জীবন রায়, প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ, রাজ্যসভা, দুর্গাপুর:

 ইতিহাসকে যদি খুব খুটিয়ে দেখা হয়, দেখা যাবে প্রথম বিশ্ব সংকট যখন কোন গুরুতর দিকে  বদলাতে শুরু করে তখনই, বিশ্বের রাজনৈতিক অর্থ-নৈ্তিক কাঠামোর কোন না কোন দিকে একেবারে
উল্টো বদল হয়ে যায়।
এই বদলটা ইতিহাসের কোন দিকে ঘুরবে, তা নির্ভর করবে, একপ্রান্তে মেহনতি কিংবা যে শ্রেনীগুলি ক্ষমতার প্রত্যাসি অন্যপ্রান্তে যারা ক্ষমতায় রয়েছেন, তাদের শক্তি-সন্তুলনের উপরে।এই শক্তি সন্তুলনের কোন দিক আগে থেকে কেমনভাবে, সংকট উত্তরনের কালটিকে চিহ্নিত করতে পেরেছেন। অতলে চলে যান সেই শক্তি সমুহ, তারা যত শক্তিমান হোন না কেন, যারা মেনে চলেন যেন বিশ্বটা যেমন আছে, তেমনি ছিলো এবং যেন তেমনি থাকবে।
গত গত সারে তিন শ’ বছরে, বিশ্ব ইতিহাস পর্য্যালোচনা করলে দেখা যাবে, এই সময়ে যে তিনটি মহাবিপ্লব ঘটেছে, সেখানে তারাই জিতেছেন, যারা আগে থেকে পরিস্থিতির মূল্যাংকন করতে পেরেছিলেন এবং পূর্বাহ্নেই ইতিহাসের পক্ষে ইতিবাচক অবস্থান নিয়েছেন। আরো দেখা যাবে, ১৭৮৯ এর ফরাসি বিপ্লব হোক কিংবা অক্টোবর বিপ্লব হোক অথবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তারাই জিতেছিলেন – যারা বিশ্বের খুটিনাটি গভীরে গিয়ে, দীর্ঘকাল ধরে শুধু  মূল্যায়নই নয় – পরিস্থিতি মোকাবিলায় একপ্রান্তে তাত্বিক দিকে অন্যপ্রান্তে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়েছেন। আজকের বিশ্ব মানবেন, মার্ক্সের কালজয়ী দর্শনের আয়নায় বিশ্বে যে আমুল বদলের সময় হয়ে গেছে, সেটা যদি লেনিন চিহ্নিত করতে না পারতেন অনেক আগে থেকে, কিংবা স্তালিন যদি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যে উপনিবেশ নিয়ে কাড়াকাড়ির যুদ্ধ সেটা যদি আগে থেকে বুঝে যদি আগে থেকে প্রয়োজনীয় তাত্বিক, সামরিক এবং বিশ্ব মেহনতি সমাবেশের আয়োজন যদি আগে থেকে না করতেন,
----- তবে বিশ্বটায় যতটুকুও বা আলোর ঝিলিক রয়েছে, তার কিছুই থাকতো না ।আবার বিশ্বের, বিশেষ করে ইউরোপের শ্রমিক আন্দোলন যদি খ্রুশ্চভের কথায় আত্মসুখে চলে না যেতো, স্তালিনের সেই ভবিষ্যতবানীকে যদি মেনে চলতো, তবে ভিয়েতনাম যুদ্ধ, কিংবা ইন্দোনেশিয়ায় কয়েক লক্ষ কমিউনিষ্ট নিধন, পেট্রিস লুমুম্বা অথবা চিলি প্রেসিডেন্ট আলিন্দের নিধনের মতো ঘটনা ঘটতো না ; এমন কি হয়তো বা ‘করোনার মতো’ প্রকৃ্তির অসন্তুলিত হওয়ার পরিনামকেও ভোগ করতে হোত না। স্তালিন বার বার বলে গিয়েছেন, ১৭৮৯ উত্তরকালের কয়েক শ’ বছরের বুর্জোয়াদের সাধনার যে ফল বিশ্ব এতোকাল ভোগ করেছে, সেটা পুঁজির কেন্দ্রিভবনের সাথে সাথে পুজিতন্ত্র নিজেই গিলে খয়েছে। তাই, তিনি বল্লেন, সেই সন্তানকে ‘ওদের’  কোলে মরতে না দিয়ে – মেহনতিরাই ‘রেনেশা’কে (এবং ভারতের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ-সত্যজিৎ দের ) মেহনতিরাই এগিয়ে দিক।

এইভাবেই, ‘করোনা’ উত্তর কালের সম্ভাব্য পরিপ্রেক্ষিতটা টানতে হচ্ছেঃ
--- দাসত্বকেই ইতিহাসের ইতি বানিয়ে যারা ‘করোনা’কে কাজে লাগিয়ে বিশ্ব শাসনের মতলবে রয়েছেন,
তাদের প্রতিনিধী হিসেবে, যদি আমেরিকান প্রেসিডেন্টকে বিচারে নেওয়া হয়, তবে নিশ্চিতভাবে
মেনে চলতে হবে, ওরা ‘করোনার’ শেষটা দেখে নিয়েছে। প্রস্তুত হতে শুরু করেছে করোনা উত্তর কালের জন্য।
এমনিতেই, মেহনতি নেতাদেরো, পরিস্থিতি না বোঝার কারন ছিলো না। সাম্যবাদী দলগুলি এবং ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের নেতৃ্ত্ব সমুহে, যাদের মধ্যে এখনো কিঞ্চিত ইতিহাস বোধ এখনো আছে তাদের তো পরিনামটা এমনিতেই বোঝার কথা। বিশ্বে খুব বেশী হলে এক কোটি লোক মরবে এবং নিয়ম অনুযায়ী তার অধিকাংশটাই হবে মেহনতি। তবে সংখ্যাটা নিশ্চিতভাবে স্পেন ফ্লুতে মৃত্যু থেকে কম। ভারতেও ভদ্দরলোকেরা রোগ ছড়িয়ে দিয়ে, নিজেদের মরার কোটা প্রায় শেষ করেছে । আর কীছু মরবে লেখকের মতো বয়সের ব্লাড সুগার এবং ব্লাড প্রেসারের রুগী মারা পরবে । যতটা না রোগে, তার থেকে বেশী ঔষধ না পাওয়ার জন্য।
---   এখন মরবে মুম্বাই এ ধারাবির মতো সব মেহনতি বস্তিতিতে। কোলকাতাতে কিংবা আসানসোলেও তাই যে ঘটবে সে সংকেত ইতিমধ্যে আসতে শুরু করয়েছে।  যখন সংখ্যাটা সামনে আসবে,  তখন তো কেউ আর হিসেব মিলাতে যাচ্ছে না।  মেহনতীর বাজার দাম যে কি হূহূ করে কমছে, তা তো বিভিন্ন প্রান্তে অন্যরাজ্যের শ্রমিকদের কীবাভাবে রাখা হচ্ছে, তার চিত্র থেকেই স্পষ্ট। সে সব ছবি তো, স্যোসাল মিডিয়াতে বেরুচ্ছে।  প্রত্যেক বছর ভারতে ৬৪ হাজার গরীব মরে । সরকারী হিসেবে মরাটাই আসে, কে মরলো তা আসে না।
কাজেই সব বুঝে শ্রমিক আন্দোলন আগে থেকেই
মেহনতি ও গনতান্ত্রিক মঞ্চে উঠিয়ে আনার যোগ্যতা
এখনো কিঞ্চিত ধরে রেখেছে কি নয়, সেটাই দেখার।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষনা থেকে কিন্তু স্পষ্ট, অন্য পক্ষ ইতিমধ্যে ঘড় ঘুছাতে শুরু করেছে। উনি এখন দু’বেলা বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থার মৃত্যু কামনা করছেন। অথচ উনি এবং উনার বিশ্ব সাঙ্গপাঙ্গরা জানেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যা উঠে গেলে, করোনা ব্যধি রোধে, বিশ্ব উদ্যোগের দফারফাই শেষ হয়ে যাবে তাই নয়, ‘করোনার’ ভেক্সিন নির্মানের উদ্যোগেও অবসান ঘটবে। বিশ্ব ব্যংকের দলিল হিসেবে গুগুলসে আসা, বিশ্বের প্রধান প্রধান ফিসিসিয়ান, ঔষধ নির্মান ও স্বাস্থ্য বিষয়ক বৈজ্ঞানিকদের ২০০ জনের এক বিবৃতি লিপিবদ্ধ করেছে। ১৩ই এপ্রিলের দিনে স্বাক্ষরিত এই বিবৃতিতে অন্ততঃ ২ ডজন আমেরিকায় বসবাসকারীর নাম পেয়েছি।
ডোনাল্ড জানেন ভেক্সিন আবিস্কারের এই উদ্যোগ নষ্ট হয়ে গেলে, অতিদ্রুত বিকল্প খুজে বের করাটা উনার কাজ নয়।কত ভয়ংকর পুজির কেন্দ্রিভবন। উনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার টাকা বন্ধ বিবৃতিতে বুঝিয়ে দিলেন, যারা বছরে তিন হাজার কোটির অনুদান দেয়, তাদের হুকুম না মেনে, তারা কেনো ৩০৫ কোটি টাকা দেওয়ার দেশের কথা শুনবে? উনি ভারতকে ধমক মেরে,শুধু ক্যুইনিন আদায় করে নেন নাই, খবর অনুযায়ী বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যার তামিলনাদকে পাঠানো কীটসকে রি-রি-ডাইরেক্ট করিয়েছেন আমেরিকায়। আর ১২০০ কোটি টাকার মিসাইল সওদা করেছেন ভারত থেকে একই সময়ে,যেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাথে ভারতের ঝগড়াটাই তিনি লড়ে দিচ্ছেন। এদিকে ৩ হাজার বন্ধ করে দিয়ে, ভারতকে ২২ কোটি দান পাঠিয়েছেন। অথচ, আমেরিকায় রেজিষ্ট্রিকৃত অন্তত একশ’ কোম্পানীর যারা, ভারতে ব্যবসা করে কোটি কোটি কামাচ্ছে,  তাদের একজনও এক ডলার ঠেকায় নাই ।

যাইহোক, করোনা যুদ্ধের ইতিকর্তব্য এবং পরিনাম
ইতিমধ্যে নির্ধারিত। এখন পুজির কেন্দ্রিভূত রুপের
বিপরীতে মেহনতিরা কি অবস্থান নিচ্ছেন, তার উপরেই
করোনা উত্তর কালের ইতিহাস নির্ভর করছে।
তবে এটা নিশ্চিত, এই যুদ্ধ অবসানে পুরানো বিশ্ব আর ফিরে আসবে না কিছুতেই।অন্যদিকে
বিশ্বে মেহনতীর সংগঠিত শক্তির সংবদ্ধতার অবলম্বন ব্যতিরেখে, বিশ্বের সর্ববৃহৎ সামরিক শক্তির
সাহায্যপুষ্ট কেন্দ্রিভূত পুজির বিরুদ্ধে কিছুই করার থাকবে না।
--- এইভাবে আগামী  বিশ্ব ইতিহাসের মোর কোন দিকে ঘুরবে, সেটা নির্ভর করছে, স্তালিন উত্তর কালের বিবষতা কাটিয়ে কত দ্রুত ইউরোপ এবং লাতিন আমেরিকার শ্রমিক শ্রেনী নিজেকে স্বনির্ভর করে নিতে পারবে এবং ভারতের শ্রমিক আন্দোলন কত দ্রুত ভারতীয় উপমহাদেশের শ্রমিক আন্দোলনের সামনে এসে, এসিয়ার শক্তি হিসেবে দাড় করাতে পারবেন। এটাও ঠিক ভারত সম্পর্কে, এটাই ছিল কমরেড বি টি রনদীভের পরিপ্রেক্ষিতগত চালচিত্র। সে সবের ইতিমধ্যে দফারফা হয়েছি।
শুধু এইটুকু বলে রাখিঃ
দ্বিতীয় যুদ্ধের পর, ইউরোপের পুনঃর্গঠনের কারনে বিশ্ব শ্রমিক আন্দোলন অন্ততঃ বছর বিশেক সময় পেয়েছিলো। করোনার পরিনাম দ্বিতীয় যুদ্ধের থেকেও ভয়ংকর হবে, শিল্প, প্রযুক্তি, বানিজ্য এবং পুজীর ধারাবাহিকতার সর্বদিকে। কাজেই, দাসত্বকে এগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হবে ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটানোর পথেই। (ক্রমশঃ)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment: