প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:
 
গরমের ছুটির সন্ধ্যাবেলা হতেই সাপ - লুডু, পুটের খেলা আজও মনে পড়ে। আমার জীবনে বই আমাকে একঘর সংসার দিয়েছে, তাই এমন ইনডোর গেমের সাথে সখ্যতা আমার পরিণত দিনাতিপাত হয়ে ওঠে নি। তবু লুডুর পাতার সাথে আকর্ষণ কথাটা ভাবাই যায়। মই দিয়ে উপরে ওঠা,  আর সাপের মুখে পড়েই নীচে নেমে আসা, উফফ! দারুণ উত্তজনাপূর্ণ। কিন্তু, খেলাটি ইতিহাসের পথ ধরে আজকের পরিণতি পেয়েছে। কি সেই ইতিহাস!

 ১৯৭৭ সালে দীপক সিংখাদা নামে এক যুবক শিকাগো শহরের ন্যাচারাল হিস্ত্রি মিউজিয়ামে বসে নেপাল এবং তিব্বতের বিভিন্ন সংগৃহীত ছবির এক তালিকা প্রস্তুত করছিলেন। সেইসময়ে জাদুঘরের রেজিস্টারে ভারতীয় আর্ট ডিলারের কাছ থেকে সংগৃহীত ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহাদেবের ছবি দেখতে পান৷ তিনি বোঝেন এই ছবি,  সংগৃহীত এবং এর মূল লুকিয়ে আছে নেপালে। তিনি তখন চিত্রকর্ম নিয়ে পড়াশুনা শুরু করেন। সেই পাঠ থেকে পাওয়া বিষয় বলে যে, এটি লৌকিক কথনে "বৈকুন্ঠ খেলা "। আর শুদ্ধিতে এর নাম " নাগ পাশ। "

সাপ সাধারণত মধ্যযুগীয় সাহিত্য অনুসারে ক্রুরতার প্রতীক।  কিন্তু এখানে "লাল সাপ "  সৌভাগ্যের প্রতীকী আর ' কালো সাপ " দুর্ভাগ্যের প্রতীক৷ নাগপাশে লাল সাপের লেজে গুটি পৌঁছাতে পারলেই খেলোয়াড় অনেক উঁচুতে পৌঁছে যাবেন৷ আর কালো সাপ " এর মুখে গেলেই শেষ৷ আমাদের খেলায় লাল সাপের স্থানে মই ব্যবহৃত হয়৷ কিন্তু আমরা খেলি আনন্দের জন্য,আর নাগপাশ!

অনেকটা গভীর; প্রাচীনকালের মানুষেরা এই লুডু খেলা দিয়ে নিজের কর্মফল পরিমাপ করতো৷ তারা মনে করতো, শুভ অশুভের ফল ভবিষ্যৎ জীবন এবং পরজন্মের জন্য সঞ্চিত হয়ে থাকে। আর কর্মফলের বিশ্বাস ও স্বর্গের প্রলোভন থেকেই এই নাগপাশের জন্ম হয়৷ আর এই কালো সাপ বেয়ে নীচে নামা এবং লাল সাপ বেয়ে উপরে ওঠা মানেই এই নাগপাশ জন্মজন্মান্তরের কথা বলে৷ আসল নাগপাশ খেলার যে বিস্তৃতি তা কিন্তু শিকাগো মিউজিয়ামে সংরক্ষিত চিত্রপটে নেই৷ 
অবশ্য তথ্য বলে ভারতে এই খেলা বহু আগে থেকে প্রচলিত ছিলো।  নেপালের নাগপাশ খেলার প্রচলন দশম শতকে হয়ে থাকে৷ ভারতে এই খেলার নাম ছিলো " জ্ঞান চৌপার " বা " মোক্ষ পতমু ", সংক্ষেপে "মোক্ষপথ" ;     জ্ঞান চৌপার খেলার উদ্দেশ্য     নাগপাশে  মতো ৭২ টি খোপ বিশিষ্ট  ; তবে এখানে লাল সাপের বদলে তীব্র বাণ ব্যবহার করা হয়৷ পরবর্তিতে এই বাণই সিঁড়িতে রূপ পায়৷ তবে এখন আর কর্ম ফল, আত্মজ্ঞানের কথা হারিয়ে গেছে ; এখন লুডু নিছকই খেলা; 

জ্ঞান চৌপার খেলা শুরু হয় ৬৮ নম্বর ঘর থেকে। আসলে এখানে খেলোয়াড়কে সাপের মুখে পড়তেই হয়। খেলতে খেলতে খেলোয়াড় আবার ৬৮ নম্বর ঘরে ফেরে৷ উদ্দেশ্যটা এমন যে, ফিরে যেতেই হবে। নেপালের নাগপাশ শুরু হতো ১ নম্বর ঘর থেকে৷ ধারণটা এমন ছিলো যে শৈশব, কৈশর, যৌবন পেরিয়ে খেলোয়াড়ের ৭২ ঘর অতিক্রম করতে পারলেই মোক্ষলাভ সম্পন্ন। উনিশ শতকে এই খেলা জৈন ধর্মের ভক্তদের মধ্যেও ব্যবহৃত হতো৷তাঁরা ৮৪ টা খোপের খেলায় অভ্যস্ত ছিলো। আর এই সবই চিত্রিত হতো কাপড়ের উপর। ইসলামীয় সংস্করণটি ছিলো ১৭ টি মই এবং ১৩ টি সাপ। 

গৌতম বুদ্ধের অহিংসা বাণী নেপাল থেকে তিব্বতে গেলে, তিব্বতীয়রা বৌদ্ধধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়। আনুমানিক দশম শতাব্দীতে ভারতীয় পণ্ডিত পদ্মসম্ভব তিব্বতকে বুদ্ধের আদর্শ দীক্ষিত ভূমি রূপে ঘোষণা করলে, তিব্বতীয়রা নেপালে আসতে থাকে। আর এরই সাথে সাথে ব্যাপক সংস্কৃতির মেলবন্ধন হয়৷ তিব্বতীয় সাপ লুডুর প্রবর্তক পণ্ডিত সাস্ক্য ও কাঠমাণ্ডু থেকে পঞ্চাশ মাইল উত্তরে কেরিং নামক স্থানে এসেছিলেন। তাই পরবর্তীকালে নাগপাশ তিব্বতে অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে স্থান পায়৷ 

 পরবর্তী কালে নাগপাশ ও জ্ঞান চৌপারের ঘর বেড়ে ১০০ হয়৷ পূর্ব ৭২, সংসার চক্রের যে বিবিধ স্তর রয়েছে তা ইঙ্গিত দিতো। ১৯ শতকে শেষের দিকে ব্রিটিশরা খেলাটি নিজেদের উপযোগী করে গড়ে নেয়। মূল বিষয়কে স্থির রেখে, এই সাপ লুডু খেলার সাথে নানা উপদেশমূলক বাণী সংযুক্ত হয়। কালের সাথে সাথে বিবর্তনে খেলাটি জনপ্রিয়তা হারায় নি বরং প্রযুক্তির কাঁধে কাঁধ দিয়ে খেলাটির গুরুত্ব ক্রমশ বেড়ে উঠেছে৷ 

তথ্যসূত্র - ইন্টারনেট 
সাপ লুডুর উৎস সন্ধানে - নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours