মমতা দে, লেখিকা, কলকাতা:
বেশ কয়েক দশক শখের নাট্যচর্চার পর ১৮৭২ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হল সাধারণ রঙ্গালয়, ন্যশনাল থিয়েটার। এই সময় বাঙালির নাট্যচর্চায় পাশ্চাত্যের প্রভাব ছিল অপরিসীম। সেই হাওয়া এসে লাগল ঠাকুরবাড়ির সংস্কৃতিচর্চার পালে । এর কয়েকবছর পর ১৮৮০ সালে রবীন্দ্রনাথ বিলেত থেকে দেশে ফিরলেন। ফিরে এসেই ঠাকুরবাড়ির সঙ্গীত এবং নাটকের ধারাবাহিকতায় নিজেকে মিশিয়ে দিলেন। বিলেতে থাকাকালীন তিনি 'কনসার্ট এবং 'অপেরা'য় আকৃষ্ট হয়েছিলেন। পশ্চিমী সুরের রোমান্টিকতা সম্পর্কে তিনি উল্লেখ করেছেন 'জীবনস্মৃতি' গ্রন্থে। অপেরা হল এক বিশেষ ধাঁচের নাটক যেখানে নাটকের সংলাপে সুরারোপ করা হয়। নাটকের কুশীলবরা একক, দ্বৈত বা সমবেতভাবে সেই সংলাপ বলে থাকেন। এর সাথে কিছু পূর্ণাঙ্গ গানও থাকে। অপেরার উদ্ভব হয়েছিল ইতালিতে। ক্রমশঃ সমগ্র ইউরোপ জুড়ে এর জনপ্রিয়তা লক্ষ্য করা গিয়েছিল। কবির জ্যোতিদাদাও ইতিমধ্যেই নতুন ধরণের নাটক রচনা করেছেন, যা অনেকটাই অপেরা ধাঁচের। বাংলায় এই জাতীয় নাটককে গীতিনাট্য বলা চলে।
পরের বছরই কবি রচনা করেন 'বাল্মীকি প্রতিভা' (১৮৮১), তারপর কালমৃগয়া (১৮৮২)। এই দুটি গীতিনাট্য এবং পরবর্তীকালে 'মায়ার খেলা'য় কবির সঙ্গীত রচনায় পাশ্চাত্যের প্রভাব সুস্পষ্ট। পাশ্চাত্যের সুরারোপিত এই গানগুলিই ভাঙ্গাগান নামে পরিচিত। মূল গানগুলি ছিল মূলতঃ ইংরেজি, স্কটিশ এবং আইরিশ ভাষায়। 'বাল্মীকি প্রতিভা'য় একখানি গান, 'কালি কালি বল রে আজ' -- এর সুর ফ্রেডরিক রচিত 'ন্যানসি লি' (Nancy Lee...)র সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। যার সুরকার ছিলেন স্টিফেন অ্যাডামস। গানটিতে এক নাবিক তার পত্নির গুণগান করেছেন। কিন্তু কবির গানের যে কথা, তাতে বিষয়বস্তু সম্পূর্ণ পৃথক। এখানে গানটি ডাকাত দলের সম্মেলক গান। এক বিখ্যাত স্কটিশ লোকগীতি 'অল্ড ল্যং সাইন' (Ault lang syne) । এর সুর প্রাচীন। সাধারণতঃ বিদায় সভা বা পুনর্মিলনের সভায় গানটি গাওয়া হত। গানটির মূলভাব এবং সুরের সমন্বয়ে কবি রচনা করেন 'পুরানো সেই দিনের কথা'। অষ্টাদশ শতাব্দীর সময়কালে ইংল্যান্ডের একখানি গান 'ভিক্টর অফ প্রে'--র সুর তিনি আরোপ করেছেন কালমৃগয়া গীতিনাট্যের 'ও দেখবি রে ভাই' গানখানিতে। আইরিশ কবি টমাস ম্যূর রচিত 'গো হোয়্যার গ্লোরী ওয়েটস' (Go where glory waits)-- এর অনুসরণে মোট চারখানি গান তিনি রচনা করেন। সেগুলি হল 'ওহে দয়াময়', 'মরি ও কাহার বাছা' , 'মন না মানিলি' এবং 'আহা এ বসন্তে'। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বেন জনসনের 'ড্রিংক টু মি ওনলি' (Drink to me only...) গানখানি রচিত হয় যার সুরকার হিসেবে নাম পাওয়া যায় কর্ণেল আর মেলিস এবং মোৎজার্টের। কবি রচনা করেন 'কতবার ভেবেছিনু' । মূল গান এবং ভাঙ্গাগান, দুয়েরই বিষয়বস্তু ছিল প্রেম। স্কটিশ কবি এবং লোকগীতি সংগ্রাহক রবার্ট বার্ণস --এর 'ইয়ে ব্যাঙ্ক এন্ড বিইস' (Ye bank and beaes)-- এর সুরে তিনি সৃষ্টি করেন 'ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে' । মূল গানখানিতে বিরহের দুঃখ প্রকাশিত আর ভাঙ্গাগানটিতে চরম আনন্দের উৎকর্ষ লক্ষ্য করা যায়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে আয়ারল্যান্ডের লেডি ক্যারোলীন তার প্রেমিক রবীনের স্মরণে লিখেছিলেন 'রবীন অ্যাডেন'। কবি লিখলেন 'সকলি ফুরাল' । দুইখানি গানেই শূন্যতার ভাব রয়েছে।
আরও বেশ কিছু গান, যেগুলোর রাগ-রাগিনী ভারতীয় হয়েও গানগুলি চলনে ইউরোপীয়। এই প্রসঙ্গে 'আলো আমার আলো' (লাইট ডিয়ার মাই লাইফ), 'তোমার হল শুরু , আমার হল সারা' (ইয়োর লাইফ হ্যাজ বিন গান, মাই লাইফ হ্যাজ এন্ডেড), 'হারে রে রে', 'আমি চিনি গো চিনি' (আই নো ইউ) উল্লেখযোগ্য।
তবে কেবলমাত্র ইউরোপীয় সঙ্গীতই যে তাঁর হৃদয় হরন করেছিল এমন নয়। ভারতীয় বিভিন্ন প্রদেশের, নানা ঘরানার গানের সুর, তাল রাগ তিনি আহরণ করে এনেছেন তাঁর সৃষ্টিকে সমৃদ্ধ করার জন্য। কখনও রাগ ভেঙেছেন, কখনও একাধিক রাগের মিশ্রণ ঘটিয়েছেন। মূল গান কোথাও ছিল ধ্রুপদ, ধামার, খেয়াল। কোথাও বা টপ্পা , ঠুংরী বা নিছক প্রাদেশিক সঙ্গীত। লোক সঙ্গীত , বাউল বা কীর্তনাঙ্গও বাদ পড়েনি। ধামার তালে, ভৈরবী রাগের উপরে আধারিত 'বিণ বাজাই রে' র প্রেরণায় রচনা করলেন 'বীনা বাজাও রে'। এই শ্রেণীর গান দ্রুত তালে গীত হয়। সাধারণতঃ শ্রীকৃষ্ণের লীলাই গানের বিষয়বস্তু। মূল গানের সাথে ভাঙ্গাগানের বিষয়বস্তুতে বৈসাদৃশ্য রয়েছে। হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীত 'আয়ো ফাগু বহমান', 'ছুঁয়ো মোরে' (খেয়াল), 'ও মিঞা বে জনুয়ালে' (টপ্পা) , 'দারা দ্রিম দ্রিম' গানগুলি থেকে কবি সুরারোপ করেছেন যথাক্রমে 'সুধা সাগর তীরে', 'আঁখিজল মুছাইলে'(ত্রিতাল, রামকেলি রাগ), 'এ পরবাসে', 'সুখহীন নিশিদিন' (তারানা সুরে) গানগুলিতে। রবীন্দ্রনাথের টপ্পা হিন্দুস্থানী টপ্পার থেকে খানিক আলাদা হয়। কবির টপ্পার লয় ধীর হয় এবং একই স্বরের আন্দোলন প্রাধান্য পায়। 'মহারাজা তিজোরিয়া খোল' (ঠুমরী) থেকে কবি রচনা করলেন 'খেলার সাথী বিদায়'। কর্নাটী গান 'মীনাক্ষিখে মুদম' থেকে 'বাসন্তী হে ভুবনমোহিনী', কানাড়ী গান 'সখী বা বা' থেকে ' বড় আশা করে এসেছি গো', মাদ্রাজী গান 'নিতু চরনমূল ' থেকে একী লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ', মারাঠি গান 'নানবিদ্যা পরব্রহ্মা ' অনূসরনে 'বিশ্ববীণা রবে'। এবারে আসি বাংলার লোকগানের কথায়। বাংলাদেশের সবুজ নিস্তরঙ্গ প্রকৃতির স্নেহরসে লালিত গ্রামবাংলার সহজ মেঠোসুরও কিন্তু সমানভাবে আন্দোলিত করেছিল কবির হৃদয়। 'হরিনাম দিয়ে জগত মাতালে আমার একলা নিতাই' থেকে 'যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে', 'দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষে'র অনূসরণে 'ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি' , বা কীর্তনের সুরে 'ঐ আসনতলে', রামপ্রসাদী সুরে 'আমি শুধু রইনু বাকি' র সৃষ্টি করেন তিনি।
পরিশেষে বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ বাংলা গানকে রাগ- রাগিনী, তাল- লয়ের গুরুভার থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। প্রাচ্য বা পাশ্চাত্যের সুর বা কথা তিনি গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তা কখনই অনুকরণ হয়ে ওঠেনি। বরং তুলনায় সহজতর সুরে, আর কবির হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে উৎসারিত মধুর বাণীর সমন্বয়ে গঠিত এই নূতন ধরণের গান আপামর বাঙালির হৃদয় হরন করেছিল। সেই কালজয়ী সৃষ্টি আজ অবধি আমাদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার সাথী, আমাদের জীবন পথের পাথেয়।
বেশ কয়েক দশক শখের নাট্যচর্চার পর ১৮৭২ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হল সাধারণ রঙ্গালয়, ন্যশনাল থিয়েটার। এই সময় বাঙালির নাট্যচর্চায় পাশ্চাত্যের প্রভাব ছিল অপরিসীম। সেই হাওয়া এসে লাগল ঠাকুরবাড়ির সংস্কৃতিচর্চার পালে । এর কয়েকবছর পর ১৮৮০ সালে রবীন্দ্রনাথ বিলেত থেকে দেশে ফিরলেন। ফিরে এসেই ঠাকুরবাড়ির সঙ্গীত এবং নাটকের ধারাবাহিকতায় নিজেকে মিশিয়ে দিলেন। বিলেতে থাকাকালীন তিনি 'কনসার্ট এবং 'অপেরা'য় আকৃষ্ট হয়েছিলেন। পশ্চিমী সুরের রোমান্টিকতা সম্পর্কে তিনি উল্লেখ করেছেন 'জীবনস্মৃতি' গ্রন্থে। অপেরা হল এক বিশেষ ধাঁচের নাটক যেখানে নাটকের সংলাপে সুরারোপ করা হয়। নাটকের কুশীলবরা একক, দ্বৈত বা সমবেতভাবে সেই সংলাপ বলে থাকেন। এর সাথে কিছু পূর্ণাঙ্গ গানও থাকে। অপেরার উদ্ভব হয়েছিল ইতালিতে। ক্রমশঃ সমগ্র ইউরোপ জুড়ে এর জনপ্রিয়তা লক্ষ্য করা গিয়েছিল। কবির জ্যোতিদাদাও ইতিমধ্যেই নতুন ধরণের নাটক রচনা করেছেন, যা অনেকটাই অপেরা ধাঁচের। বাংলায় এই জাতীয় নাটককে গীতিনাট্য বলা চলে।
পরের বছরই কবি রচনা করেন 'বাল্মীকি প্রতিভা' (১৮৮১), তারপর কালমৃগয়া (১৮৮২)। এই দুটি গীতিনাট্য এবং পরবর্তীকালে 'মায়ার খেলা'য় কবির সঙ্গীত রচনায় পাশ্চাত্যের প্রভাব সুস্পষ্ট। পাশ্চাত্যের সুরারোপিত এই গানগুলিই ভাঙ্গাগান নামে পরিচিত। মূল গানগুলি ছিল মূলতঃ ইংরেজি, স্কটিশ এবং আইরিশ ভাষায়। 'বাল্মীকি প্রতিভা'য় একখানি গান, 'কালি কালি বল রে আজ' -- এর সুর ফ্রেডরিক রচিত 'ন্যানসি লি' (Nancy Lee...)র সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। যার সুরকার ছিলেন স্টিফেন অ্যাডামস। গানটিতে এক নাবিক তার পত্নির গুণগান করেছেন। কিন্তু কবির গানের যে কথা, তাতে বিষয়বস্তু সম্পূর্ণ পৃথক। এখানে গানটি ডাকাত দলের সম্মেলক গান। এক বিখ্যাত স্কটিশ লোকগীতি 'অল্ড ল্যং সাইন' (Ault lang syne) । এর সুর প্রাচীন। সাধারণতঃ বিদায় সভা বা পুনর্মিলনের সভায় গানটি গাওয়া হত। গানটির মূলভাব এবং সুরের সমন্বয়ে কবি রচনা করেন 'পুরানো সেই দিনের কথা'। অষ্টাদশ শতাব্দীর সময়কালে ইংল্যান্ডের একখানি গান 'ভিক্টর অফ প্রে'--র সুর তিনি আরোপ করেছেন কালমৃগয়া গীতিনাট্যের 'ও দেখবি রে ভাই' গানখানিতে। আইরিশ কবি টমাস ম্যূর রচিত 'গো হোয়্যার গ্লোরী ওয়েটস' (Go where glory waits)-- এর অনুসরণে মোট চারখানি গান তিনি রচনা করেন। সেগুলি হল 'ওহে দয়াময়', 'মরি ও কাহার বাছা' , 'মন না মানিলি' এবং 'আহা এ বসন্তে'। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বেন জনসনের 'ড্রিংক টু মি ওনলি' (Drink to me only...) গানখানি রচিত হয় যার সুরকার হিসেবে নাম পাওয়া যায় কর্ণেল আর মেলিস এবং মোৎজার্টের। কবি রচনা করেন 'কতবার ভেবেছিনু' । মূল গান এবং ভাঙ্গাগান, দুয়েরই বিষয়বস্তু ছিল প্রেম। স্কটিশ কবি এবং লোকগীতি সংগ্রাহক রবার্ট বার্ণস --এর 'ইয়ে ব্যাঙ্ক এন্ড বিইস' (Ye bank and beaes)-- এর সুরে তিনি সৃষ্টি করেন 'ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে' । মূল গানখানিতে বিরহের দুঃখ প্রকাশিত আর ভাঙ্গাগানটিতে চরম আনন্দের উৎকর্ষ লক্ষ্য করা যায়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে আয়ারল্যান্ডের লেডি ক্যারোলীন তার প্রেমিক রবীনের স্মরণে লিখেছিলেন 'রবীন অ্যাডেন'। কবি লিখলেন 'সকলি ফুরাল' । দুইখানি গানেই শূন্যতার ভাব রয়েছে।
আরও বেশ কিছু গান, যেগুলোর রাগ-রাগিনী ভারতীয় হয়েও গানগুলি চলনে ইউরোপীয়। এই প্রসঙ্গে 'আলো আমার আলো' (লাইট ডিয়ার মাই লাইফ), 'তোমার হল শুরু , আমার হল সারা' (ইয়োর লাইফ হ্যাজ বিন গান, মাই লাইফ হ্যাজ এন্ডেড), 'হারে রে রে', 'আমি চিনি গো চিনি' (আই নো ইউ) উল্লেখযোগ্য।
তবে কেবলমাত্র ইউরোপীয় সঙ্গীতই যে তাঁর হৃদয় হরন করেছিল এমন নয়। ভারতীয় বিভিন্ন প্রদেশের, নানা ঘরানার গানের সুর, তাল রাগ তিনি আহরণ করে এনেছেন তাঁর সৃষ্টিকে সমৃদ্ধ করার জন্য। কখনও রাগ ভেঙেছেন, কখনও একাধিক রাগের মিশ্রণ ঘটিয়েছেন। মূল গান কোথাও ছিল ধ্রুপদ, ধামার, খেয়াল। কোথাও বা টপ্পা , ঠুংরী বা নিছক প্রাদেশিক সঙ্গীত। লোক সঙ্গীত , বাউল বা কীর্তনাঙ্গও বাদ পড়েনি। ধামার তালে, ভৈরবী রাগের উপরে আধারিত 'বিণ বাজাই রে' র প্রেরণায় রচনা করলেন 'বীনা বাজাও রে'। এই শ্রেণীর গান দ্রুত তালে গীত হয়। সাধারণতঃ শ্রীকৃষ্ণের লীলাই গানের বিষয়বস্তু। মূল গানের সাথে ভাঙ্গাগানের বিষয়বস্তুতে বৈসাদৃশ্য রয়েছে। হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীত 'আয়ো ফাগু বহমান', 'ছুঁয়ো মোরে' (খেয়াল), 'ও মিঞা বে জনুয়ালে' (টপ্পা) , 'দারা দ্রিম দ্রিম' গানগুলি থেকে কবি সুরারোপ করেছেন যথাক্রমে 'সুধা সাগর তীরে', 'আঁখিজল মুছাইলে'(ত্রিতাল, রামকেলি রাগ), 'এ পরবাসে', 'সুখহীন নিশিদিন' (তারানা সুরে) গানগুলিতে। রবীন্দ্রনাথের টপ্পা হিন্দুস্থানী টপ্পার থেকে খানিক আলাদা হয়। কবির টপ্পার লয় ধীর হয় এবং একই স্বরের আন্দোলন প্রাধান্য পায়। 'মহারাজা তিজোরিয়া খোল' (ঠুমরী) থেকে কবি রচনা করলেন 'খেলার সাথী বিদায়'। কর্নাটী গান 'মীনাক্ষিখে মুদম' থেকে 'বাসন্তী হে ভুবনমোহিনী', কানাড়ী গান 'সখী বা বা' থেকে ' বড় আশা করে এসেছি গো', মাদ্রাজী গান 'নিতু চরনমূল ' থেকে একী লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ', মারাঠি গান 'নানবিদ্যা পরব্রহ্মা ' অনূসরনে 'বিশ্ববীণা রবে'। এবারে আসি বাংলার লোকগানের কথায়। বাংলাদেশের সবুজ নিস্তরঙ্গ প্রকৃতির স্নেহরসে লালিত গ্রামবাংলার সহজ মেঠোসুরও কিন্তু সমানভাবে আন্দোলিত করেছিল কবির হৃদয়। 'হরিনাম দিয়ে জগত মাতালে আমার একলা নিতাই' থেকে 'যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে', 'দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষে'র অনূসরণে 'ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি' , বা কীর্তনের সুরে 'ঐ আসনতলে', রামপ্রসাদী সুরে 'আমি শুধু রইনু বাকি' র সৃষ্টি করেন তিনি।
পরিশেষে বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ বাংলা গানকে রাগ- রাগিনী, তাল- লয়ের গুরুভার থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। প্রাচ্য বা পাশ্চাত্যের সুর বা কথা তিনি গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তা কখনই অনুকরণ হয়ে ওঠেনি। বরং তুলনায় সহজতর সুরে, আর কবির হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে উৎসারিত মধুর বাণীর সমন্বয়ে গঠিত এই নূতন ধরণের গান আপামর বাঙালির হৃদয় হরন করেছিল। সেই কালজয়ী সৃষ্টি আজ অবধি আমাদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার সাথী, আমাদের জীবন পথের পাথেয়।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours