প্রিয়াঙ্কা সরকার, লেখিকা, বর্ধমান:

মানুষের শরীরেও একটা নির্দিষ্ট গন্ধ আছে। প্রত্যেকটি গন্ধ আলাদা। যেমন করে প্রত্যেক ফুলের গন্ধ আলাদা, তেমন করেই প্রাণীর গায়ের গন্ধও আলাদা৷ মানুষ তো পশুত্বের আকার নেয় সময় বিশেষে, গায়ের গন্ধ তাই বাতাসের গায়ে লাগে না৷ আসলে ভালোবাসার নিশ্বাসে গন্ধ থাকে,  যেমন করে প্রিয় মানুষের গায়ের গন্ধ লেপটে থাকে শরীরে৷ কুন্তীর শরীরে আত্মায়  দুর্বাসা দখলটাও এমনই ছিলো। কুন্তীর শরীরের ঘুম যে তাঁর স্পর্শেই যুগান্তরের ঘুম থেকে জাগিয়েছিল, একথা অসামান্যের আনন্দের উৎসই বলে দেয়। ঋষির শাপে ভয় ছিলো ঠিকই কিন্তু অনুগ্রহের ভিক্ষা তো ছিলো না। আজ মনে হচ্ছে কেন এতো আবেশের ভার ছিলো, তবে কি কুন্তীভোজের প্রতিশ্রুতি!  না, না, এমনটা হতে পারে না। ভালোলাগার কোনো বয়স নেই, মনটাই তো সব। যুগলে মনে, শরীরে দ্বীপ জ্বেলে আরতি হতো নিত্য, তাই তো পরস্পরের খোঁজ৷ এমনটাই তো হয় প্রকৃতি ও পুরুষের পরস্পরের ভাব৷ আসলে হারিয়েতো যায় না কিছুই, যেন হারাতে চায় খোঁজ।

এখন তো প্রশ্ন করতেই হয়,  কুন্তীর মতো বৃহস্পতির  কূটনীতি জানা মেয়েকেও তিনি ফাঁকি দিলেন!  আচ্ছা!  নিষ্পাপ প্রেম উজাড় করে কুন্তী কি পেয়েছিলেন দুর্বাসার কাছে!  প্রেম প্রীতির এক ফোঁটা ঔরসে দিনমাস ধরে অলক্ষ্যে এক মাংসের দলাকে লালন করে কি পেলেন তিনি! তস্করের মতো এমন কন্যার সর্বস্ব লুট করে দুর্বাসা কি পেলেন?  মাতৃত্বের  গহ্বর কলঙ্কিত করতে কুন্তীভোজ কুন্তীকে ব্যবহার করলেন!  সুযোগ পেয়ে জরাসন্ধের ভয়কে কাজে লাগিয়ে ঋষি তৃষ্ণা মিটিয়ে চলে গেলেন দুর্বাসা, কে দায়ী এখানে! তবে কি সেখানেও দায়ী কুন্তী৷
কুন্তী নির্বোধের মতো বিশ্বাস করে ঠকেছেন। মেয়েরা প্রেমাস্পদের কাছে হেরে যায় ইচ্ছা করেই হয়তো;  এই হেরে যাওয়াতেই আশ্চর্য সুখ নিহিত আছে নিত্য। তবে কি কুন্তী চেয়েছিলেন,  দুর্বাসা তাঁকে নিজের ইচ্ছা মতো চালাক!  দুর্বাসা তাঁকে দাসী করে রাখুক!  আচ্ছা!  আত্মনিবেদনে কোন দাহ নেই, অপমান নেই, অনুশোচনা নেই!  দানেই যে আনন্দ তাঁর, তৃপ্তিতে  হয়তো পরিপূর্ণ কুন্তী। এমন শান্ত স্নিগ্ধ ভালোবাসতে শুধু মেয়েরাই জানে৷ কিন্তু, এ সবটুকুই ছিঁড়ে যেদিন দুর্বাসা তাঁকে অবহেলা করেছিলেন, সেদিন কুন্তী বুঝেছিলেন, ভেবেচিন্তে মানুষকে বিশ্বাস করা উচিৎ।  ঋষি কেবল তাঁকে হারিয়েই যান নি, নিয়ে গেছেন বিশ্বাস, সততা আর ভালোবাসা, দিয়ে গেছেন তীক্ষ্ম ছুরীর ধারের মতো খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দগদগে ঘা৷

সুদর্শনা ছিলেন কুন্তীর একনিষ্ঠ পরিচারিকা।  আসলে কুন্তীভোজের কাছে তাঁর নিজের তো কেউ নেই৷ ভালো মন্দ দেখার কেউ নেই। সেখানে তো শূরসেন কন্যা বড্ড একা। সুদর্শনার ভয় ছিলো কুন্তীর শরীরে৷ আসলে মমতা বড়ো উদ্বিগ্ন হয় মন্ত্রের বন্ধনে৷ জীবনে দেখার জন্য ও জানার জন্য উপলব্ধির পাঠ বড়ো প্রয়োজনীয়৷ কুন্তীভোজের কার্যসিদ্ধির জন্য তিনি কুন্তীর মনকে আদর্শের রঙে রাঙিয়ে, দায়িত্ববোধের প্রশংসায় বেঁধে ফেলেছিলেন৷ এবার বুকে কে যেন থেঁতলে দিচ্ছে তাঁর৷ বিশ্বাস, ভালোবাসা সব কি অপরাধ!! এবার সুদর্শনা বললেন, দুর্বাসার সামনে গিয়ে কুন্তীকে একবার দাঁড়াতে ; শুধু মুখে যেতে দেবে না সে;  মনের লড়াই আর নয়, এবার প্রকাশ্যে রাজপথে আসুক সব। কুন্তীর ভালোবাসার কুসুম যে বুকে ফুটেছে, তাই তো ঈশ্বর। সুদর্শনা বলে ওঠে, ভুল!  ভুল!  মেয়েদের চৈতন্য হয় না। মনটা যেহেতু শরীরের মধ্যে বাস করে, তাই শরীর ছাড়া ভালোবাসা হয় না৷

সুদর্শনা কুন্তীকে বোঝাতে বলে, যে, জীবনটা জোয়ার ভাঁটার মতো৷ হাল ছেড়ে ভেসে বেড়ানোর মতো বিড়ম্বনা আর নেই। দুর্বাসার সামনে না হলেও একটি বার কুন্তীকে সে ভোজরাজের কাছে দাঁড়াতে বলে; নির্ভয়ে বলতে বললেন, ঋষি, প্রতারক, ঠগ, দস্যু। এবার অনেকটা বাধ্য হয়েই কুন্তী দাঁড়ালেন কুন্তীভোজের সামনে৷ কিন্তু পারলেন না বলতে তাঁর বিশ্বাস কুচক্রী, ঠগের হাতে পাপের অতিরিক্ত সুদ। না, তা হয় না ; দুর্বাসা তার সেই ঈশ্বর আর সেই ঈশ্বরই তাঁকে আশীর্বাদ দিলেন, "সসাগরা ধরণীর অধিশ্বরী হবে কুন্তী; সন্তানেরা হবে তার পরম গর্বের এবং বিস্ময়ের৷ "

আজ জীবনটা সত্যিই বিস্ময়ের তাঁর। খুব ইচ্ছা করছে একবার চিৎকার করে বলেন, "দুর্বাসা তুমি নিষিদ্ধ সম্পর্কের গায়ে নির্দোষ দেবতার নামের ছাপ লাগিয়ে দিয়ে যাচ্ছো তুমি! তুমি কলঙ্কিত ঋষি। তুমি কপট, প্রতারক৷ পিতৃত্ব স্বীকার করলে যে তোমার গৌরব ক্ষুন্ন হবে, নির্লজ্জ তুমি, নিজের দোষ দেবতার নামে চাপালে। ধিক্কার তোমায়৷ তুমি কি বোকা!  এক কুমারীকে তুমি মা হওয়ার মন্ত্র শিখিয়েছো!  কতো দুর্বল তুমি আর তোমার যুক্তি। আজ আমি তোমার কেউ নয়!!  আজ আমি অবহেলায়, এই তোমার বিচার!!  এই তোমার ভালোবাসার প্রলেপ!!  " না, কুন্তী আজ সম্মোহিত,  ইন্দ্রিয় শিথিল, শক্তিহীন,  চৈতন্যবোধ হীন তামাসার সামগ্রী,  ভালোবাসার পুতুল সাজ। নীরব, তবু কুন্তীর  আজ চৈতন্যোদয়ের অপেক্ষা৷ (চলবে)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment: