শুভশ্রী সাহা, লেখিকা, বারাসাত, কলকাতা:

মুঘলজাতি লড়াকু বলে সুপ্রসিদ্ধ ছিল বরাবর। কিন্তু তারা কোনো নোমাডিক নয়, মধ্য এশিয়ার সমরকন্দ থেকে আসা সুন্দর শহরের অধিবাসী, চাঘতাই তুর্কী।দুর্ধষ বীর তৈমুরের লঙের বংশধর হলেও যেমন তেমন ভাবে জীবন কাটানোর অভিপ্রায় তাদের কোনদিন ও ছিল না। তাই তাদের ভাষায় হিন্দুস্থানের দীর্ঘ শাসনকালে শিল্প ও শিল্পকলা সাহিত্য সংস্কৃতির সাথে সাথে খাদ্যচর্চাতেও তারা পিছপা ছিলেন না। তাদের মত ইনোভেশনের পৃষ্ঠপোষক হিন্দুস্থানের ইতিহাসে কম।  বাবর যেহেতু প্রথম হিন্দুস্থানের মুঘল শাসক তাই তার খানা পিনাতে মধ্য এশিয়ার খাদ্যাভাস গুলি সহজে যায়নি । গুলবদন বেগমের বাবর নামাতে সম্রাট মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তার জন্মভূমির ফলের শোক ভুলতে পারেন নি, সমরখন্দের তরমুজের জন্য তিনি পিপাসিত ছিলেন। মধ্য এশিয়ার শুকনো ফলের কথা আমরা সবাই জানি। সম্রাট বাবর কিন্তু গ্রিল করা মাংসের ভক্ত ছিলেন। গোস্তের রোস্ট তার অন্যতম প্রিয় খাবার ছিল।
 হুমায়ুন তার জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় নির্বাসনে থেকেছেন। তাই রসুইখানা সাজানো আর কপালে হয়নি। কিন্তু নির্বাসন কালে তার  প্রিয় বেগম হামিদা বানু সঙ্গে থাকার ফলে পারসীয়ান খানার সুবাস তিনি পেতেন। তার স্ত্রী ছিলেন জন্মসূত্রে ইরানিয়ান মহিলা।হুমায়ুন বিভিন্ন ফলের দ্বারা তৈরী সরবতের খুব ভক্ত ছিলেন। প্রধানত এদেশের আমের শরবত তিনি পছন্দ করতেন বেশি। তার জন্য সুদুর হিমালয় থেকে বরফ আনা হত। নবরতন কোর্মা আর মুর্গ মুসল্লম আমরা হুমায়ুনের খাদ্য তালিকায় পাই।তবে মুঘল রসুইতে  রান্নাতে শুকনো ফল, জায়ফল জয়িত্রী ক্রিম ছাগলের দুধ দ্বারা তৈরী মাংস হামিদাবানুর রেসিপি ছিল। হালিম বলে একটি ডিশ ছিল বিখ্যাত। মসলা হিসেবে আদা জিরের কথা প্রায় অনুপস্থিত। পর্তুগীজ রা ভারতবর্ষে আসার পর মশলার যোগান তারা দিতো। সাউথ ইস্ট এশিয়ার মশলার খুশবু ছিল দুর্দান্ত।
মুঘল রসুই ঘরের ব্যাপক পরিবর্তন আনেন সম্রাট আকবর।  তিনি ভোজনপ্রিয় ছিলেন।ম্যারিনেট করে রেখে মুগ মুসল্লম করা তার সময়ের  রাঁধুনিরাই করত। যদিও সপ্তাহে তিনদিন নিরামিষ আহার তার হিন্দুপত্নী যোধাবাইয়ের মহলে গ্রহণ করতেন। বলা হয় যোধাবাই স্বহস্তে কিচেন গার্ডেন দেখাশোনা করতেন এবং শাক সব্জির গাছে গোলাপ জল দেওয়া হতো সূর্যাস্তের পর যাতে সকালে রান্নায় সব্জির সুবাস ছড়িয়ে পড়ে।  সম্রাটের জন্য যোধা বাই পাঁচরকমের একটি ডাল(পাঁচমেল ডাল) এবং নয়টি সবজি দিয়ে কাজু কিসমিশ সহযোগে নবরতন কোর্মা প্রস্তুত করতেন। পালং শাক প্রস্তুত করতেন  মেথিদিয়ে।  ছোট এলাচ জয়িত্রী আদা ইত্যাদি নিরামিষ হেঁসেলে ব্যবহার করা হত রান্নায়। রান্নায় ছাগ দুগ্ধ ছিল অত্যাবশ্যক উপাদান।পরে পাঁচমেল ডাল এবং নবরতনের রেসিপি এত হিট হয়ে যায় যে, শাহজাহানের সময় এটির নাম হয় শাহী নবরতন কোর্মা ও শাহী ডাল। অবশ্যই ক্রিম সহযোগে আরো রিচ হয়ে যায়। আকবরের সময় প্রায় দেশের সব প্রভিন্সের ই কুক ছিল। মুঘল রসুই ঘরে রসুই খানার   নাম ছিল 'মতবক'।  সম্রাট হারেম থেকে খাবার গ্রহণ করতেন এবং হারেম চালাতেন সেই সময়ের সম্রাটের প্রধানা বেগম।  অবশ্য সেই নিয়েও কম কোঁদল হতো না। এত গুলি মানুষের দেখা শোনা খাবার হিড়িক কম নয়! জাহাঙ্গীরের বেগম আর রক্ষিতা মিলিয়ে প্রায় তিনশোর উপর ছিল এক সময়। তারপর নিজের মা, সৎ  মা, পালিত মা, দাস দাসী তাতারনীর সংখ্যা তো মন্দ নয়! 
শুধু বাবরের সময় তার বোন গুলবদন বেগম, এবং মমতাজ মহলের মৃত্যুর পর জাহানার হারেমের প্রধান হন। গুলবদন বেগম আর শাহজাদা জাহানারা দুজনেই স্ট্রিক্ট টাইপের ছিলেন বলে খাওয়া দাওয়ায় সম্রাট বাদে বাহুল্যতা কম ছিল।
বেগম যোধাবাইএর পর জগত গোঁসাইন, খুররমের মার হাতে ছিল চাবি, তার অকাল মৃত্যুতে নুরজাহান হারেমের প্রধান হন। যোধাবাই যদিও বেঁচে ছিলেন তখন কিন্তু বাক্যালাপ ছিল না দুজনের। এ বিষয়ে সৎ শাশুড়ী রুকাইয়া বেগম তাকে দীর্ঘদিন তা লিম  দেন। দৈনিক এক হাজার টাকা ছিল বরাদ্দ এই দুবিশাল রসুইএর। সেই সময়ের একহাজার টাকা এখন যদি হিসেব করতে যান, তাহলে হিসেব করাই যাবে না হয়ত। রান্না করা খাবার সোনা রুপা আবার মাটির পাত্রেও সার্ভ করা হত। রসুই প্রধান ছিলেন শাহি খানসামা এবং তিনি শাহী হাকিমের পরামর্শ ক্রমেই মেনু তৈরী করতেন। যাতে সম্রাটের শরীর ভালো থাকে।তাতে সিলমোহর লাগাত প্রধান বেগম। সম্রাটকে পরিবেশনের আগে সেটি চেখে তবেই দেওয়া যেত। মীর বকোয়াল ছিলেন রসুইখানার ইনচার্জ! এবার ফিরি আবার রান্নার কথায়।
মুঘল শাসকেরা মাংসের ভক্ত ছিল বড়। সুদুর যুদ্ধ যাত্রায় সম্রাটের জন্য দুম্বা এবং ফল নিয়ে যাওয়া হতো।কম পড়লে শিকার করা হত। জাহাঙ্গীর ভোজন বিলাসী ছিলেন তার অতিরিক্ত মদ্যপান তার সাথে কাবুলী পিচ আরচেরি রক্তে শর্করা এবং ব্লাড প্রেসার দুই বাড়িয়ে দিয়েছিল প্রচুর পরিমানে। সিরাজীর সাথে আফিং গুলি নেওয়া হত মৌতাতের জন্য। এত অত্যাচার আর সইতে পারিনি দুর্বল পাকস্থলী, প্রায়শই পেটের ব্যাথায় অস্থির হতেন বলে আখনী বলে কচি ছাগলের সুপ করা হত। ছাগলের মাংস সেদ্ধ হলে পুরো ছেঁচে নিয়ে তার উপর দারচিনি লবঙ্গ গরমমশলা দিয়ে ছেঁকে নেওয়া হত। লাহোর দূর্গে থাকাকালীন দীর্ঘদিন সম্রাট এই খেয়ে থাকতেন।
রাজপ্রাসাদের পোষা মুরগীদের হাতে করে খাওয়ানো হত এবং ফিলেতে সাফ্রন গোলাপ জল দিয়ে রাখা হত। সুগন্ধের জন্য মুরগীকে চন্দন দিয়ে প্রস্তুত তেলে ম্যাসাজ করা হত একসপ্তাহ ধরে রসুই ঘরে পাঠানোর আগে। প্রত্যেক টি ডেসার্টে বরফ দেওয়া হত। বরফ রিলে প্রসেসে রিসিভ করা হত। খাবার দুধ ক্রিম দই তে যেমন গার্নিশ করা হত,উপরে ফুল এবং পাত্রের উপর সোনা বা রুপো দিয়ে তৈরীফয়েলে মুড়ে দেওয়া হত পরিবেশনের আগে।
মুঘলরা জাঁবাজ সিপাই ছিল তাদের যুদ্ধে অন্যতম হাতিয়ার ছিল  জঙ্গী হাতি। এই হাতিদের রসুইঘর আর তার বরাদ্দ খাবারের মূল্য শুনলে আজকের দিনে অমৃতসরের লঙ্গর খানাও লজ্জা পাবে। বরাদ্দ গ্রেনস ছাড়াও আখ এবং চিনি ছিল মাস্ট। এদের যুদ্ধ ক্ষেত্রে ছেড়ে দেবার আগে খানিকটা কড়া করে রাম জাতীয় মদ খাইয়ে দেওয়া হত।
মুঘল সম্রাটদের প্রথম জীবন কাটত যুদ্ধক্ষেত্রে নয় রাজধানী থেকে দূরে বাগী হয়ে জঙ্গলে, রাস্তায়। শাহজাহান দীর্ঘদিন সন্তানদের নিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় কাটিয়েছেন, খাদ্য কমে গেলে নিজেও বাজরার রুটি আর দুম্বার মাংস খেয়েই কাটিয়ে দিয়েছেন। শাহেনশাহ হয়ে তিনি একটি রেসিপি বুকও প্রকাশ করেন। তাতে প্রথম শাহী খানা শব্দ টির ব্যবহার পাই। আওরঙ্গজেব সুদূর দাক্ষিণাত্যে থাকার সময় বারবার চেষ্টা করেছেন দিল্লীতে ফিরতে। দাক্ষিনাত্যের খাবার দাবার ছিল তার একদম না পসন্দ। সবার ই ভীষণ দূর্বল জায়গা ছিল ফল। কাবুলি পীচ, চেরি মেওয়া আখরোট খেজুর তাদের জন্মস্থান সুদূর উজবেকিস্তানের টান এড়াতে পারেন নি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment: