প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:
মানুষ অলৌকিক কিছু আশা করতে ভালোবাসে৷ আর সেই আশার একটি সৌধ গড়ে তোলে৷ আর সৌধ ভেঙে গেলেই মানুষ নিয়তিকে দোষারোপ করে৷ আসলে অস্বীকার করে চলতে চাইলেই সমস্যা৷ জীবন মানে প্রতি বাঁকে নতুন সংঘর্ষ।
সংঘর্ষ যখন নিজের মনের গভীরে আসে, তখন নিজের সাথে আর তারপরেই সমস্ত পৃথিবী জুড়ে সংঘর্ষ বেঁধে যায়৷ ইতিহাসের পাতায় স্থির স্থান করতে মূল্য দিতে হয় নিত্য।সেই মূল্য সইবার মতো শক্তি, সামর্থ্য, মনোবল কারই বা থাকে!
অনেক সময় মনে হয়, জীবনে চোখের জলের দাম কেই বা দেয়! তবু অনুভব, সমবেদনা আসে জীবনে। ষড়রিপুর আঘাত তো শরীরের অধিকার৷ পুনরুদ্ধারের শপথ যেন আলোকিত অভিযাত্রীর যাত্রাপথে একাই দাম দেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু দাম দেবে, এ প্রত্যাশা করাটাই তো বৃথা। আবার সেই আশার ছলনায় কাঙাল নিয়তি আকর্ষণ। অনাঘাত, অনাগত অশ্রু কি রোজ মানায়! ঋতুতে ঋতুতে নতুন করে অচেনা মনের কোলে ধরা দেয় বনভূমি।
নবাগত সম্পর্কে দাঁড়াল হরিণের জড়াজড়ি আতিথেয়তা, সন্ত্রস্ত ঝোপে ক্রোধে একলা যাযাবরের ভবিতব্য অঘটন, এও নিবিড় বেদনায় হতাশার ব্যঞ্জনা।
বুনো মহিষের বলিষ্ঠ পরিচিতি যেন উজাড় করা সাহসী তীর্থযাত্রী পাণ্ডুদের পথ আটকে দাঁড়ায়। মনে পড়ে হিড়িম্বার বিকৃত লালসার মুখে অবাঞ্ছিত অতিথিরা৷ ভয় মিশিয়ে ঐশ্বর্যের বাহুবল। জীবনে পরিপূর্ণতা পাওয়াটাই তো হলো আসল কাজ। কিন্তু অতীতকে কি ছুঁড়ে ফেলা যায়। অনুভূতি, উপলব্ধিতে, গন্ধ,বর্ণ, স্মৃতি জুড়েই আত্মা সংযম। মনে পড়ে মহাসিন্ধুর মতো ডাক, ফুল বিছানায় পাণ্ডুর চলন, প্রত্যাশার ক্ষণে আকুল উথাল পাতাল বাদ্যধ্বনি, এও কি প্রশ্রয়! মনের প্রশ্রয়ে মোহ অতিষ্ট জিজ্ঞাসা যেন বাঁচার জন্য দরদ আখ্যা দেয়। কুন্তীর জীবনে কেন, নারী জীবনেই বা একনিষ্ঠ আশ্রয় নেই।অতীত চিন্তা করতে বার বার লজ্জা হয়। ব্যর্থতায় আত্মঘাতী হতে মন চায়। পথের তো শেষ নেই, কেবল নিরন্তর চলা।
কুন্তী চান নি দ্রৌপদীর পাঁচ স্বামী হোক৷ তাঁর জন্য দুশ্চিন্তা হয়। অনুশোচনায় বলেছিলেন, তিনি কেবল নিজের সন্তানদের কথা ভেবেছেন; একবারো তিনি দ্রৌপদীর কথা ভাবেন নি। প্রেম, প্রীতি, ভালোবাসা, আনুগত্য, বিশ্বাস, সহযোগিতা, ঐক্য, সংহতি সকল পাঁচ ভাইয়ের মালায় দ্রৌপদীকে গেঁথে দিলেন৷ তিনি কিন্তু নিজের বন্ধন আলগা করতে কোনোদিন শেখেন নি৷ তবে কি বলা যায়, আকর্ষণ তাঁর নিয়তি! যুধিষ্ঠির মতো জিতেন্দ্রিয় ছেলেও চিত্তও আকর্ষণ করেছেন। জীবমাত্রেই প্রবৃত্তের বশ। এখানে ছোট বড়ো, আত্মীয়, ভ্রাতা, সুশ্রী, কুশ্রী, নীতি, ধর্ম বলে কিছু নেই। এই প্রবৃত্তিতে মানুষ ও পশুতে তফাৎ নেই।
অভিমানে তো বুক ভরবেই। পশু সমাজে অনেক কিছুই চলে৷ সেখানে চিত্তকে সংযত রাখার জন্য নিয়ম নীতির অনুশাসনের পাকে পাকে মানুষ তার নিজেকে বেঁধেছে। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে এক স্ত্রীর পঞ্চ স্বামীর ভোগ্য রূপ দেওয়ার নির্লজ্জ বাসনা কোনো মেয়ে কি মেনে নিতে পারে! পশুকে শৃঙখলে রাখলে পশু রাগে, ক্ষোভে গজরায়। আরো হিংস্র হয় সে। অতৃপ্ত বাসনা, কামনা আজ যেন কুন্তীর বুকে বিদ্রুপ সৃষ্টি করে। সেদিন তিলোত্তমা দ্রৌপদী তাদের জীবনে ঝড় আনে। কুন্তী ভাইদের মধ্যে বৈরীতার ভয় পেয়েছিলেন। কুন্তী সেদিন প্রবৃত্তিগামী পুত্রদের অন্যায় মেনে নিয়ে নিষ্পাপ ফুলকে পিষে হত্যা করেন। আসলে মানুষ কি তবে মনের অয়নপথ ভালো করে চেনে না! সমাজের এতো অনুশাসন, তবু নারীকে সম্পত্তি ভেবে যথেচ্ছাচার থামে নি। নারী যে বন্ধন আর ঐক্যের সংহতি চিহ্ন কয়জন মেনেছে সে কথা! সংস্কার নিছক বিলাসিতা। আর সংস্কারে জীবন উন্নত হয় না।
জীবন বড়ো বিচিত্র। কুন্তীর জীবনে দুর্লভ আসনে সমাসীন মহিমা দেবীমূর্তির মতোই তো এসেছে সম্রাজ্ঞী কুন্তী। কিন্তু কারোর নিকটবর্তী থাকতে চাওয়ার প্রয়াস, না সেটা হয়ে ওঠে নি। তাহলে জীবনে যন্ত্রণাবিদ্ধ কষ্ট কুন্তীকে পেতে হতো না৷ কর্মফল তাঁকে কেন্দ্রবিন্দু করেছে। চিত্তবৃত্তি থেকে প্রায়শ্চিত্ত, আর উত্তরণের খোঁজ নিরন্তর। ভালোলাগার ক্ষণটুকুর বোধ, ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিঃস্ব করেছে তাঁকে। বিদুর তাঁর জীবনে রক্তের উষ্ণতায় মিলিত হয়েছে। গভীর প্রেমের সমুদ্রে অবগাহন করে সাঁতার দিতে দিতে অভিমান তো আসতেই পারে৷ স্রোতের বুকেই তো লুকিয়ে থাকে সম্পর্কের চোরাবালি।
বাকি রয়ে গেলো কর্ণকথা। সমবেদনা, সহানুভূতি সব ছুঁয়েই তো মহাকালের কাছে নির্দেশ, অপরাধী বোধ৷ কুন্তী তো বিনিসুতোর মালার মতো পলকা এক সম্পর্ক। মনকে দেখানো তো আয়না থাকে না, তাই কপটতাই যে কুন্তীর অনুগ্রহ ভিক্ষায় তা আর বলে দিতে হয় না। আবেগঘন মুহুর্তে তাই কর্ণ আশ্বানদীর উত্তাল স্রোতে মঞ্জুষায় ভাসিয়ে দেওয়া কথা কি ভুলতে পারে। অসহায় নিয়তির বুকে অনির্দেশ মহাকাল নিঃশেষ করে দিয়েছে তার মন। মানুষ শতেক চেষ্টাতেও বসন্তের ফুল শরতে ফোটাতে সক্ষম হয় না । গুপ্তচরের ন্যায় যে জননী অভিনয় তা কি জীবনের নিরাপত্তা দিতে পারে! অবহেলার কাছে আশা তো বিমুখ।
মা হয়ে কুন্তী দীন হয়েছেন সন্তানের কাছে। হতভাগ্যের প্রাণহীন দেহ, বিষন্ন বেদনায় আত্মীয় বন্ধন বড়ো শিথিল৷ মায়ের কাছে যে জীবনের মর্ম নেই, সেই জীবন বহন করা যায় না। তবে না হয় অবহেলার দেহ মায়ের পায়ের কাছে পড়ে থাকলে, সেদিন যেন কুন্তী করুণা করেন। ভাবনার মধ্যে অনুশোচনার অনুক্ষণ বর্তমান। তাই কুন্তী আজ অনুশোচনাকে সঙ্গী করে প্রতিদিন পুড়ে মরতে চান নি, একেবারে দাবানলে আগুনে পুড়ে মরে যেতে চায়। মাদ্রীর সহমরণের পাপ, নিষাদ রমণী ও তাঁর পাঁচ পুত্রের বারাণাবতে হত্যা করার পাপ, কর্ণকে বঞ্চনা করার পাপ, প্রতারণা করার পাপের প্রায়শ্চিত্ত হবে কি করে!! তাই আজ রুদ্রকে তিনি আহ্বান করেছেন, "আমাকে গ্রাস করো। "
রুদ্র শুনলেন, তাঁর কথা। শুকনো গাছের ডাল এসে পড়ে কুটিরের চাল ভেঙে যায়। এবার খড়ের আগুনে অনুপ্রবেশ করেন কুন্তী। ভয় তো জীবনের আদিম ও অকৃত্রিম বিষয়। ঘাতকের মতো মৃত্যু পরায়ণা। আজ আর পালানোর পথ বন্ধ। দুঃসহ তাপে দগ্ধ হয়ে আসে দম৷ চোখের বিভীষিকাময় অনুভব। এবার শেষ, লম্বা ঘুম এবার। (সমাপ্ত)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours