প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:

অদৃষ্ট হাতেখড়ি আঁকে, জীবনবেদ কুন্তী৷ জানা অজানা রহস্যের ফাঁকে প্রতিহিংসা, ঘৃণা, বিদ্বেষের মুখোশে নগ্নরূপ দেখেছে নারী। অরণ্যের আগুনে আকাশ রাঙা লেলিহান শিখা বইছে, ভয়ঙ্কর দৃশ্যে পরিত্রাহি ভাব..  দেহপিঞ্জরে প্রাণের প্রতি মমতার প্রাণীকুল আবেগ,নাম পরিস্থিতি। কোথাও মনে পড়ে যায় আমাদের,
" আবার এখন আমি শতকের জতুগৃহদাহ
পার হয়ে বুকভারা নেব শুধু রাত্রির প্রবাহ ;
আমার প্রাণের মূল্যে ফের
পরিত্রাণ হবে জগতের
তামসী তামসী, ফের ফিরে এসো মোর জগতে "

কিন্তু এ তো বিচ্ছিন্নতার অনলে মনুষত্ব  হীন শিখার আকুতি , পরিত্রাণ অভিপ্রায় করি। আগুন তো নিষ্ঠুর হয়, ধ্বংস উল্লাসকামী। আচ্ছা এই দগ্ধ চিতার অসুখ কি ফিসফিস করে বলেছিল কোনোদিন," পৃথা!  এই বুকের আগুন তোমার বুকে।  তোমার অহংকার ছাড়া এই বিশ্বে সুখের ভাগীদার কে আছে!" কোথাও কি সাহিত্যের জগতে মিলটন ও দান্তের নরকবর্ণনা স্পর্ধা ছুঁয়ে যায়। আসলে জীবন তো তাঁর অসংগতির ত্রুটি,  আর্তনাদের যেন "চন্দ্রশেখর" এর কৌশলের চরম বিকাশ শৈবালিনী কাহিনির সাথে দলনী উপাখ্যান সংযোগ।

অন্তর্গূঢ় জ্বালাময়ী আভরণ কি কোথাও জিউসের চিরকালের বৃত্তান্ত মনে করিয়ে দেয়!!  সেই তো ক্রেনাসের মতো ভয়, আবার সেই সন্তান থেকে অভিশাপ, অজান্তেই চোখের পাতা ভিজিয়ে দেয়৷ দ্রৌপদী প্রেমে আত্মাহুতি দিয়েছেন৷ কুরুক্ষেত্র যেন ক্রোনাস এবং টাইটানদের বিশ্বজুড়ে ক্ষমতার লড়াই, না তো ভুল বলছি!  এ লড়াই যেন আফ্রোদিতি মনে করায় না, এ লড়াই যতোটা না ধর্মনির্ভর, ততটাই ক্ষমতার লড়াই৷ কি পাওয়া আছে তাঁর আর!!  পিতা শূরসেন তাঁর সাথে শত্রুতা করেছে। দূর্বাসা তো তাঁর জীবনে রাহু, পাণ্ডু তাঁর দুঃখের কারণ, কেবল বয়ে চলে অপ্রশস্থ অনুভূতির নদী।
আজ তো মনে আর ধর্মের অনুশাসন উচাটন দেয় না৷ যেমন করে ১৯১৭ সালের রাশিয়াতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর ধর্মের আবেদন হ্রাস পায়৷ মনে হচ্ছিল না, ধর্মের আবেদন শেষ হয়ে গেছে, তাই বিরোধী ভাবের এমন যাপন লালিত হলো, যেন আদর্শে গভীর। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর  সর্বত্র পুনর্জাগরণ আসে। যদি  ইতিহাস অনুয়ায়ী  ৭০ বছরের বিরতি প্রত্যাবর্তনের সূত্র বয়ে আনতে পারে, তবে অনুভূতির জটাজাল তো পৃথার নবজন্ম দিতেই পারে, হ্যাঁ, কুন্তী।

ত্রয়োদশী পৃথার যৌবন মরে গেছে । দুইগালে টোল, স্মৃতিচারণে গাঁথা আকুলতা তো অপলক শিশুমুখ। পৃথা লজ্জা পেয়েছে সেদিন৷ পিতা শূরসেনের এমন আকুল স্নেহ তো আবেগের ছুরি, ভালোবাসি বলেছে কই!!  সংকোচের হাসি হেসে নতুন প্রাণ পেয়েছেন পিতা। বিগলিত কন্যার প্রসন্নতা দেখে বাবার কথা বলতেই মনে পড়ে যায়, রবীন্দ্রনাথের কথা। চোখের সামনে মেয়ের ফুরিয়ে যাওয়া দেখেও নিজেকে জড়ো করেছেন রোজ। অনন্তের কাছে, মুক্তির কাছে, জীবনের তুচ্ছের কাছে নতজানু দর্শন। কিন্তু ভুললে হবে কি করে!  জেদ, আদর, রক্তমাংসের মানুষ চায়৷ তবে সন্তানেরা সবসময় বাবা মায়ের কাছে ছোটো থাকে। কিন্তু তাই বলে তো আর মর্যাদার অপব্যবহার সহ্য করা যায় না।  সব সম্পর্কের মধ্যে থাকে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, মর্যাদা। মুগ্ধ করার মন্ত্রে বাবা কি মর্যাদার বাজে খরচ করেছে!! আসলে মানুষের নিজস্ব মান, সম্মান, জেনেই সংসার তার সম্মান করে। আশাভঙ্গেরা  কি তবে অভিব্যক্তি ছেড়েই কথা বলেছিল!! আসলে পৃথার যে সুতোর মালার মতো সম্পর্কের বিনি ঝুলে থাকে৷ প্রশ্ন করে পৃথা, " আমি কুন্তী না হলে হয়তো আমার এমন পরিণতি হতো না! " চাইতে ঘৃণা, লজ্জা আজ, অবচেতনের বানপ্রস্থ স্মৃতি, নাম " আচ্ছন্ন চেতনা। "

আজ মনে হচ্ছে, শরৎসাহিত্যে " বিপ্রদাস " পড়ছি। পূর্ব গৌরবের পুনরুদ্ধার ভেবে আচারের প্রাপ্তি বন্দনা,  গুরুতর বিপ্লব।  আচারনিষ্ঠ সংস্কার আর জীর্ণ পত্রের অনিবার্যতা স্বাভাবিক৷ বিপ্রদাসের চরিত্রে নিঃসঙ্গ একাকিত্ব যেন পৃথাতেই বিদ্যমান৷ একাধিক অনুযোগের কোনো সদুত্তর এখানে নেই৷ স্তুতিভক্তি আর আরতির প্রজ্জ্বলিত দীপ বারে বারে পিতাস্নেহে জেগে উঠেছে৷ তবু চিরবিচ্ছেদ যেন যান্ত্রিকতা জল্পনা রূপায়ন, নাম কুন্তীভোজের কুন্তী। (ক্রমশঃ)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment: