে দেয়। এটাও এক ধরনের নিপীড়ন, মানসিক অত্যাচার। এই প্রজন্মের কাছে তাই সামাজিক নিপীড়ন একটি খুনীর চেয়ে কম ভয়ঙ্কর নয়।
  
আজকাল আবার তাঁর সাথে যুক্ত হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায় মিম বানানো। রানু মণ্ডল থেকে প্রিয়াঙ্কা চোপড়া কেউই বাদ যায় না এই ধরনের মিম দ্বারা নিপীড়ন থেকে। যারা বুলি করে তারা ভুলে যায় যে মানুষের ব্যক্তিগত পরিসরে ঢুকতে নেই। এক উৎকট উল্লাসে তারা তাদের চেয়ে সফল বা তাদের চেয়ে অসফল ব্যক্তিকে হেয় করে নিজের অক্ষমতাকে ঢাকতে চায়। সম্প্রতি হাওড়া ব্রিজে উঠে তাঁর নোবেল অমর্ত্য সেন নিয়েছে বলে দাবী করা মহিলাটিও এই ধরনের সামাজিক নিপীড়নের হাত থেকে রেহাই পাননি। অথচ একটু সহানুভুতির সাথে বিবেচনা করলেই বোঝা যেত উনি হয়তো না পাওয়ার হতাশা থেকে, গভীর কোন মানসিক অতৃপ্তি থেকে  একাজ করেছেন। কিন্তু সেটুকু বোঝার আগেই কত মিম ছড়িয়ে পড়বে তাঁকে হেনস্থা করে। আর তিনি তলিয়ে যাবেন  গভীর  থেকে গভীরতর অন্ধকারে।

একবার ভাবুন তো, সাধারন মানুষ যেখানে এইভাবে সোশ্যাল বুলিইং এর শিকার হচ্ছে, সেখানে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ আর  ধর্ষিতাদের কি কি সহ্য করতে হয়! এই সমাজের কিছু মানুষ তিলে তিলে তাদেরকে মানসিক ভাবে পীড়ন করে এক অসহনীয় জীবন যাপনে বাধ্য করে। 

মিডিয়ায় আমরা প্রায়শই এই ধরনের খবর দেখতে পাই। কিন্তু কেন এই নিপীড়ন? উত্তর লুকিয়ে আছে আমাদের সমাজ ব্যবস্থার মধ্যেই। চিরকালই দুর্বলের ওপর সবলের অধিকার ও অত্যাচার চলে এসেছে। অন্যের ওপর মানসিক অত্যাচার করে এই সব বিকৃত মনস্ক মানুষ আসলে নিজেদের হতাশার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। ধিক্কার সেই সব অমানুষদের। সামাজিক নিপীড়ন বন্ধ করতে গেলে এদের বিরুদ্ধে আমাদেরকেই  রুখে দাঁড়াতে  হবে। তা নাহলে আরো অনেক প্রান এই সামাজিক নিপীড়নের বলি হবে। তাই আসুন আমরা না হয় একটু মানবিক হই। সামাজিক নিপীড়নের শিকার অবসাদগ্রস্ত সেই সব মানুষদের পাশে থাকি। এভাবেই সুস্থ ও সুন্দর হোক সকলের আগামী।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours