রমা চক্রবর্তী, শিক্ষিকা, আবৃত্তিকার ও ফিচার রাইটার, দুর্গাপুর:

যুগের পরিবর্তন ঘটেছে- সত্য-ত্রেতা-দ্বাপর-কলি যুগ| আমরা এখন আছি কলিযুগে| নারী হল মায়ের জাত,প্রতিটি পুরুষের জীবনে এই জাতি জননী জন্মদাত্রী মাতারূপে, কখনও স্নেহময়ী বোন,কখনও পত্নী/স্ত্রী,কখনও কণ্যা রূপে পাশাপাশি ঘোরাফেরা করে| এই নারী জাতির প্রতীক হিসাবে যারা 'সতী' নামে পরিচিত তারা হলেন পার্বতী, সীতা, কুন্তী, দ্রৌপদী ও মাদ্রী | সেই সত্য-ত্রেতা যুগে নারীরা সাম্রাজ্য চালাত,জনগনের প্রতিনিধিত্ব করত,রাজাকে রাজ্যপাটে সাহায্য করত | আবার কলিযুগেও নারীর বীরত্ব প্রকাশ পায় যেমন -ঝাঁসীর রানী লক্ষ্মীবাঈ, প্রীতিলতা ওয়েদ্দার| নারীকে আমরা দেবতার রূপে পূজো করে থাকি | মানুষকে প্রতিমূহুর্তে অত্যাচারীর হাত থেকে নারীরূপে দেবতার অশরীরি ক্ষমতা উদ্ধার করে থাকে|যেমন- দশপ্রহরিণী দেবী দুর্গা, মা মহামায়া মহাকালী,মা মঙ্গলাচন্ডী, মা বগলামুখী,জয় সন্তোষীমাতা|
এবার আসি "নারী স্বাধীনতা" বলতে কি বোঝায়? এই প্রশ্নটা এখন প্রতিটি সংবাদপত্রের প্রথম খাতায়, দূরদর্শনের পর্দায়, মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে| এর উত্তর খুঁজে পাওয়া মানে বর্তমান সমাজের একটা বিরাট সমস্যার সমাধান করা|
প্রারম্ভিক যুগ থেকেই আমাদের সমাজ পুরুষশাসিত সমাজ | নারী শুধু তার ভার বহন করে চলে | কারন নারী যদি না থাকত তবে সৃষ্টির আদিপর্বেই সমাজের অগ্রগতি বন্ধ হয়ে যেত | একজন পুরুষ ও একজন নারীর শারিরীক মিলনে একটি নতুন শিশু/মানব চারাগাছের আবির্ভাব ঘটে|
প্রাচীনকাল থেকে আমরা দেখে আসছি যে নারী হল ভোগ্য বস্তু| ঐতিহাসিক,পৌরাণিক ঘটনাগুলি থেকে জানা যায় প্রাচীন যুগে যেমন গরু দান হত, অশ্ব দান হত, তেমনই নারীকে দান করা হত| রাজা হরিশচন্দ্রের সমসাময়িক কালের ঘটনাতেও দেখা গেছে যে নারীকে দাসী/ভোগ্যবস্তু হিসাবে কেনা-বেচা চলত| অর্থাৎ নারী জাতির স্বাধীনতা বলতে বোঝায় অন্যের স্বাধীনতাকে নিজের কাঁধে চাপিয়ে তাকে বহন কর চলা| কিন্তু এটা কি সঠিক? নারী প্রথম জীবনে বাবা - মায়ের অধীনস্ত স্বাধীনতা, বিয়ের পর স্বামীর ঘরে শ্বশুর - শাশুড়ি - স্বামীর অধিনস্ত স্বাধীনতা এবং শেষবয়সে (বৃদ্ধ বয়সে) ছেলে-বউমা-নাতি-নাতনীর অধীনস্ত স্বাধীনতা ভোগ করে|
"নারী স্বাধীনতা" বলতে স্পষ্ট ভাষায় যা বোঝায় তা হল নারীদের নিজস্ব স্বাবলম্বীতা/নিজের যোগ্যতায় অর্থ উপার্জন করে নিজের ব্যক্তিগত সমস্যার সমাধান করা| আমরা "নারী স্বাধীনতা" বলে যতই চেঁচাই না কেন নারীরা এখনও সঠিক অর্থে  স্বাধীনতা পায়নি কারন নির্জন এলাকায় / নির্জন রাস্তায় জনগন চলাচলের নির্দিষ্ট সময় ছাড়া বাকি সময়ে একজন ছেলের পক্ষে যাতায়াত করা সম্ভব হলেও একটা মেয়ের পক্ষে তা অসম্ভব | অর্থাৎ নারীর শারিরীক গঠনই নারীর বিপদের কারণ বলে একাংশ মানব জানোয়ার সওয়াল করেন আজকাল| আমরা অতীত থেকে বর্তমানের দিকে তাকালে দেখতে পাই সমাজ- পরিবেশ অনেক কিছুরই পরিবর্তন ঘটেছে | বর্তমানে আমাদের দেশ -সমাজ প্রগতিশীল  হয়েছে, শিক্ষার উন্নতি হয়েছে| নারী -পুরুষ সমানভাবে এই প্রগতির সাথে এগিয়ে যাচ্ছে|
তাই শিক্ষা গ্রহনের জন্য ঘরের চার দেওয়ালের বাইরে যেতে হচ্ছে| পুরুষদের সাথে পা-মিলিয়ে সব কাজ করতে হচ্ছে জীবনের বিভিন্ন রকম ঝুঁকি বহন করে| কিন্তু এখনও পর্যন্ত একটা বিষয় লক্ষ্য করে থাকি যে ----- মানুষের শিক্ষার উন্নতি হয়েছে, সমাজের উন্নতি হয়েছে তা সত্বেও মানুষের পুরোনো ধ্যান-ধারনা বদলায়নি। কারন এখনও পর্যন্ত মেয়েদের উচ্চশিক্ষা আমাদের সমাজ ভালো চোখে দেখে না| বাবা-মা বেঁচে থাকতে থাকতেই মেয়েকে পাত্রস্থ করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে| কোনো মেয়ে যদি বিয়ে করতে না চায় তবে আমাদের সমাজ তার দিকে কটাক্ষ দৃষ্টিপাত করে| আবার বিয়ে হলেই তো হল না, নারীকে ছোটোবেলা থেকেই বুঝিয়ে দেওয়া হয় যে তার কাছে স্বামীই সব, স্বামীর ইচ্ছা-অনিচ্ছা, সুখ-দুঃখই তার জীবনের অঙ্গ হিসেবে মেনে নিতে হবে| আর তার জন্যই কোনো মেয়ে হয়তো সাহিত্য জগত /সঙ্গীত জগত নিয়ে থাকত কিন্তু বিয়ের স্বামীর ইচ্ছানুযায়ী মেয়েটিকে এগুলি থেকে বঞ্চিত হয়ে সংসার ধর্ম পালন করতে হবে। কারন মেয়েটি স্বাবলম্বী নয়| স্বামীর অর্থের উপর নির্ভলশীল| খুব কম ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে বিয়ের পর স্বামীর সহযোগীতায় মেয়েরা তাদের নিজস্ব ইচ্ছাগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে| এখনও মানুষ শিক্ষিত হয়েও নানা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটিয়ে থাকে| যেমন-- মুসলিম সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে পুরুষরা যদি "তালাক" শব্দটি উচ্চারণ করে ফেলে তবে মেয়েদের দুর্গতির সীমা থাকবে না। "তিন তালাক" উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই মুসলিম মেয়েদের বাপের বাড়ি ফিরে আসতে হয়| অর্থাৎ মুসলিম মেয়েদের কাছে "তালাক" শব্দটা অভিশাপের মত|
আবার হিন্দুদের ক্ষেত্রে একটু অন্যরকম। অতীতে হিন্দু পুরুষদের বহুবিবাহের প্রচলন ছিল| বিশেষত কুলীন ব্রাহ্মণ মৃত্যুর কয়েক ঘন্টা আগেও বিয়ের পিঁড়িতে বসত| মেয়েদের বাল্যবিবাহের প্রচলন ছিল, মেয়েদের বিয়ের নির্দিষ্ট বয়স পেরিয়ে সেই পরিবারকে "একঘরে" করে দেওয়া হত। আবার স্বামী মারা গেলে "সতীদাহ" প্রথা ছিল। তা যাই হোক রাজা রামমোহন রায় ব্রিটিশদের সহায়তায় এই "সতীদাহ" প্রথা বন্ধ করেন। পরবর্তীকালে বিদ্যাসাগর মহাশয় "বিধবা-বিবাহ" আইন চালু করেন|
কিন্তু এখনও পর্যন্ত পুরুষরা স্বেচ্ছাচারীতা চালিয়ে যাচ্ছে। স্ত্রীরা তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধ হলেই "বিবাহ বিচ্ছেদ" করে দিচ্ছে| যেহেতু "হিন্দু বিবাহ আইন" এ একজন পুরুষ একবারই বিবাহ করতে পারেন তাই পুরুষেরা সমাজকে লুকিয়ে তার নিজের পছন্দমত নারীর কাছে যায়, সেক্ষেত্রে মেয়েরা স্বাবলম্বী না হলে মুশকিল হয়| তবে বর্তমানে মেয়েরাও বহুবিবাহ করছে|
এই সেদিনও খবরের কাগজে দেখলাম যে বিবাহের পূর্বে মেয়েটি আত্মঘাতী হয়েছে, কারন তার হবু স্বামী চাকরি ওয়ালা মেয়ে বিয়ে করবে  না|
এই পুরুশাসিত সমাজ একটি মেয়েকে একা বাঁচতে দেয় না, পুরুষরা তাকে ঘিরে টানাটানি করে|
আগেই বলেছি, অনেকের মতে নাকি নারীর শারিরীক গঠনই নারীর বিপদ। তার উপর কাম রিপু | তাই নারীরা পুরুষের অবলম্বন ছাড়া বাঁচতে পারে না, তবে পুরুষ শাসিত সমাজে পুরুষরা ধোয়া তুলসী পাতা। তাদের গায়ে কোনো কলঙ্ক লাগে না| কোনো ঘটনা ঘটলে যেমন--শ্লীলতাহানি, কুমারী বয়সে গর্ভাধারন এসব ক্ষেত্রে প্রথমে মেয়েদেরই দোষ দেওয়া হয়| "নষ্ট" কথাটা মেয়েদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য| অন্যান্য বস্তু ডিম, দুধ, ভাত প্রভৃতি যেমন নষ্ট হয় তেমনি মেয়েরাও নষ্ট হয়|বাবা -মায়েরা তাদের মেয়েদেরকে নষ্ট মেয়েদের থেকে আলাদা রাখতে চায়|
কিন্তু বলতে পারেন মেয়েরা নষ্ট হয় কেন? কারা মেয়েদের 'নষ্ট' উপাধি দেয়? এই খোঁজ কি কেউ রাখে? খুঁজলে দেখা যায়  আমাদের ঘরের আশে-- পাশে ঘরের কাকু,জ্যেঠু,দাদা,মামা এরাই তো মেয়েদের কলঙ্কিত করে নষ্ট উপাধি দেয়| অর্থাৎ যতদিন সমাজ ও সমাজের মানুষ সচেতন না হবে ততদিন নারী স্বাধীনতা হবে না এবং এই ধারাবাহিকতার পরিবর্তন ঘটবে  না|
বর্তমানে একাংশ মানুষের একটা বদ্ধমূল ধারনা হয়েছে যে western culture গ্রহণ করে তাদের মেয়েদের মত আমাদের সমাজের মেয়েরাও প্যান্ট-শার্ট পরে ছেলেদের সাথে ঘুরে বেরিয়ে "নারী-পুরুষ সমান সমান"/"নারী স্বাধীনতা" বলে চেঁচালেই বোধ হয় নারী স্বাধীনতা পেয়ে যাবে| আসলে এই চেঁচানো নিয়েও যথেষ্ট বিতর্কের অবকাশ আছে? "নির্ভয়া"র মত ঘটনাগুলো আমাদের সমাজে কেন ঘটছে এনিয়েও আরও গভীর মনস্তত্ত্ব মন্থন প্রয়োজন। 
"নারী-পুরুষ সমান সমান" এই কথাটা কখনই সম্ভব নয় কারন একজন পুরুষ যা পারে একজন নারী তা পারে না, আবার একজন নারী যা পারে একজন পুরুষ তা পারে না| নারী গর্ভে সন্তান ধারন করতে পারে যা পুরুষ পারে না, আবার পুরুষ সন্তান ধারন মুখ্য ভূমিকা পালন করে যা নারী পারে না| অর্থাৎ সমাজের অগ্রগতির জন্য নারী-পুরুষকে সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে----এ তো কবির কথা|
পিতৃপরিচয় ছাড়া মানুষের অস্তিত্ব নেই, আবার মাতৃপরিচয়ের কোনো গুরুত্ব নেই আমাদের সমাজে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া। বর্তমানে কিছু কিছু কার্যক্ষেত্রে মাতৃপরিচয় দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে| পুরুষ ও নারী হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করার চেষ্টা করছে| তবুও এমন কিছু কাজ আছে যেখানে মেয়েরা অংশগ্রহণ করলে আমরা একটু অবাক হয়ে যাই|
অনেকে ভেবেই নেয় যে নারী হল 'বেনারসী শাড়ি'র মত। তাকে যত্ন করে রাখতে হয়|
নারী-পুরুষ সমান সমান বলে দাবী করছি অথচ সমাজের বিভিন্ন স্থানে মহিলাদের বিভিন্নরকম Facility দেওয়া হয় নারী অবলা জাতি বলে| Train এর Ticket Counter এ মহিলাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা। Bus-Train এ মহিলাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা -------কেন? কেন আলাদা করে দেখা হয়? প্রগতিশীল দেশে কেন মহিলাদেরকে আলাদা করা হবে? আসলে দৃষ্টিভঙ্গিতে আমরা আজও আদিম। 
অর্থাৎ "নারী-পুরুষ সমান সমান"/"নারী স্বাধীনতা" তখনই সার্থক হবে যখন নারীরা পুরুষদের সাথে সমান তালে পা ফেলে স্বাবলম্বী হবে|
এখনও কন্যা ভ্রুণ হত্যা হয়, এখনও বাড়িতে পুত্র ও কন্যা সন্তান থাকলে তাদের মধ্যে বিভেদ রাখা হয় তা সে Education ই হোক বা Social Status ই হোক| অর্থাৎ নারীকে শিক্ষার দিক থেকে উন্নতি ঘটাতে পারলে তবেই সমাজের উন্নতি হবে| অর্থাৎ নারী যখন সম্পূর্নভাবে চার দেওয়ালের বাইরে এসে নিজের সত্তা নিজের প্রতিভাকে প্রকাশ করে স্বাবলম্বী হবে তখন নারী স্বাধীনতা পেয়েছে বলা যাবে। তার আগে এ দাবি যে শতাব্দীর সর্ববৃহৎ মিথ্যাচার।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours