সজল বোস, সমাজকর্মী, দুর্গাপুর:

নদে শান্তিপুর হৈতে খেঁড়ু আনাইব।
নূতন নূতন ঠাটে খেঁড়ু শুনাইব।।
এটা আবার কি? ভাবনা টা অনেকের কাছে পরিচিত নয়। খেঁউড় বা তরজা গানের শব্দ। প্রচীন এই লুপ্তপ্রায় গানের ইতিবৃত্ত সল্পপরিসরে কিছু জেনে নিই।

মহারাজা নবকৃষ্ণ দেব বাহাদুর ছিলেন এই ‘খেঁড়ু’ বা ‘খেঁউড়’ গানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। নবকৃষ্ণের অনুচর মণ্ডলীর মধ্যে একজন কুলুইচন্দ্র সেন ছিলেন সংগীতজ্ঞ মানুষ। তাঁর প্রচেষ্টায় ঊনবিংশ শতকের শুরুতে খেউড় গান ওস্তাদি ঢঙে মার্জিত হয়ে আখড়াইয়ের রূপ ধারণ করে। এরপর কুলুইচন্দ্র সেনের নিকট আত্মীয় নিধুবাবুর (রামনিধি গুপ্ত: ১৭৪১-১৮৩৮) হাতে তার ব্যাপ্তি ঘটে। নিধুবাবু ছাপরায় গিয়ে হিন্দুস্থানি সংগীতের চর্চা করেন এবং এই সময় তিনি হিন্দি গান ভেঙে টপ্পা রচনায় মন দেন। পরে কলকাতায় ফেরার পর তিনি শোভাবাজারে বটতলার বড় একখানা আটচালাতে প্রতি রাতে সংগীতের আলাপ চালাতে থাকেন। শোভাবাজার বটতলা নিবাসী বাবু রামনারায়ণ মিত্র মহাশয়ের আটচালাতেও সর্বদা ‘পক্ষী’(রূপচাঁদ পক্ষী/R.C.D.) দলের উল্লাস চলতো। দলের ‘পক্ষী’রা ছিলেন বক্তা, কবি ও বাবুগোছের লোক। এই দলে নিধুবাবুর সমাদর ছিল।

আখড়াই ছিল অল্প কথার সংযোগে সুর এবং তালের (বাজনার) মূর্ছনা অর্থাৎ রাগরাগিণীর প্রাধান্য। এই ধরণের গান দরবারি আসর ছাড়া সাধারণ দর্শকদের জন্য চলতে পারে না। তাছাড়া এইসব রাগরাগিণী হৃদয়ঙ্গমের জন্য যে সমঝদার শ্রোতার প্রয়োজন, ক্ষণিকের আনন্দ পেতে আসা বাবুদের মধ্যে সেই গুণ সকলের ছিল না। ফলে আখড়াই ভেঙে সৃষ্টি হল হাফ-আখড়াইয়ের। নিধুবাবুর সংগীতশিষ্য বাগবাজার নিবাসী মোহনচাঁদ বসু গুরুর সহযোগিতায় এই হাফ-আখড়াই প্রতিষ্ঠা করেন। আখড়াই গানে দুই দলের মধ্যে উক্তিপ্রত্যুক্তিমূলক দ্বন্দ্ব ছিল না, কিন্তু হাফ-আখড়াইতে সেই রীতির প্রচলন ঘটে। পরবর্তীকালে কবি কিংবা তরজাতে দুই গায়েনের যে দ্বন্দ্ব লক্ষ করা যায় তা সম্ভবত এই হাফ-আখড়াইয়ের জন্যই । হাফ-আখড়ায়ের বিষয় ছিল মূলত প্রণয় ঘটিত। এর দুটি অঙ্গ –‘সখীসংবাদ’ এবং ‘খেউড়’। এদের প্রত্যেকের মধ্যে আবার তিনটি প্রধান অংশ ছিল –মহড়া, তেহারান(refrain) এবং চিতেন। একদল আসরে উঠে ‘সখীসংবাদ’ গেয়ে গেলে অপর দলকে উঠে তার প্রত্যুত্তরে সখীসংবাদ গাইতে হতো। প্রতিপক্ষের গানের উত্তরের সঙ্গে যদি ‘চাপান’ থাকতো তাহলে অপর দলকে আবার আসরে উঠে তার উত্তর দিতে হতো। সখীসংবাদের পর খেউড় গাওনা ছিল রীতি। খেউড়ে শালীনতার সীমা থাকতো না।
কিন্তু এর আগেও তরজার অস্তিত্ব ছিল। বৃন্দাবন দাসের শ্রীশ্রীচৈতন্যভাগবত–এ ‘তরজা’র নিদর্শন আছে কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীর 'এই তরজার অর্থ বুঝিতে নারিল', 'তরজা না জানি অর্থ কিবা তাঁর মন', 'মহাযোগেশ্বর আচার্য্য তরজাতে সমর্থ। আমিও বুঝিতে নারি তরজার অর্থ।' প্রভৃতি উক্তিতে তারই আভাস পাওয়া যায়। এখানে উল্লেখ্য যে, প্রহেলিকাধর্মী উক্তি তরজার প্রাণ মহাভারতেও সেই ধরণের বহু উক্তি বা ‘ব্যাসকূটে’র ব্যবহার আছে। যথা, বারনাবতে যাবার সময় বিদুর যুধিষ্ঠিরকে উপদেশ দিয়েছেন এই রকম প্রহেলিকা।

কেউ কেউ আবার শিবের কিংবা ধর্মের গাজনের সঙ্গে তরজা’র সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেছেন। যেমন বাংলা গানের ইতিবৃত্ত লিখতে গিয়ে সাবিত্রী ঘোষ বলেছেন, 'অষ্টাদশ শতাব্দীর আগে থেকেই ঢোল কাসি সহযোগে ছড়া কেটে গান করবার রীতি ছিল, আর এই ছড়াগুলি শিব সন্ন্যাসীরা শিবের গাজন উপলক্ষ্যে পথে পথে গেয়ে বেড়াতেন। এর নাম আর্যা কিংবা তরজা। তরজার সঙ্গে ‘আর্যা’রও কিছু কিছু মিল লক্ষ করা যায়। সংস্কৃত আর্যা ছন্দে লিখিত এই গান ছিল উত্তর-প্রত্যুত্তরময় ছড়া।

তরজা শুধু যে বাঙালীর পরম্পরাগত ইতিহাসের খবর দেয় তা নয়, বিদেশেও এর সমাদর লক্ষ করেছেন কোনো কোনো লেখক।
বাংলার তরজাগানের একটি পরম্পরীণ ইতিহাস আছে। ব্রিটিশ শাসনের শুরুর দিকে পুরোনো জমিদারি ব্যবস্থায় ফাটল,রাজনৈতিক-সামাজিক অস্থিরতা প্রভৃতির মূল্যস্বরূপ মূলত শহরে বাস করা একশ্রেণির মানুষের প্রচেষ্টায় আখড়াই, হাফ-আখড়াই, ঢপ, কবিগান, আর্যা, তরজা ইত্যাদির প্রকাশ ঘটেছিল। পরবর্তীকালে সংগীতের এইসব ধারা বাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। মূলত নাগরিক সংস্কৃতির হাত ধরে উদ্ভব হলেও কালক্রমে গ্রামীণজীবনেও তরজা সমাদর পায়। বর্তমানে উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, নদীয়া, হাওড়া, হুগলী, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ প্রভৃতি জেলাগুলিতে তরজার প্রচলন লক্ষ করা যায়। তরজা হল হেঁয়ালি বা প্রহেলিকাধর্মী ছড়াগান, যা দুই মূল গায়েন তাঁদের সহকর্মীদের নিয়ে বাদ্যযন্ত্র সহযোগে ছন্দ লড়াইয়ের মাধ্যমে আসরে পরিবেশণ করে থাকেন। এর বিষয়বস্তু মূলত পৌরাণিক। তরজার গায়েনরা রামায়ণ, মহাভারত, বেদ-পুরাণের কাহিনি নিজেদের জ্ঞান এবং মেধা অনুযায়ী বেছে নিয়েই আসরে উপস্থাপন করেন। বর্তমানে বিশ্বায়নের বেনোজলে বাংলার তরজাগানের ঐতিহ্য অবলুপ্তির পথে। তাই সাম্প্রতিক নানান উদ্দেশ্যমূলক কাজে এই গানকে ব্যবহার করে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে বাংলার নিজস্ব ঐতিহ্য এই সঙ্গীত কে।
আমরা আবার পারি এই তরজা গান ও তার লুপ্তপ্রায় শিল্পীদের যোগ্য মর্যদা দিয়ে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করতে। অসাধারণ দক্ষতা ও সহজাত তাৎক্ষণিক শব্দ ও ছন্দ তৈরী করে এক সুরের যুদ্ধ। যে যুদ্ধে নেই অস্ত্র-সস্ত্র, নেই রক্ত, নেই হতাহতের পদচিহ্ন। আছে কেবল পরম শাণিত সুর মূর্ছনায় আনন্দের বিহ্বলতা।
আমরাই পারি ফিরিয়ে আনতে দরজায় তরজাকে।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment: