জীবন রায়, প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ, রাজ্যসভা, দুর্গাপুর:

এক।
শেষ বেলায় বুঝলাম।চেতনার দিক থেকে কোন অর্ধোন্নোত দেশে, আন্তর্জাতিক এবং আভ্যন্তরিন অর্থনীতির সম্পর্কের প্রশ্নে কপাল গুনে যদি অভিবাবক মিলে যায়, একটা ভাবাগত ককটেল আধারিত ভাবাদর্শে, যদি সহায়ক পরিবেশ পাওয়া যায়, মানুষকে অতি অল্প সময়ে জাহান্নামের দরজায় পৌছে দেওয়া সম্ভব।
--- আজকাল এ্যালোপ্যাথির সাথে যেমন দিব্যি হোমোপ্যাথি এবং আয়ুর্বেদ চালানো যায়, তেমনি একটি অর্ধন্নোত ধর্ম বর্ণ এবং সাংস্কৃতিক বহুমুখীনতাতেও একটি চলনসই আর্থ-রাজনৈ্তিক কাঠামো কে এমনভাবে চাপিয়ে দেওয়া যেতেই পারে। সেই কাঠামোকে কোন বিশেষ ইচ্ছাভিমুখে চালিয়ে দেওয়াও যেতে পারে অতি সহজে।এই তো সেদিন, কেন্দ্রের কোন এক ডেপুটি স্বাস্থ্যমন্ত্রী দাবী করেছিলেন, ভারতের আয়ূর্বেদেই নাকি ইংল্যান্ডের রাজকুমার চার্লসের করোনা সেরে গেছে। এই যদি হয়, এদেশের  মানুষকে সব কিছুই বুঝিয়ে দেওয়া যাবে । অবশ্য, প্রিন্স চার্লসের হয়ে, রাজপ্রাসাদ থেকে বিবৃতি দিয়ে বলতে হয়েছিল, খবরটা ঠিক নয়।
আমার এক বয়োজ্যাষ্ঠ নেতা একবার একটা কথা শিখিয়েছিলেন। মেহনতী আন্দোলনের নীতি সংক্রান্ত বিষয়েও নাকি জোড় দিয়ে বল্লে মেনে নেয়। আর বাকি টা চলে বিশ্বাসে। যেমন ভারতের সনাতনীরা দাবী করেন, রাম মন্দিরের বিষয়টি তাদের বিশ্বাস।
সাধারনভাবে আদিভৌতিকবাদে বিশ্বাসী না না হলে, কারুরপক্ষে ধর্মান্ধতার শিকারই হওয়া সম্ভব নয়।অন্যদিকে অন্ধবিশ্বাস এবং আদিভৌতিকবাদের মিশ্রন না ঘটলে, কারুর পক্ষে হিংস্ত্র  হওয়া সম্ভব নয় আর সেই হিংস্ত্রতা ব্যতিরেখে, ভারতের মতো জনবহুল বহুজাতিক সংস্কৃতির কোন দেশকে

দুই।
--  আদিভৌতিকবাদে বিশ্বসি, শিক্ষিত মধ্যমবর্গীয় আত্মপরতা নির্ভর, কোন সরকারের পক্ষে, একদিনের জন্যেও, শাসন করা সম্ভব নয়।এমনি একটি প্রশাসন,
যা একপ্রান্তে বহুজাতিক প্রভুত্ব মেনেছে,চিকিৎসার প্রশ্নে এ্যালোপ্যাথির সাথে, আয়ূর্বেদ এবং সেখান থেকে রোগ-দেবত্ব দিয়েছে, সে রকম প্রশাসন নিজের অজান্তেই নিজেকে প্রবঞ্চনার কারন করবেন এবং মানুষকে প্রবঞ্চিত করবেনই । এর উপর যখন আন্তর্জাতীক সুপার পাওয়ারের চাপ যদি থাকে তো কথাই নেই।
যদি সাদা চোখে দেখা যায়, আক্রান্তের সর্বমোট সংখ্যা হিসেবে, ১৩০ কোটির দেশে ৩১ হাজার বিরাট কিছু নয়।
বিস্ময়কর এখানেই যে, যখন সারা  বিশ্বে
---আক্রান্তের সংখ্যা ৩১ লাখ,  তখন ৩১ হাজারেই সরকারকে বাড়ীতে চিকিৎ্সার কথা ভাবতে হচ্ছে। এতে দেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা এই ব্যধী মোকাবিলায় যে কত অসহায় এবং প্রশাসনি নেতৃত্ব যে কত অন্তদৃষ্টিহীন তাই উন্মোচিত হোল। উপযুক্ত সময় পাওয়ার পরেও, করোনার মোকাবিলায় উপযুক্ত পরিকল্পনাহীনতার কথাই উঠবে, তাই নয় – বর্তমান সরকারের মনন, ইংরাজীতে যাকে বলে psychogenic  pattern সম্পর্কেইও প্রশ্ন উঠবে। যে মহামারীকে দ্বিতীয় যুদ্ধ থেকেও বিপর্য্যয়কর অমানবিকতা বলে চিহ্নিত, তেমন এক যুদ্ধের সামনে, কেন্দ্র  নিজেকে দুরদৃষ্টিহীন, ভাগ্য নির্ভর গতানুগতিকতার শিকার হতে দিয়েছেন।
অবশ্য পশ্চিম বাংলার কথা স্বতন্ত্র। কেন্দ্রের নির্দেশের বাইরে, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শের নিরন্তরতা সত্বেও বাংলায় যদি, একটা পরিকল্পনাহীন হইচই হয়ে দাঁড়ায়, তার প্রধান দায়ীত্ব এই রাজ্যের সেই মহিলার – যিনি নিজেই স্বাস্থ্য মন্ত্রী। অন্যদের বিশ্বাসে নিয়ে, সবাইকে নিয়ে কোন পরিকল্পিত কাজ করার উপযুক্ত তিনি যে নন, সেটা রাজ্যবাসিরা অবগত। এতোবড় একটা মহামারীকেও,  যেভাবে ভোটে জেতেন – সেরকম কিছু একটা মেনেছেন। রাজ্য সরকারী হাসপাতালগুলির অধিকাংশকেই কার্য্যতঃ অকেজো করে দেওয়ার পর,

তিন।
--- এই প্রথম দেখলাম ‘অল্প আক্রান্তের’ নামে বাড়ীতে চিকিৎসার দিল্লীর প্রস্তাবকে লুফে নিলেন।দিল্লীর ঘোষনার আগেই নিজেই জানিয়ে দিলেন। এদিকে কেন্দ্রিয় সরকার, সন্ধ্যে নামার আগেই, দু’হাতে তুলে দিয়ে –
যে সব দেশে বিশ্বের শ্রেষ্ট পরিশেবা থাকা সত্বেও মৃত্যু ২৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে,
সে সব দেশের দোহাই দিয়ে, বাড়ীতে চিকিৎসার কথাবার্তা শুরু করেছে। ভারতের জনবসতীর চরিত্র (ডেমোগ্রাফী) কিংবা জনচেতনা, যে ইউরোপ কিংবা আমেরিকা থেকে কত উন্নত, সে কথা লকডাউন সময়েই দেখা গেছে। এতো দিনে বুঝতে পারছি, কেন ভারতের জন স্বাস্থ্য সেবাকে, বাংলাদেশ থেকে নিকৃষ্ট বলা হোত। বাংলাদেশের যা খবর, তারা অনেক গুছিয়ে গাছিয়ে কাজটা করছে।
বলে রাখা উচিত হবে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যার নিরন্তর পেছন তাড়া না থাকলে, ভারতের করোনা যুদ্ধ এই কাসরঘন্টা আর সঙ্খ বাজানোতেই শেষ হোত।চিন থেকে আমেরিকা এবং ইউরোপে সংক্রমন শুরু হওয়া কিংবা একে মহামারী ঘোষনা করার পর লক ডাউন ঘোষনা করায় ৭০ দিন সময় নেওয়ার কারন ছিলো না।পরে প্রথম করোনা ধরা পরার পর ৫০০তে পৌছুতে একমাস সময় দিয়েছে। তারপর লাফিয়ে লাফিয়ে আক্রান্ত বেড়েছে।
এই সময়ের মধ্যে, না কোন রাজ্যে কিংবা বাংলায়, চিন যে কাজটা সর্বপ্রথম করেছে, পৃ্থক বড় বড় করোনা হাসপাতাল নির্মান, তার কিছুই করে নাই । গনশিক্ষার প্রশ্নে  সার্বজনীনতার ভিত্তিতে কোন কিছুই করার চেষ্টা হয় নাই, দু’দু বার কাশরঘন্টা ঢাকঢোল বাজানো ব্যতিরেখে। বিমান সংস্থাগুলির বিদেশ বুকিং সমাপ্ত হওয়া পর্য্যন্ত, যদি অপেক্ষাই করতে হোল, তবে ঘোষনা কয়েকদিন পূর্বে করে,  দেশের ভেতরে বিভিন্ন স্থানে আটকে যাওয়া-দের ঘড়ে ফেরার সুযোগ দেওয়াই যেতো। সব কিছু যেন হরিসংকীর্তন; রাষ্ট্র যন্ত্র দিয়েই কাজটা উঠিয়ে নেওয়া যেতো।
অবস্য কেন্দ্রীয় সরকারকে দোষও দেওয়া যেতো না!তার দলকে তখন দিল্লীতে সংখ্যালঘু  খুন জখমের পরিকল্পনা করতে হচ্ছে, মধ্যপ্রদেশে বিরোধীদের সরকার ভেঙ্গে বিজেপিকে সরকার নির্মানের গুরুতর কাজে নিমগ্ন থাকতে হয়েছে।এর পর কোন সার্বজনীননতা হয়তো সম্ভবও ছিলো না।
--- আরো লক্ষনীয়,প্রথম যে তিনটি প্রদেশ করোনা দ্বারা সব থেকে বেশী আক্রান্ত হয়েছে, তার তিনটিই প্রধানতঃ আদিভৌতিকবাদে কিংবা সাম্প্রদায়ীকতায় আচ্ছন্ন। মধ্যপ্রদেশ দ্বিতীয় মৃত্যুপুরীতে বদলে গেছে, তাই নয় পাশের রাজ্যগুলিতে বিস্তারের কারন হয়েছে। অথচ মধ্যপ্রদেশের কোন এয়ারপোর্ট বিশ্বের সাথে এতো নিবিড় সম্পর্ক ছিলো না, যা মহারাষ্ট্র কিংবা ব্যাংগালোর, কোচিন অথবা কোলকাতার রয়েছে। যখন এসব চলছে , তখন সেই প্রদেশে কার্য্যতঃ কোন সরকার নেই। কাজেই এটা তো স্পষ্ট, এতো বড় মহাসংকটকে এমন ভাবে নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা হয়েছে, যেন একটি সার্কাস পার্টি। অথচ দেখুন, কোন বিরোধীতা বা আপত্তি ছিলো না। কংগ্রেস নেতা, রাহুল গান্ধী,এক ট্যুইটে বলেছেন, দেশের সব ‘দোকান’ই বন্ধ, একটিরই মহাদাপট চলছে। সারা ভারতে। 
এখন গৃহ চিকিৎসার প্রস্তাবের সাথে সাথে, মিউট্যুয়াল ফান্ডগুলির জন্য  ৫০ হাজার কোটি টাকার খয়রাতির পেছনে পেছনে, সেই সব লোককে, যারা ব্যঙ্ক ঋণ না মিটিয়ে ৬৯ হাজার কোটি টাকার ঋন মকুব করে দেওয়ার প্রস্তাব
---আরো একটি বিষয় ষ্পষ্ট করছে। ঘরে রেখে চিকিৎসাতেই নয়, আমেরিকার পেছনে পেছনে আমেরিকার মতোই, “করোনাকে”  মোটামুটি মহাকাল কিংবা বলতে পারেন পরমব্রহ্মার পাদমূলে ছেড়ে দিয়েই নিশ্চিন্ত হয়েছে। এই মূহূর্তে সেই ছোট বেলায়, কমরেড ডাঙ্গের দেওয়া একটা ভাষনের কথা মনে এসে গেলো।
তিনি বল্লেন, পুজিতন্ত্রেঁ মানুষ নয় , পুঁজিই প্রধান। তখন তাও পুঁজির কেন্দ্রিভবন আজকের স্তরে উঠে আসে নাই । আমেরিকার প্রেসিডেন্টের বিশ্বভিবাবকত্বের স্থান আজকের স্তরে উঠে নাই।ভাষনকে
--- আরো এগিয়ে দিয়ে বল্লেন, পুঁজির মুনাফা যেখানে যতটুকু, যেখানে যত উঁচু সেখানেই সে বিনিয়োগ করবে। যদি কবর খানা নির্মানে, লাভ বেশী হয় সেখানেই সে বিনিয়োগ করবে। এই কথাটির সুত্র ধরেই, ডোনাল্ডের আচরন এবং চিকিৎসার প্রশ্নে
ভারত সরকারের আচরনটিকে চিহ্নিত করাই, লেনিনবাদী পদ্ধতি। এই সুত্রেই প্রশ্নের পর প্রশ্ন উঠবে। প্রথমতঃ এই বিরাট দেশে, যখন যেখানে যেখানে কম্যুনিটি সংক্রামন শুরু হয়েছে, লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে । সারা দেশে যখন শুরু হবে, তখন কোলকাতা, আসানসোলের মতো দেশের সব শিল্পাঞ্চলের বস্তি অঞ্চল ছেয়ে যাবে, যেমন ঘটছে মুম্বাই ধারাবী এবং ইন্দোরে চলছে ।
সারা বিশ্ব চলছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং মূলতঃ চিন থেকে রপ্তানী করা ‘কীটস’ এ। আমাদের দেশে নাকি, সব ‘দু নম্বরী’ তাই ব্যপক টেষ্টিং শুরুই হোল না। বিশ্বের সব দেশ খুব বড়লোক, তাই তারা এসব জিনিষ যোগার করে ১০ লাখে হাজারের উপরে টেষ্ট হয়েছে, ভারতে এক’শ। একটা কোম্পানী, চিন থেকে ২৪০ টাকায় কীট কিনে ৬০০ টাকা সরকারের কাছে বিক্রী করা ধরা পরায়, এই কন্সাইনমেন্ট ফিরিয়ে দেওয়ার পর, আরোপ করেছে সেই কীট দু’নম্বরি।
এখন প্রধানমন্ত্রী শুনিয়েছেন, ভারত কীটস কেনে একেবার ভেক্সিনের বিষয়ে স্বয়ংসম্পুর্ন হচ্ছেন। কীছু কোম্পানী নাকি কাজ করছে।
এদিকে করোনোত্তরকালে, ভারতের সে সব বানিজ্যদস্যুরা, যারা ছিটেফোটা সাহায্য করেছেন কিংবা করে নাই,যতটুকু করেছে – সেটাও সরকারী তহবিলে নয়, প্রাইম মিনিষ্টার কেয়ার প্রাইভেট ট্রাষ্টে টাকা জমা দিয়েছে। আশা করি ‘পরম ঈশ্বর’  এই ফান্ডের সুরক্ষা দেবে।
তবে বানিজ্য খুব জোর শুরু হয়েছে। ভারত ইতিমধ্যে যে আমেরিকার বিশ্ব বানিজ্য চক্রে পা’ দিয়েছে, সেটাই স্পষ্ট। গত লেখা প্রেসে যাওয়ার পর, ভারতের ট্রেন্সপোর্ট মিনিষ্টারের স্টেটমেন্ট এসেছে, সেই ষ্টেটমেন্টে একই দাবী করা হয়েছে, ওষুধেই নয়
মেসিন ক্রয়ের প্রশ্নেও ভারতকে চিন থেকে উঠিয়ে নেওয়া হচ্ছে। তা বেশ,  সেটা সে করুক। কিন্তু ওষুধের বিষয়ে যেমন স্বয়ম্ভর হওয়ার প্রতিশ্রুতী দেওয়া হয়েছে,  সেই প্রতিশ্রুতী, মেসিন বিল্ডিং নির্মানের প্রশ্নে আসে নাই । সেই দেশগুলি থেকে মেসিন আমদানীর কথা বলা হয়েছে, যেঁ দেশগুলিকে আমেরিকা বিশ্ব প্রযুক্তি বন্ঠনে মধ্যস্থানে রেখেছে। অর্থাৎ ন্যাটো ভুক্ত দেশগুলি থেকেই আমদানী হবে। এর মানেটাও বিশ্ব অর্থনীতিতে, ভারতের স্থান সম্পর্কে গ্লোবালাইজেসন উত্তরকালে যে যায়গায় ছিলো,
করোনা মহাযুদ্ধের পর, যা বানিজ্যিক অর্থে সমাপ্তপ্রায়, একই স্থানে থাকবে; সেই পাদমূলে। 
এই সুত্রে আরো একটা ইংগিতবহ খবর এসেছে। ভারত নাকি ইতিমধ্যে, করোনাকালে ‘সোস্যাল ডিস্টেন্সিং’ বজায় রাখতে, বিপুলভাবে ‘রোবট’ প্রয়োগের দিকে এগুচ্ছে।
এ থেকে আমেরিকার, করোনা উত্তর কালের রননীতির ইংগিত পাওয়া যায়। গ্লোবালাইজেসান যে বজ্র আটুনীতে বিশ্বকে এবং বিশ্ব মেহনতীকে দাসত্বের দিকে
ঠেলে নিয়ে যাওয়ার লাইন নিয়েছে, সেখান থেকে কোন মতেই সরছে না।
--- বিশ্ব মেহনতকে এই পরিপ্রেক্ষিতটিকে বুঝে নিয়ে, তার রননীতিতেকেও আজ ধারালো করা শুরু করতেই হবে। আমেরিকা যদি ভারতকে একমাত্র কৃ্ষি
এবং খনিভিত্তিক শিল্পে নেমে আসতে হয়, তবে দেখা যাবে, আজকের দিনের অনেক ‘সুন্দর’ মুখের রাজনৈতিক দল রাস্তায় গড়াগড়ি করবে। তাই মেহনতকে
সংগঠিত করার প্রশ্নে ‘মেহনতীদের’ গুরুতরভাবে ভাবতে হবেই। (ক্রমশঃ)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours