সাগরিকা মুখোপাধ্যায়, লেখিকা, কলকাতা: 

ঝড়। মাত্র দু অক্ষরের শব্দ তাও যুক্তাক্ষরহীন। কিন্তু বিস্তৃতি? ব্যাখ্যা করার সাধ্য আমার নেই। ওই ছোট্ট শব্দের মধ্যে কি ভয়াবহতা লুকিয়ে থাকতে পারে দেখিয়ে দিয়ে গেল আম্ফান।

আয়লা দেখেছি। দেখেছি তার ভয়াল রূপও। চোখের সামনে দিয়ে উড়ে যেতে দেখেছি সরখেলদের চাল, চোখের সামনে পড়ে যেতে দেখেছি বর্মনদের নারকেল গাছ। দেখেছি। কারণ দেখতে পেয়েছি, জানলা খুলে রাখতে পেরেছিলাম বলে।  দোতলার যে ঘরটিতে বসে এসব দেখেছি ১১বছর আগে, গত পরশু সেই ঘরের জানলা খুলে রাখার সাহস করতে পারিনি আম্ফানের পূর্বাভাসে। সবটা ঘরের ভিতর থেকে উপলব্ধি করলেও মাঝে মাঝে ছোট লোহার জানলা খুলে দেখেছি সন্তর্পনে। ভয়াবহতার যে চিত্র আগেই দেওয়া হয়েছিল, তা যে এত কঠিন সত্য হবে ভাবতে পারিনি। 

বিকেল ৪টে থেকে শুরু হয় ঝড়ের প্রকোপ। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বৃষ্টি। টাটা স্কাই হাত তুলে দিলেও লোকাল কেবেল ঝড়ের গতিবিধি দেখাতে শুরু করেছিল। ঝড়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলছিল বিভিন্ন চ্যানেলের সাংবাদিকদের ঝড় কভারেজের প্রতিযোগিতা। কিন্তু সাড়ে চারটের পর বিজলি ও কেবেল একসাথে দেহ রাখল। এবং দেহ রাখল বলেই ক্যামেরার লেন্সের বদলে স্বচক্ষে ও স্বকর্ণে অনুভব করলাম ঝড়ের প্রতিটি অনুক্ষণ।

সময়ে যত এগোতে লাগল পাল্লা দিয়ে চলতে লাগল ঝড়ের দাপট। এ যে কি ভয়ঙ্কর ঝড়, প্রত্যক্ষ না করলে বিশ্বাস করা অসম্ভব। শোঁ শোঁ শব্দে হাওয়া বয়ে চলেছে মুহুর্মুহু। তার সাথে যুগলবন্দিতে চলেছে মেঘের সদর্প গম্ভীর আস্ফালন আর বিদ্যুতের ঝলকানি। অঝোর ধারায় বৃষ্টির সঙ্গত সম্পূর্ন করেছে করাল রূপের নিপুন বৃত্ত। গাছগুলো মাথা ঝাঁকিয়ে, নিজেদের বাঁকিয়ে চুরিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে। ঘেরা ছাদগুলোর টিন শেড হাওয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করার ব্যর্থ চেষ্টা করে চলেছে। শোঁ শোঁ, গুর গুর, ঝমঝম, ঝনঝন শব্দে তোলপাড় হয়ে উঠছে চরাচর। এই শব্দগুলোকে ছাপিয়ে আরও একটা শব্দ সবাই শুনতে পাচ্ছিলাম....লাবডুব লাবডুব লাবডুব।

 অভিশপ্ত নিষ্প্রদীপ সন্ধ্যায়  বাড়ির সব সদস্য একতলার একঘরে বসে মোমবাতি জ্বেলে মর্মে মর্মে অনুভব করেছি প্রলয়! মনে হচ্ছিল হাওয়ার প্রচন্ড গতিবেগ বিশালাকার রাক্ষসের মত পিষে মেরে ফেলতে চাইছে এই ভূখন্ডকে। বাতাসের প্রবল গর্জন দারুন রোষে লন্ডভন্ড করে দিতে চাইছে চরাচর।  গুঁড়ো করে দিতে চাইছে সভ্যতার বড়াই করা মানুষের দর্প।

রাত ৯টা পর্যন্ত চলল এই মারাত্মক তান্ডব। এরপর ভয়াবহতা কিছুটা কমলেও লাস্যে ফেরেনি প্রকৃতি। পরে একটা জানলা খুলে রেখেছিলাম। বজ্র বিদ্যুৎ বৃষ্টি থেমে গেলেও হাওয়ার দাপট ছিল যথেষ্ট। 'মনের হরষে' 'মোমের বাতি' জ্বালাতে পারিনি বেশিক্ষণ, কারণ মোমবাতি কিনে রাখার সময়ই টের পেয়েছি বাজারে তার অপ্রতুলতা। রাতের খাওয়া দশটার মধ্যে সেরে নিয়েছিলাম। কিন্তু অনভ্যাসে ঘুম আসেনি।

 অমাবস্যার আগের রাত ছিল এই দুর্যোগের রাত, ঘুটঘুটে অন্ধকার মেখে গোটা অভিশপ্ত রাত হাওয়া বইয়েছে বিরামহীন অস্বস্তিকর শব্দে। দ্বিফলা-ত্রিফলার নিয়নে ফালাফালা-হতে অভ্যস্ত আমরা নিষ্প্রদীপ, অন্তর্জালহীন রাত কাটিয়েছি বিনিদ্র। নির্নিমেষ চেয়েছিলাম রাতের আকাশের দিকে। অস্থিরতায় কয়েকবার দেখে এসেছি বাড়ির সবাই ঠিক আছে কিনা, দেখে এসেছি সিঁড়ির তলার জল কতটা বাড়ল, দেখে এসেছি কোনও কল খোলা আছে কিনা। পাকা বাড়িতে বসে, সাবধানী গৃহস্থ জলের ট্যাঙ্ক ভরে রেখে, খাবার জল থেকে মোবাইলের চার্জ সব মজুত রেখেও উতলা হচ্ছি দেখে নিজেই নিজেকে ভর্ৎসনা করেছি। 
মন কেঁদে উঠেছে কাঁচা বাড়ির মানুষগুলোর কথা ভেবে, কেঁপে কেঁপে উঠেছি উপকূলবর্তী মানুষগুলোর দুর্দশার কথা ভেবে। দুচোখের পাতা এক করতে পারিনি করোনা আবহে লক্ষাধিক মানুষের একত্রিত অবস্থানের কথা ভেবে।

ঘুম এলো ভোরের দিকে, আজানের ভৈরব-সুরে, নিশ্চিন্ততায়। জানতামই না রাত সাড়ে তিনটের সময় আধা কিলোমিটার দূরের মসজিদে আজান হয়।

আগের দিন বিকেলে চলে যাওয়া বিদ্যুৎ এলো পরের দিন দুপুরে, বাইশ ঘন্টা পার করিয়ে আর পরের দিন আঠারো ঘন্টা। দু খেপে মোট চল্লিশ ঘন্টা পাওয়ার-কাটের অসুবিধাটুকু  ছাড়া আর কিছু সেভাবে বুঝিনি। 

কিন্তু গত কয়েক দিনে ঝড়ের খতিয়ান দেখে স্তম্ভিত। ভার্চুয়াল জগতের ছবি, খবর এবং চারপাশে মানুষের দুর্দশা দেখে অস্থির হয়ে রয়েছি। জল, বিদ্যুৎ কিচ্ছু নেই একশো ঘন্টা পেরিয়েও। পাঁচ হাজার গাছ আর আড়াই হাজার বাতিস্তম্ভ পড়ে রয়েছে রাস্তায়। অবরোধ হচ্ছে পাড়ায় পাড়ায়। বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে রাস্তা হয়েছে তড়িতাহত। ঝড়ের ধংসলীলায় শহরের রাজপথ চেহারা নিয়েছে জঙ্গলমহলের। জলমগ্ন হয়েছে বইপাড়া,আমাদের ভালবাসার ধন, আমাদের অনুভবের আকর কোটি কোটি টাকার বই বিনষ্ট হয়েছে -- এ হলো শহরের চিত্র।

কিন্তু গ্রাম আর উপকূলবর্তী অঞ্চলের অবস্থা?
অসম্ভব করুন পরিস্থিতি সেখানে। নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে অসংখ্য বাড়ি। বাঁধ ভেঙে গ্রাম কে গ্রাম ডুবে রয়েছে জলের তলায়। জলমগ্ন হয়েছে কৃষিক্ষেত্র, পশুচারণ ক্ষেত্র। নোনা জল নষ্ট করেছে ফসল। মানুষ রয়েছে অবর্ণনীয় কষ্টে।ঝড় কেড়ে নিয়েছে তাদের ঘর, বাড়ি, রুটি, রুজি, সহায় সম্বল, কেড়ে নিয়েছে আশা, ইচ্ছা,  আকাঙ্ক্ষা, জীবনীশক্তি।

কতটা ক্ষয়ক্ষতি হলে জাতীয় বিপর্যয়ের তকমা পাওয়া যায় জানিনা, তবে রাজনীতির ট্রাপিজ অব্যাহত যথারীতি। গিরিশ ঘোষের "বাংলার ভাগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা" আজ সত্য। সত্য কেবল নয় বরং বলা ভাল বাংলা আজ দুর্যোগে জর্জর। কোভিডে মুখ থুবড়ে পড়া রাজ্যের কোমরটাই ভেঙে দিয়ে গেল আম্ফান। জানিনা কবে আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারব।

খুব কষ্ট হচ্ছে উপড়ে পড়া গাছগুলোকে দেখে। শুধু অক্সিজেন দিয়ে আর ছায়া দিয়েই তো নয় কত স্মৃতি, কত বহতা ঘটনার সাক্ষী ওরা, কত পাখির বাসভবনে, জলসাঘর। শুধু কি তাই? কোথাও গাছ ঘিরে চায়ের আড্ডা তো কোথাও সিঁদুর-মাখা পাথরের 'সত্যম শিবম সুন্দরম' হওয়া। ছেড়ে যাবার আগে ভুলুন্ঠিত মায়াভরা পাতা-ডালপালা যেন করুন আকুতি জানিয়ে যাচ্ছে, প্রকৃতি ধ্বংস করে আমরা যেন আর আত্মঘাতী খেলায় মেতে না উঠি।

পারব কি আমরা?

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours