আনন্দিতা রায়, লেখিকা ও সঙ্গীতশিল্পী, দুর্গাপুর:

"তোমারি নামে নয়ন মেলিনু পুণ্য প্রভাতে আজি"
"প্রভাতের প্রণাম লইয়া
উদয় দিগন্ত পানে মেলিলাম আঁখি,
দেখিলাম সদ্যস্নাত ঊষা
আঁকি দিল আলোকচন্দনলেখা
হিমাদ্রীর হিমশুভ্র পেলব ললাটে"
 ‌‌                                -রবীন্দ্রনাথঠাকুর

কয়েক হাজার পরিযায়ী শ্রমিক, পড়ুয়া, ভ্রমণ পিয়াসী, তীর্থযাত্রী ব‍্যতিত, আমরা বাকি বাঙালি গত ৪৫ দিন ধরে বন্দি আছি আপন নিভৃতাবাসে । নিকট মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগের উপায়হীন আমরা বুকে জড়িয়ে ধরতে পারছিনা প্রতিবেশী ভালবাসার মানুষদের, স্নেহধন্য স্বজন-বন্ধুদের । সেই চেনা সুগন্ধের অভাব পূরণ করছে স্মার্টফোন ----- তাদের চলমান প্রতিচ্ছবি ও ভাষ‍্য চোখের আলোয় প্রকাশ করে।

এই লকডাউনের মধ‍্যে এসে পড়লো বাঙালির অন‍্যতম মিলনোৎসব রবীন্দ্রপার্বন । বাঙালির না বুঝতে শেখা বয়েস থেকেই এই পার্বনের সঙ্গে তার যোগ । তারপর সহজ পাঠের মধ্যে দিয়ে ছোট্ট মনে তাঁর ছবি আঁকা ----- শুরু হওয়া তাঁর সঙ্গে সুনীবিড় সংযোগ । বাঙালি ঘরের শিশু ও কিশোর -কিশোরী রবীন্দ্রপার্বনের অনুষ্ঠান উপলক্ষ‍্যে রবীন্দ্র কবিতা, গান, নৃত্য ও নাটকে অংশগ্রহণ করেনি এমন সংখ্যা খুব কম।

যৌবনে বাঙালি তাঁকে চিনেছে একজন নিরপেক্ষ তীক্ষ্ণদৃষ্টির প্রজ্ঞাবান প্রেমিক কবি হিসেবে । যাঁর করুণাচুম্বিত প্রজ্ঞায় স্নাত হয়েছে পূর্বাপর বাঙালির জীবন ----- তাঁর সুরচ্ছন্দিত কাব‍্য সঙ্গীতে আপ্লুত হয়েছে যুবক-যুবতীরা । বন্ধঘরের জানলা খুলে আপন মনে গুনগুন করে গাইছে -----
আজও লকডাউনে পিঞ্জরাবদ্ধ বাঙালি যুবক-যুবতীরা অনায়াসে দেহের সীমা পেরিয়ে যায় ----- মিলে যায় কুঞ্জ বীথির সিক্ত যুঁথির গন্ধে মত্ত হাওয়ার ছন্দে । গানটির রচনা কাল ১৩৪৪ বঙ্গাব্দের বর্ষা হলেও ঘরবন্দি বাঙালি যুবক-যুবতীর কাছে এ গান হয়ে ওঠে মুক্তির গান।
প্রৌঢ় বাঙালির কাছে রবীন্দ্রগানের বানী বাক-এর বাঁধন কেটে নিয়ে যায় অবাকের সীমাহীনতায় । লকডাউনের একাকীত্বে প্রৌঢ় বাঙালির মননের সঙ্গী হয় রবীন্দ্রনাথের গান ----- ভাবনায়, কল্পনায় । রবীন্দ্রনাথের মুক্তির স্বাদের শরিক হয় সে।

একলা ঘরে বসে প্রৌঢ় বাঙালি অনুভব করে চাওয়া পাওয়ার বুকের ভেতর না ফোটা ফুলের সৌরভ।
বৃদ্ধ বাঙালি তার এই বন্দিজীবনের নৈরাশ্যের মাঝেও রবীন্দ্রনাথের গানে খুঁজে পায় গভীর প্রশান্তি পাড়ের তরীর আশা ছেড়ে দিয়ে কল্পনার ঘাটে বসে স্রোতস্বিনীকে দেখতে দেখতে তৃপ্তি বোধ করে সে।

রবীন্দ্রনাথকে আঁকড়ে ধরে বৃদ্ধ বাঙালি তাঁর কাছ থেকেই মুক্তির সন্ধান পেতে চায় । যেমন করে পাষাণী অহল‍্যা কাতরভাবে রামচন্দ্রের কাছে মুক্তি প্রার্থনা করেছিলেন । লকডাউনের বন্ধঘরে অহল‍্যাই তার অনুভব, তার হৃদয়ের কবিসত্বাও বটে ।ঘরবন্দি বাঙালির একলা ঘরে কাটবে এবারের পঁচিশে বৈশাখ। এবারের পঁচিশে বৈশাখের প্রার্থনা হোক নব জনমের অমল আয়ু  "হে চিরনূতন আজি এ দিনের প্রথম গানে...।"

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours